বিজ্ঞাপন

ত্রিদেশীয় পরমাণু চুক্তি: বাংলাদেশের প্রত্যাশা

July 13, 2018 | 12:03 pm

।। ড. মো. শফিকুল ইসলাম।।

বিজ্ঞাপন

স্বাধীনতাকামী বাঙালি বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও রাজনীতিবিদদের অন্তরে গভীর প্রত্যাশা ছিল অবহেলিত পূর্ব পাকিস্তান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চায় উন্নত হোক। শুধু পশ্চিম পাকিস্তানই কী পরমাণু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত থাকবে? পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙ্গালীদের মেধা-মনন তো পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে কম নয়? বাঙালি বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের অবদান ছাড়া পাকিস্তান এত দ্রুত পরমাণু চুল্লি নির্মাণের অধিকারী দেশ হতে পারত না। শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় বলি হয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে থাকবে, তা কোনোক্রমেই বাঙালিরা মেনে নেয়নি। কাজেই ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ এবং বাঙালি বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের চাপে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে পাবনার রূপপুরে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেদিন থেকে রূপপুর বিশ্ব দরবারে পরিচিতি পায় পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের স্থান হিসেবে।

১৯৭১ সালে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের কারণে পাকিস্তান সরকার রূপপুরে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে পড়ে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদের স্বপ্নের রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন গঠন করেন। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন গঠন করার পূর্বে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু বেশ কয়েকজন মেধাবী বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীকে ভারতের ভাবা পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করতে প্রেরণ করেছিলেন, উদ্দেশ্য ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে কীভাবে একটি খ্যাতিমান পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা যায়। কারণ আমাদের মেধা ও সম্পদ ব্যবহার করে পশ্চিম পাকিস্তানিরা কীভাবে পরমাণু গবেষণা থেকে পরমাণু চুল্লি নির্মাণ করেছে তা জাতির পিতা ভুলে যাননি। বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম. এ ওয়াজেদ মিয়ার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকান্তিক ইচ্ছায় সাভারে ২৬৫ একর জমি বরাদ্দ দেন। পরবর্তীতে সেখানে দেশের বৃহত্তর পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অকাল মৃত্যুতে পরমাণু শক্তি কমিশন গঠিত হলেও রূপপুর পরমাণু প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ বন্ধ হয়ে যায়। সৌভাগ্যক্রমে জাতির জনকের জামাতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে চাকরি করার সুবাদে রূপপুর পরমাণু প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি সর্বদাই জোর দাবি জানাতেন।

বিজ্ঞাপন

অপরদিকে তিনি আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার সহিত নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যা যা দরকার যেমন-জাতীয় জ্বালানি নীতিতে নিউক্লিয়ার পাওয়ারের ভূমিকা, নিউক্লিয়ার পাওয়ার পলিসি ও এ্যাকশান প্লান, ভৌত অবকাঠামো ও মানব সম্পদ উন্নয়ন ইত্যাদি মৌলিক কার্যসমূহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। এক সময় তিনি প্রকল্প বাস্তবায়নের গুরু দায়িত্বও কাঁধে নিয়েছিলেন।

দেশে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা তথা জ্বালানি নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে জ্বালানি বহুমুখীকরণ নীতি অনুসরণ করে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে রূপপুরে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার সঙ্গে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। ২ নভেম্বর ২০১১ সালে বাংলাদেশ সরকার ও রাশিয়ার সহিত রূপপুরে প্রতিটি প্রায় ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন দুটি পরমাণু চুল্লি স্থাপনের জন্য সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। তারপর থেকে রাশিয়া-বাংলাদেশ সরকারের সহিত রূপপুরে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত যেমন-প্রকল্প সাইট সমীক্ষা, অর্থ সহায়তা, চুল্লি ডিজাইন, জনবল তৈরি, নিউক্লিয়ার ফুয়েল সরবরাহ, পরমাণু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে ১২টি চুক্তি স্বাক্ষর করে। যার ফলশ্রুতিতে গত ৩০ নভেম্বর ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম রিএ্যাক্টর বিল্ডিং এর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। এর ফলে বাংলাদেশ ৩২তম দেশ হিসেবে বিশ্বের পরমাণু ক্লাবে প্রবেশ করল। বাংলাদেশ তার গর্ভে ধারণ করল ১টি পরমাণু চুল্লি। সঠিক নিয়ম-নীতি, গুণগতমান, দক্ষ, স্বচ্ছ ও আএইএ এর নির্দেশিকা মেনে নির্মাণ চললে আগামী ৫-৬ বছরের মধ্যে দেশ তৈরি করতে পারবে একটি পরিপূর্ণ পরমাণু চুল্লি। প্রায় সাড়ে সাত মাস পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ জুলাই উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন দ্বিতীয় রিএ্যাক্টর বিল্ডিং এর ভিত্তিপ্রস্তর। এর ফলে বাংলাদেশ তার গর্ভে ধারণ করতে যাচ্ছে আরও ১টি পরমাণু চুল্লি।

অপরদিকে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের সাথে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার লক্ষ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি থাকলেও বঙ্গবন্ধুর অকাল মৃত্যুর কারণে তা আর বাস্তবে রূপ নেয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার কারণে ২০১৫ সাল থেকে সেই চুক্তি পুনরায় কার্যকর করার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ করে আসছিলেন। কারণ ভারতের রয়েছে পরমাণু চুল্লি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দীর্ঘ ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা, বর্তমানে চালু রয়েছে ২২টি পরমাণু চুল্লি, ছয়টি নির্মাণাধীন, ২০টি পরিকল্পনাধীন। তাদের প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা উদ্ভাবন করছে নিত্য-নতুন পরমাণু চুল্লি, দুর্ঘটনা সহিষ্ণু পরমাণু জ্বালানি ও পরমাণু বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তি। কূটনৈতিক সফলতার কারণে অবশেষে ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মাধ্যমে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, কারিগরি সহযোগিতা ও তথ্য আদান-প্রদান, জনবল প্রশিক্ষণ, নির্মাণাধীন রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে নন-নিউক্লিয়ার বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও ভবিষ্যতে নির্মিতব্য পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে একই ধরণের সহযোগিতা প্রদানের লক্ষ্যে তিনটি সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদিত হয়।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি ১ মার্চ ২০১৮ সালে বাংলাদেশ, ভারত ও রাশিয়া মিলে ত্রিদেশীয় পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই ত্রিদেশীয় পরমাণু চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্মাণাধীন রূপপুরে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে ভারত ও রাশিয়া মিলে জনবল প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি বিনিময় ও নন-নিউক্লিয়ার বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি তৈরি ও সরবরাহ করা।

এ ত্রিদেশীয় পরমাণু চুক্তি সৃষ্টির মূলে কাজ করেছে রাশিয়া ও ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান ২০১৪ সালের পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে সহযোগিতা জোরদারকরণের কৌশলগত লক্ষ্য। যদিও ১৯৮৮ সালে রাশিয়া ও ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক পরমাণু সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই ত্রিপাক্ষিক পরমাণু চুক্তির ফলে রাশিয়া-ভারতের সহযোগিতার মাধ্যমে রূপপুরে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্দিষ্ট সময়ে ও সাশ্রয়ী মূল্যে নির্মাণ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বিনিময়ে ভারত বিদেশের মাটিতে এই প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে তাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা কাজে লাগানোর বিরাট সুযোগ পাবে।

অপরদিকে বাংলাদেশ পাবে আধুনিক প্রযুক্তি বিশিষ্ট অধিকতর নিরাপদ, ক্রুটিবিহীন ও সাশ্রয়ী মূল্যে পরিবেশবান্ধব দুটি পরমাণু চুল্লী, যা বিশ্বের দরবারে প্রতিটি বাংলাদেশি নাগরিকের জন্য বয়ে আনবে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। এই ত্রিদেশীয় পরমাণু চুক্তি বিশ্ববাসীর কাছে আরও একটি অনুকরণীয় মডেল হলো। কেননা বিশ্বে প্রথম এ ধরনের চুক্তির সফল উদাহরণ হচ্ছে যুক্তরাজ্যে হিন্ক্লে পয়েন্ট সি-তে নির্মাণাধীন পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র যেখানে ফ্রান্স ও চীনের সরাসরি বিনিয়োগে কাজ চলছে। এ ত্রিদেশীয় পরমাণু চুক্তি পরমাণু শক্তি থেকে সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিক্ষা ও গবেষণায় কার্যকরি ভূমিকা রাখুক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: ড. মো. শফিকুল ইসলাম, চেয়ারম্যান, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/একে

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন