বিজ্ঞাপন

একটি বীরোচিত মৃত্যু ও একজন ‘কাপুরুষ’

August 16, 2018 | 2:51 pm

||সারাবাংলা প্রতিবেদক||

বিজ্ঞাপন

‘আর্মির আইন অত্যন্ত কঠিন। দুর্বল নেতৃত্বের কারণে এগুলোর প্রয়োগ হয়নি। মেজর ডালিম ও মেজর নূরকে কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করা উচিত ছিল। তা না করে আর্মি অ্যাক্ট-১৬ মাধ্যমে একটিমাত্র পত্র দিয়ে বিদায় করে দেওয়া হয়। বিচারের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করলে ওরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে সাহস পেত না।’

সংসদ সদস্য মে. জে. (অব.) এটিএম আবদুল ওয়াহ্হাবের এই উক্তিটি কিছু বার্তা দেয়। যেটি তিনি করেছিলেন অনেক পরে। তবে তা খোদ জাতীয় সংসদ অধিবেশনের ফ্লোরে দাঁড়িয়ে। তার কথার উদ্দেশ্যটি ছিলো এই- জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়তো ঠেকানো যেতো, কিন্তু তখনকার ব্যবস্থাপনায় দুর্বল, কিংবা বলা চলে অনিচ্ছুক নেতৃত্বই গুটিকয় বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার বুকে দুঃসাহস যুগিয়েছিল।

জাতির জনককে হত্যাকারীদের আজ বিচার হয়েছে। অনেকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরও করা হয়েছে। কেউ পালিয়ে বেঁচে আছে। তবে পেছনের শক্তিগুলো, কিংবা যাদের ওপর অগাধ বিশ্বাস রেখে তখন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং, তাদের নির্লিপ্ততা, কিংবা হতে পারে জেনে বুঝেই চুপ থাকার কারণে যে হত্যাকাণ্ড, যার ক্ষতি গোটা জাতি আজও বহন করে চলেছে। ৪৩ বছর পর হয়তো সময় এসেছে তাদের চিহ্নিত করার।

বিজ্ঞাপন

সুনির্দিষ্ট করে বলতে হবে তখনকার সেনাপ্রধাননের কথা। যিনি বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে কোনো উদে্যাগতো নেনই নি, বরং তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে।

পরামর্শটি কাপুরুষোচিত ছিলো তাতে সন্দেহমাত্র নেই। যিনি জাতির জনক, সর্বকালের শ্রেষ্ট বাঙালী, সেরা বীর, জীবনে কোনো পর্যায়ে যিনি মাথানত করেননি তিনি বেছে নিয়েছিলেন বীরের মৃত্যু।

সেদিন যদি বঙ্গবন্ধু এই কাপুরুষোচিত পরামর্শ মেনে পালিয়ে যেতেন, তা বঙ্গবন্ধুর বিশালতাকেই ছোট করতো। কে জানে, পরামর্শদাতার হয়তো সেই উদ্দেশ্যই ছিলো।

বিজ্ঞাপন

তবে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বিচক্ষণ বঙ্গবন্ধু বুঝেই নিয়েছিলেন, কোনও কাপুরুষের পরামর্শে, কিংবা কাপুরুষোচিত পরামর্শে পলায়ন নয়, মৃত্যু তাকে বরণ করতে হবে বীরের মতই।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের কিছু কথা এখানে প্রণিধানযোগ্য।
তিনি বলেছিলেন, ‘শেখ মনি মারা যাওয়ার দেড়-দুই ঘণ্টা পর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা হয়। ওই যে শফিউল্লাহ, মিথ্যাচার করে বেড়াচ্ছে। আর্মি চিফ ছিলেন। মনি ভাই মারা যাওয়ার দেড়-দুই ঘণ্টার পর বঙ্গবন্ধু মারা গেলেন। কেউ বলে ৬টা ৪৭ মিনিট। বঙ্গবন্ধু সবার কাছে ফোন দেন। কর্নেল শাফায়াত ছুটে আসেন। আর উনি (কে এম শফিউল্লাহ) বসে বুড়ো আঙুল চুষছিলেন।’

ক্ষোভটি যথার্থ। এই কারণে যে, আমরা জানি হারানোর বেদনা তাকেই সবচেয়ে বেশি কাঁদায়, যে হারায়। শেখ ফজুলুল করিম সেলিমেরা হারিয়েছেন তাদের প্রিয়জনকে। তারাতো ক্ষোভে ফেটে পড়বেনই। তাদের চোখেই ধরা পড়বে, কে কোথায় বসে কী ভূমিকা পালন করেছিলেন।

সেলিম আরো বলেছেন, ‘এটা তো কোনো সেনা অভ্যুত্থান ছিল না। বিপথগামী সেনা ও অবসরপ্রাপ্ত সেনারা এটা করেছিল। যখন তারা অস্ত্র নেয়, তখনই তাদের কোর্ট মার্শাল হওয়া উচিত ছিল। উনি (শফিউল্লাহ) এগিয়ে এলেন না।

বিজ্ঞাপন

‘কেন ওই দিন বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে শাফায়াত জামিলকে সঙ্গে নিয়ে পাঁচখানা, দশখানা ট্রাক আসে নাই? কীসের জন্য শফিউল্লাহ নীরব ছিলেন?’ প্রশ্ন শেখ সেলিমের।

শেখ সেলিম বিষয়টিতে এতটাই ক্ষুব্ধ যে কে এম শফিউল্লাহকে উদ্দেশ্য করে আরও বলেছিলেন, ‘উনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছেন— আপনি একটু বাসা থেকে বেরোয় যাইতে পারেন না। কত বড় বেয়াদব? বঙ্গবন্ধুকে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান আর্মির ভয়ে বাসা থেকে পালান নাই, আর তার বানানো আর্মি দেখে পালায় যাবেন!’

যথার্থই সেই উক্তি। বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর মুখেই শুনেছে তার মৃত্যুভয়হীন সেই উক্তির কথা।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তাকে গ্রেফতার করে নেওয়ার সময়টির কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলছিলেন, ‘পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমান্ডো বাহিনী আমার বাড়িটি ঘেরাও করেছিলো। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো। আমার কাছে তথ্য ছিলো, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমাকে হত্যা করবে এবং প্রচার করে দেবে যে, তারা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপোসের আলোচনা করছিলো, তখন বাংলাদেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে। আমি বাড়ি থেকে বেরুব কী বেরুব না ভাবছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম, পাকিস্তানীরা বর্বর বাহিনী। আমি এও জানতাম, আমি আত্মগোপন করলে ওরা দেশের মানুষগুলোকেই হত্যা করবে। বড় ধরনের হত্যাযজ্ঞ চালাবে। তাই আমি স্থির করলাম, আমি মরি তাও ভালো… তবুও আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক।’

কথাগুলো তিনি বলেছিলেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড প্যারাডাইন ফ্রস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে।

ফ্রস্টকে বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন- ‘যে মানুষ মরতে রাজি থাকে তাকে কেউ মারতে পারে না। আর আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারবেন। কিন্তু সে তো তার দেহ। তার আত্মাকে আপনি হত্যা করতে পারবেন না? কেউ তা পারে না। এটাই আমার বিশ্বাস।’

তাহলে, যে মরতে রাজি থাকে তাকে কেউ মারতে পারে না, এমন দর্শণেই যার আস্থা তাকে পালিয়ে যেতে বলা ছিলো রীতিমতো অন্যায়, ধৃষ্ঠতা ও কাপুরুষোচিত।
সে কথাগুলোই আমরা উচ্চারিত হতে শুনেছি শেখ ফজলুল করিম সেলিমের মুখে।

তিনি আরও বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু ছয়টার পরে মারা গেলেন আর শফিউল্লাহ বিপথগামী সৈনিকদের সঙ্গে রেডিও স্টেশনে গেলেন। তিনি কেন অর্ডার দিলেন না, ‘যারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে গেছে, তারা আর ঢুকতে পারবে না। এরা ক্যান্টনমেন্টে ঢুকলে এদের অ্যারেস্ট করা হোক।’
সেনা প্রধান তা দেননি। আর কাউকে অ্যারেস্টও করা হলো না, আক্ষেপ ঝড়ছিলো সেলিমের কণ্ঠে। তিনি বলেন, ডালিম গেল, নূর গেল, এরা কিন্তু সবাই অবসরপ্রাপ্ত। ওইখানে গিয়ে তাকে (শফিউল্লাহ) নিয়ে আসল। উনি বললেন—খুনি মোশতাকের সরকারের প্রতি উনি আনুগত্য স্বীকার করবেন।

তিনি বলেন, ‘রক্তের সঙ্গে যারা বেঈমানি করছে তারা কখনো ভালো থাকতে পারে নাই।’

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সিঁড়ির ওপর ফেলে রাখা হয়েছিল, জিয়াউর রহমানও সিঁড়ির ওপরই পড়ে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তার ওই করুণ পরিণতি হয়তো হতো না। খালেদ মোশাররফও ওই পথে চলে গেছেন।’

অপর এক বক্তৃতায় ওই দিনটির কথা জানাচ্ছিলেন শেখ সেলিম। তিনি বলেন, আর্মি যখন বঙ্গবন্ধুর বাসায় ঢুকে পড়ে তখন বঙ্গবন্ধু সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ কে টেলিফোন করে বলেছিলেন, তোমার আর্মি আমার বাসায় আক্রমণ করেছে। তুমি ইমিডিয়েট ব্যবস্থা গ্রহণ করো। কে এম শফিউল্লাহ বলেছিলেন, আমি দেখছি। সেখানেই শেষ ঘটনাস্থলে যাওয়ার কোনও চেষ্টাও তিনি করেন নি।

তিনি আরও জানান, ‘ওই দিন কেএম শফিউল্লাহ নিরবতা পালন করেছিলেন। বাসা থেকে বের হন নি। বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পর তিনি মিটিং করেছেন।’
এসবের উত্তরে কেএম শফিউল্লাহর যে জবাব ছিলো না তা নয়। তবে তাকে অনেকেই হাস্যকর ও কাপুরুষোচিত বলেই আখ্যা দিয়েছেন।

শফিউল্লাহ বলেছিলেন- ‘আমি সেখানে গিয়ে যদি মারা যেতাম লাভটা কি হতো। আমি যখন জানতে পেরেছি কেউ আর জীবিত নেই আমার সেখানে যাওয়ার আর কোনও কারণ ছিলো না। মৃতদেহ দেখে আমার কি লাভ হতো?’

জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করার মতো ঘটনা ঘটার পরও যিনি কেবল নিজের লাভ খুঁজতে পারেন তার আর যাই হোক সেনাপ্রধানের দায়িত্বে থাকা মানায় না। এটা সত্য বিরাজমান পরিস্থিতিতে অনেকেই খুব একটা সাহস দেখাতে পারেন নি। তবে কে এম শফিউল্লাহই তখন ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি সাহস দেখাতে পারতেন। কিন্তু তিনি দেখান নি।

জাতি অবশ্য কেনই সেটা আশা করবে? জাতিকে তো এটুকুও বুঝতে হবে এই কাপুরুষতার পেছনেও হয়তো কোনো কারণই ছিলে। যদি সেটা হয় যড়যন্ত্রের অংশ তা হতেই পারে। আর যদি হয় অক্ষমতা তাহলে, স্বাধীন দেশের প্রথম সেনা প্রধানের এমন অক্ষমতা অযোগ্যতার মূল্য জাতি সবচেয়ে বড় ক্ষতির মাধ্যমেই দিয়েছে।

একটু জেনে রাখা থাক সেসময়ের সেনা প্রধান সম্পর্কে দেশের সর্বোচ্চ আদালত কী বলেছে।

২০০৯ সালে যখন বঙ্গবন্ধু হত্যামামলার রায়ের আপিল শুনানি চলছিলো তখন বিজ্ঞ আদালত পাঁচ বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ সরাসরি এই সাবেক সেনা প্রধানের আচরণকে ‘কাপুরুষোচিত’ বলে মত দেন।

আদালতে আসামি পক্ষেরই আইনজীবী সেদিন যখন নানা তথ্য উপস্থাপন করছিলেন তখন উঠে আসে হত্যাকাণ্ডের সময়ে দায়িত্বে থাকা সেনা প্রধান কে এম শফিউল্লাহর কথা। আইনজীবী আবদুর রেজাক খান তার সাবমিশনে বলছিলেন, “১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সেনাবাহিনীর কেউ আজ কাঠগড়ায়, কেউ সাক্ষী, কেউ বা নীরব দর্শকের ভূমিকায় রয়েছেন। সাক্ষীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ঘটনা জানার পর জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘সো হোয়াট। ভাইস-প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার।’ সেদিন রাষ্ট্রপতি টেলিফোনে তৎকালীন সেনাপ্রধানের সহায়তা চেয়েছিলেন। তখন জবাবে সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ বলেন, ‘আমি কিছু করার চেষ্টা করছি। ক্যান ইউ গেট আউট অব দ্য হাউস?’ ভোর ছয়টার পর শফিউল্লাহ ফোন করে আর বঙ্গবন্ধুকে পাননি। সেনাপ্রধান বঙ্গবন্ধুকে বাসা থেকে বেরিয়ে আসতে বলেছিলেন, তা তামাশা ছাড়া আর কি ?

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন