August 28, 2018 | 5:25 pm
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ‘৭৩৩ দিন পার হয়ে গেছে। কতকিছু হয়ে গেল। কিন্তু এখনও আমি আমার মেয়ে হত্যার বিচার পেলাম না।’ কথাগুলো বলছিলেন রমজান আলী। দুই বছর আগে ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গিয়েছিল তার মেয়ে উইলস লিটল ফ্লাইওয়ার স্কুলের শিক্ষার্থী রিশা। দুই বছরেও মেয়ে হত্যার বিচার না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে রমজান বলেন, ‘এই দুই বছর ধরে আদালতের বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে কত জুতা ক্ষয় করলাম, কত চোখের পানি ঝরেছে। কিন্তু মেয়ে হত্যার বিচার এখনও পেলাম না।’
আর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিশু আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে রিশা হত্যা মামলার কালক্ষেপণ হচ্ছে, মামলা ঝুলে আছে।
২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট দুপুর পৌনে ১২টার দিকে রাজধানীর কাকরাইলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশা (১৫) ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হয়। তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৮ আগস্ট মৃত্যু হয় রিশার।
রিশা হত্যাকাণ্ডে তার মা তানিয়ে হোসনে বাদী হয়ে রমনা থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১৬ সালের শুরুর দিকে ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং কমপ্লেক্সের বৈশাখী টেইলার্সে একটি পোশাক বানাতে দেয় রিশা। ওই টেইলার্সের রশিদে বাসার ঠিকানা ও রিশার মায়ের মোবাইল নম্বর দেওয়া ছিল। সেই রশিদ থেকে মোবাইল নম্বর নিয়ে টেইলার্সের কাটিং মাস্টার ওবায়দুল খান (২৯) রিশাকে ফোনে উত্ত্যক্ত করত। পরে ফোন নম্বরটি বন্ধ করে দিলে ওবায়দুল স্কুলে যাওয়ার পথে রিশাকে উত্ত্যক্ত করতে থাকে। তার প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় রিশাকে ছুরিকাঘাত করা হয়।
রিশার মৃত্যুর পর তার হত্যাকারীর বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামে স্কুলের সহপাঠীরা। ওই সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আশ্বাস দেন, আসামি ওবায়দুলকে দ্রুত আটক করে বিচারের আওতায় আনা হবে। পরে ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর নীলফামারীর ডোমার এলাকা থেকে স্থানীয়দের সহায়তায় পুলিশ ওবায়দুলকে গ্রেফতার করে। ওবায়দুল আদালতে হত্যার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।
আলোচিত এই মামলায় আসামি পক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. কামরুল হোসেন মোল্লা মামলাটি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে ঢাকার শিশু আদালতে বদলির নির্দেশ দেন। বাদী পক্ষের আইনজীবী ও মানবাধিকার কমিশন বলছেন, এ কারণেই মামলাটি ঝুলে গেছে।
রিশা হত্যা মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফাহমিদা আক্তার সারাবাংলা বলেন, ‘মামলাটি প্রথমে ঢাকা মহানগর আদালতে ছিল। কিন্তু মামলাতে রিশার সহপাঠী তিন জন সাক্ষ্য দেয়, যাাদের বয়স ছিল ১৮ বছরের নিচে। আসামি পক্ষ এই সুযোগ নিয়েছে। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটি শিশু আদালতে চলে আসে। আর শিশু আইনের ১৭ (১) ধারার কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে এ মামলার কালক্ষেপণ হচ্ছে, মামলা ঝুলে আছে।’
এই আইনজীবী জানান, বর্তমানে মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। এরপর রয়েছে দুই পক্ষের জেরা। তারপর মামলাটি রায়ের দিকে এগুবে।
জানা যায়, শিশু আইনের ১৭ (১) ধারা অনুযায়ী, কোনো শিশু অপরাধের শিকার হলে আসামি প্রাপ্তবয়স্ক হলেও তার বিচার শিশু আইনে হতে হবে। এই আইনে আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড। এমন কয়েকটি মামলায় প্রাপ্তবয়স্ক আসামিরা হাইকোর্টে জামিন আবেদন করলে শিশু আদালত এসব প্রাপ্তবয়ষ্ক আসামিদের জামিনের আবেদন শুনানির জন্য গ্রহণ করায় হাইকোর্ট রুল জারি করেন এবং সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারকদের এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলেন। ব্যাখ্যায় সংশ্লিষ্ট বিচারকরাও বলেন, শিশু আইনের এই ধারাটি নিয়ে অস্পষ্টতা আছে। বিচার কাজে বিভ্রান্তি তৈরি করা আইনটি সংশোধন করা প্রয়োজন বলে মনে করে সরকারও। সেই অনুযায়ী পরে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ থেকে ভেটিংয়ের পর ‘শিশু (সংশোধন) আইন, ২০১৮’-এর খসড়া মন্ত্রিসভা বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য গত ১৫ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়।
শিশু রিশা হত্যা মামলার বিচারও এই আইনের আওতাতেই হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আসামি ওবায়দুল দোষী প্রমাণিত হলেও তার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে ১০ বছরের কারাদণ্ড।
এই মামলায় কেমন রায় আশা করছেন— জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট ফাহমিদা আক্তার বলেন, শিশু আদালতে সর্বোচ্চ সাজা ১০ বছর। কিন্তু আমরা আদালতে জানিয়েছি, ভিক্টিম রিশা শিশু হলেও হত্যাকারী ওবায়দুল তো প্রাপ্তবয়স্ক। তাই তার ক্ষেত্রে শিশু আদালতের এই সর্বোচ্চ সাজার বিষয়টি প্রযোজ্য হবে না।
তিনি আরও বলেন, আমরা ভালো একটি সাজা আশা করছি, যেন ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে কেউ শিশু আদালতের সুযোগ না নিতে পারে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার আগে যেন অপরাধীরা রিশা হত্যা মামলার সাজার ঘটনা মনে করে ভয়ে পায়।
জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই মামলায় ভিক্টিম শিশু হলেও একমাত্র আসামির বয়স ৩০ বছরের বেশি। সেক্ষেত্রে মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন আদালতে হলে এর নিষ্পত্তি অনেক আগেই হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকত, মামলটি ঝুলে থাকত না।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিশু আইনের সীমাবদ্ধতার সুযোগটাই নিচ্ছে আসামিপক্ষ। তবে আমরা যদি কাগজপত্র সব পাই, তাহলে মামলাটি যেন নারী ও শিশু নির্যাতন আদালতে যেতে পারে সে বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
সারাবাংলা/জেএ/টিআর