বিজ্ঞাপন

টাইগারদের না ভোলার দিন

August 30, 2018 | 2:33 pm

।। মুশফিক পিয়াল, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর ।।

বিজ্ঞাপন

২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট, আশা-নিরাশার দোলাচলে শুরু হয়েছিল টাইগারদের দিনটি। এক বছর আগে এই দিনে যাবতীয় কাজ ফেলে বাংলাদেশের ক্রিকেট পাগলরা চোখ রেখেছিলেন টেলিভিশনের পর্দায়। সাকিব আল হাসানের ব্যাট-বলের অসাধারণ পারফর্ম আর তামিম ইকবালের ইস্পাত কঠিন ব্যাটিং বাংলাদেশকে সেদিন জয়ের ছবি দেখাচ্ছিল। মিরপুর টেস্টের চতুর্থ দিন, প্রতিপক্ষ টেস্ট ক্রিকেটের সবসময়ের অভিজাত সদস্য অস্ট্রেলিয়া।

এক বছর আগের এই দিনে ভর দুপুরে জিতেছিল বাংলাদেশ, ঠা ঠা রোদে মিরপুরের গ্যালারিতে তখন উঠেছিল আনন্দের ঢেউ। প্রেসিডেন্ট বক্সে লাল-সবুজের পতাকা হাতে খুশিতে আত্মহারা হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর মাঠে বুনো উল্লাসে মত্ত ছিলেন মুশফিক-তামিম-সাকিবরা। অস্ট্রেলিয়াকে প্রথমবারের মতো টেস্টে হারিয়ে ঐতিহাসিক জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ।

সাকিব আল হাসান, মেহেদী হাসান মিরাজ ও তাইজুলদের ঘূর্ণির সামনে ২৪৪ রানেই গুটিয়ে যায় অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংস। প্রথম ইনিংসে ২৬০ রান করেছিল বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে ২১৭ রানে অস্ট্রেলিয়াকে গুটিয়ে দেয় টাইগাররা। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ ২২১ রানে অলআউট হয়, তাতে অস্ট্রেলিয়ার সামনে জয়ের লক্ষ্য দাঁড়ায় ২৬৫। শেষ দিকে প্যাট কামিন্সের দুই ছক্কা কাঁপন ধরিয়েছিল সবার মনে। তাইজুল ইসলামের বল অফ স্টাম্পে পড়ে বাঁক খেয়ে জস হ্যাজেলউডের প্যাডে আঘাত হানতেই জোড়ালো আবেদন করেন মুশফিক, তাইজুল, সৌম্য, সাকিব, মোস্তাফিজরা। আঙুল তুলতে ভুল করেননি আম্পায়ার নাইজেল লং। আর মুহূর্তেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট জয়ের উল্লাসে মেতে উঠে পুরো বাংলাদেশ। বাংলাদেশ জয় তুলে নেয় ২০ রানের।

বিজ্ঞাপন

তার আগে ২০০৬ সালে ফতুল্লায় সুযোগ পেয়েও রিকি পন্টিংয়ের দলকে হারাতে পারেনি হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ দল। মুশফিক বাহিনী ঘুচিয়ে দিয়েছিল ফতুল্লার সেই আক্ষেপ। অনেকটা বলে-কয়ে, ঘোষণা দিয়েই অস্ট্রেলিয়াকে পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ পাইয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ। ইংল্যান্ডের পর অস্ট্রেলিয়া-দেশের মাটিতে টানা দুই টেস্টে জয়ের গৌরব অর্জন করে টাইগাররা। ম্যাচের পর অধিনায়ক মুশফিক বলেছিলেন, এই ঐতিহাসিক জয়ই দেশবাসীর জন্য টাইগারদের ঈদের উপহার।

প্রথম ইনিংস:
দশম টেস্ট জয়ে বড় অবদান সাকিব-তামিমের। ক্যারিয়ারের ৫০তম টেস্টে খেলতে নেমেছিলেন দুজনই। প্রথম ইনিংসে ব্যাট হাতে তামিম ১৪৪ বলে খেলেছিলেন ৭১ রানের ইনিংস। আর সাকিব ১৩৩ বলে ১১টি বাউন্ডারিতে করেছিলেন ৮৪ রান। সৌম্য সরকার ৮, ইমরুল কায়েস ০ এবং সাব্বির রহমান ০ রানে সাজঘরে ফেরেন। মুশফিক ১৮, মিরাজ ১৮, নাসির ২৩, শফিউল ১৩ রান করেন। অস্ট্রেলিয়ার স্পিনার নাথান লায়ন তিনটি, পেসার প্যাট কামিন্স তিনটি আর অ্যাস্টন অ্যাগার তিনটি করে উইকেট তুলে নেন। একটি উইকেট পেয়েছিলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। নিজেদের প্রথম ইনিংসে ডেভিড ওয়ার্নার ৮, ম্যাট রেনশ ৪৫, উসমান খাজা ১, স্টিভেন স্মিথ ৮, পিটার হ্যান্ডসকম্ব ৩৩, ম্যাক্সওয়েল ২৩, ম্যাথু ওয়েড ৫, অ্যাগার ৪১, কামিন্স ২৫ রান করেন। বল হাতেও দুর্দান্ত ছিলেন সাকিব। শফিউল-নাসির-মোস্তাফিজরা উইকেট না পেলেও সাকিবের ঘূর্ণিতে দিশেহারা হয়ে উঠে অজিরা। সাকিব ২৫.৫ ওভারে ৬৮ রান খরচায় তুলে নেন ৫টি উইকেট। মিরাজ তিনটি আর তাইজুল একটি করে উইকেট পান।

বিজ্ঞাপন

দ্বিতীয় ইনিংস:
এগিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমে তামিম ১৫৫ বলে করেন ৭৮ রান। সৌম্য সরকার ১৫, ইমরুল ২, সাকিব ৫, সাব্বির ২২, নাসির ০, নাইট-ওয়াচম্যান তাইজুল ৪ রান করে বিদায় নেন। মুশফিক ৪১ আর মিরাজ ২৬ রান করেন। প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয় ইনিংসেও উইকেটশূন্য থাকেন জস হ্যাজেলউড। ৬টি উইকেট নেন স্পিনার লায়ন। এছাড়া, অ্যাগার দুটি আর কামিন্স একটি করে উইকেট তুলে নেন। ২৬৫ রানের টার্গেটে ব্যাটিং করতে নেমে অজি ওপেনার ওয়ার্নার ১১২ রান করেন। স্মিথ ৩৭, হ্যান্ডসকম্ব ১৫, ম্যাক্সওয়েল ১৪, কামিন্স অপরাজিত ৩৩, লায়ন ১২ রান করলেন উসমান খাজা, ম্যাট রেনশ, ম্যাথু ওয়েড, অ্যাগার আর হ্যাজেলউড দুই অঙ্কের দেখা পাননি। সাকিব ২৮ ওভারে ৮৫ রান দিয়ে পান আরও ৫টি উইকেট। মিরাজ দুটি আর তাইজুল তিনটি উইকেট তুলে নেন। মোস্তাফিজ ১ ওভার বল করলেও কোনো উইকেট পাননি। দুই ইনিংসে ১০টি উইকেট আর ব্যাট হাতে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রান করা সাকিব ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার জেতেন।

টেস্টে দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছানো:
টেস্টে সেটা ছিল বাংলাদেশের দশম জয়। তার আগে জিম্বাবুয়ে,ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা আর ইংলান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জিতেছিল বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়েকে পাঁচবার ও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দুবার, শ্রীলঙ্কা ও ইংল্যান্ডকে একবার করে হারায় বাংলাদেশ। তবে টেস্ট ইতিহাসে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো সেটাই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাফল্য।

বিশ্ব গণমাধ্যমে টাইগাররা:
মুশফিক বাহিনীর এমন জয়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে বড় অক্ষরে শিরোনামে এসেছিল বাংলাদেশের নাম। ক্রিকেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় পোর্টাল ইএসপিএন ক্রিকইনফো শিরোনাম করেছিল, সাকিবের অসাধারণ পারফরম্যান্সে বাংলাদেশ ইতিহাস তৈরি করলো। আরেক ক্রিকেট পোর্টাল ক্রিকবাজ শিরোনামে লেখে, ঐতিহাসিক জয়ের রেকর্ডে বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের নিজস্ব ওয়েবসাইট ক্রিকেট ডট কম ডট এইউ লিখেছিল, প্রথমবারের মতো অজিদের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয় তুলে নিলো বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ারই আরেক পোর্টাল ফক্স স্পোর্টস শিরোনাম করেছিল, ইতিহাস তৈরি হলো! বাংলাদেশের কাছে অঘটনের শিকার অস্ট্রেলিয়া। একই দেশের নামকরা পত্রিকা সিডনি মর্নিং হেরাল্ড লিখেছিল, ইতিহাস হলো যেখানে বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট হারলো অস্ট্রেলিয়া। প্রতিবেশি দেশ ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস লেখে, অস্ট্রেলিয়াকে ২০ রানে হারালো বাংলাদেশ। একই দেশের ইন্ডিয়া টুডে ইন লিখেছিল, সাকিব আল হাসানের স্পিনে প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয় পেলো বাংলাদেশ। এনডিটিভি শিরোনাম করেছিল, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয় তুলে নিলো বাংলাদেশ।

বিজ্ঞাপন

কলকাতার আনন্দবাজার লিখেছিল, ক্রিকেটে আবার ব্যাঘ্র গর্জন, সাকিবদের হাতে অস্ট্রেলিয়া বধ। এই সময় লিখেছিল, সাকিবের স্পিনে দুরমুশ অজি দর্প, ইতিহাস লিখল বাংলাদেশ। ইংল্যান্ডের নামি সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান শিরোনাম করেছিল, বাংলাদেশ ঐতিহাসিক জয় তুলে নিলো যেখানে আত্মসমর্পণ করলো অস্ট্রেলিয়া। একই দেশের ডেইলি মেইল শিরোনাম করে, সাকিবের ১০ উইকেটে বিখ্যাত জয় পেলো বাংলাদেশ। আর দক্ষিণ আফ্রিকার পোর্টাল সুপারস্পোর্টস শিরোনাম করেছিল, প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়াকে হারালো টাইগাররা।

অপমানের জবাব দেওয়ার সুযোগ:
২০০৬ সালের পর দীর্ঘ ১১ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকে বাংলাদেশে আনতে। ২০১৫ সালে এই টেস্ট খেলার কথা ছিল অস্ট্রেলিয়ার। কিন্তু, অহেতুক নিরাপত্তা ইস্যুতে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশে আসতে রাজি হয়নি। সেই সিরিজ হয় ২০১৭ সালে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আরেকবার টেস্ট খেলার সুযোগ পায় বাংলাদেশ। মিরপুর টেস্ট শুরু হওয়ার আগে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি খেলোয়াড়ই ছিল রোমাঞ্চিত। ছিল বাংলাদেশে এসে খেলতে না চাওয়ার অপমানের জবাব দেওয়ার সুযোগ। আর সুযোগটা ভালোই কাজে লাগিয়েছে টাইগাররা।

প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন:
মিরপুর টেস্টের চতুর্থ দিন বাংলাদেশের খেলা দেখতে শেরে বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ম্যাচের ৭০তম ওভারের সময় তিনি তার জন্য নির্ধারিত বক্সে ঢোকেন। তাইজুল ইসলামের বলে জস হ্যাজলউড এলবিডাব্লিউ হওয়ার সঙ্গে পুরো মাঠের সঙ্গে আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন প্রধানমন্ত্রীও। বাংলাদেশের পতাকা হাতে উড়িয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন তিনি।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস: ২৬০/১০
অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংস: ২১৭/১০
বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংস: ২২১/১০
অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় ইনিংস: ২৪৪/১০
ফল: বাংলাদেশ ২০ রানে জয়ী
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: সাকিব আল হাসান

সারাবাংলা/এমআরপি

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন