বিজ্ঞাপন

দুই দশকেও যার মৃত্যুকে সহজভাবে নিতে পারেনি ভক্তরা

August 31, 2018 | 5:24 pm

।। আন্তর্জাতিক ডেস্ক ।।

বিজ্ঞাপন

সংক্ষিপ্ত জীবন ক্যানভাসে তার মতো রং তুলিতে নিজেকে আঁকতে পেরেছেন খুব কম সৌভাগ্যবান মানুষ।পরিচয়ে ক্ষণজন্মা রাজবধূ। প্রাসাদসম দূরত্বে থেকেও অর্জন করেছেন সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। বিশ্বব্যাপী সেলিব্রেটির তকমা একটুও তার উদারতা ম্লান করতে পারেনি। সদাহাস্য মুখ, বাগ্মিতা, স্বাধীন ব্যক্তিত্ব, সুনিপুণ রুচিবোধ, ফ্যাশন কিংবা সৌন্দর্য জ্ঞান অথবা মমতাময়ী মায়ের ভূমিকা; চরিত্রের কোনো একটি দিকও তার অসম্পূর্ণ ছিলো না।

আদর করে তাকে ডাকা হতো ‘কুইন অব দ্য হার্ট’ অর্থাৎ বৃটেনবাসীর হৃদয়ের রানি! তাই অসময়ে হারিয়ে ফেলার দুই দশক পরও ‘প্রিন্সেস ডায়না’ নামটি চির অপরিচিতের কাছেও যেন খুব আপন শোনায়।

বিজ্ঞাপন

পরিচয়: তার পুরো নাম ডায়না ফ্রান্সিস স্পেনসার। ১ জুলাই ১৯৬১ সালে জন্ম। বাবা জন স্পেন্সার এবং মা ফ্রান্সিস শান্দ কইদ।

স্পেন্সাররা বংশ পরম্পরায় ব্রিটিশ রাজপরিবারের রয়েল নেভিসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে এসেছে। তার বাবা ১৯৭৫ সালে আর্ল স্পেন্সার উপাধি পেলে তিনি ‘লেডি ডায়না স্পেন্সার’নামে পরিচিত হন।

বিজ্ঞাপন

প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে পরিচয়: ডায়না ও প্রিন্স চার্লসের প্রথম দেখা হয় ১৯৭৭ সালে। চার্লস তখন ২৯ বছর বয়সী যুবক আর ডায়না ১৬ বছরের কিশোরী। মজার ব্যাপার হলো, ডায়নার বড় বোন লেডি সারার সাথে প্রিন্স চার্লসের সখ্যতা ছিলো। সে সূত্রেই তাদের পরিচয়। ঘটনাক্রমে, ডায়নার প্রতি প্রিন্স চার্লস অনুরক্ত হয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্কও রুপ নেয় প্রণয়ে।

গণমাধ্যমগুলোও সংবাদ প্রচার করতে থাকে ডায়না আর প্রিন্স চার্লসকে জড়িয়ে। ১৯৮০ সালে প্রিন্স চার্লসের আমন্ত্রণে ডায়না যখন বালমোরাল প্রাসাদে সপ্তাহখানেক ঘুরতে আসেন তখন এ গুঞ্জন আরও জোরালো হয়।

এর কয়েক মাস পরেই ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ সালে বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে তাদের বাগদানের কথা ঘোষণা করা হয়। বহু নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানো প্রিন্স চার্লস এবার ডায়নাকে বিয়ে করে থিতু হচ্ছেন বলেই সবাই তাকে বাহাবা দিতে থাকে।

বিজ্ঞাপন

ডায়না ও প্রিন্স চার্লসের বিয়ে: ডায়নার বিশতম জন্মদিনের তিনসপ্তাহ পরে লন্ডনের সেন্ট পল ক্যাথিড্রালে চার্লস ও ডায়নার বিয়ে সম্পন্ন হয়। রুপকথার সেই দিনটি ছিল ২৯ জুলাই ১৯৮১ সাল। রাজকীয় এই বিয়ে বিশ্বের ৭৫০ মিলিয়ন লোক টিভির পর্দায় দেখেছিলেন।

ডায়নার বিয়ের পোশাকটি ছিলো বিয়েতে নতুন সংযোজন। নীল চোখের এই রমণীকে ব্রিটিশরা রাজ পুত্রবধূ হিসেবে বরণ করে নিল। ডায়না ও চার্লসের দেখা হবার প্রায় সাড়ে তিন বছর পর তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

ডায়নার রাজকীয় দায়িত্ব পালন ও মানবসেবা: ‘হার রয়েল হাইনেস দি প্রিন্সেস অফ ওয়েলস’ হিসেবে ডায়না রানির ইচ্ছা অনুযায়ী বিশ্বে বিভিন্ন দেশে রাজকীয় অনুষ্ঠানে অংশ নেন ও দ্রুত পরিচিতি লাভ করেন। একইসঙ্গে, মানবদরদী ডায়না বিভিন্ন দেশে দাতব্য কাজ পরিচালনা করতে থাকেন। এইডস রোগ, বাচ্চাদের লিউকোমিয়া, বৃদ্ধ পুনর্বাসনসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার জোরালো বক্তব্য রয়েছে। এমনকি ভূমি মাইন নিরোধ নিয়েও তিনি পালন করেছেন বিভিন্ন কর্মসূচি।

সন্তান প্রিন্স উইলিয়াম ও হ্যারির জন্ম: ১৯৮১ সালের ৫ নভেম্বর রাজপরিবারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় প্রিন্সেস ডায়না সন্তান জন্ম দিতে চলেছেন। ১৯৮২ সালের ২১জুন জন্মগ্রহণ করেন প্রিন্স উলিয়াম আর্থার লুইস। ১৯৮৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জন্ম নেন হেনরি চার্লস আলবার্ট ডেভিড। তিনি প্রিন্স হ্যারি নামে সমধিক পরিচিত।

ডায়না ছিলেন একজন আদর্শ মা। সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া, একসঙ্গে শপিং করা, কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাওয়া সব রকমের দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন মা হিসেবে।

ডায়না ও চার্লসের সম্পর্কের পতন: বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছিলো তাদের দাম্পত্য জীবনের টানাপোড়েনের কথা। তবে ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী জন মেজর প্রথম প্রকাশ্যে হাউজ অব কমেন্সে মন্তব্য করেন, ডায়না ও প্রিন্স চার্লস বন্ধুত্বপূর্ণ বিচ্ছেদ বেছে নিচ্ছেন। এ সময় ডায়না রাজকীয় জনসামগম থেকে নিজেকে আড়াল করতে থাকেন।

শীতল সম্পর্কের দুবছর পর ১৯৯৫ সালের নভেম্বরে ডায়না ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন। এ সময় তিনি ইঙ্গিত করেন প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে তার সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার জন্য চার্লসের এক সাবেক প্রেমিকা, ক্যামেলিয়া পার্কার দায়ী। এমনকি ডায়না রাজকীয় দায়িত্ব পালনে প্রিন্স চার্লসের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন।

ডায়না বলেন, ১৯৯২ সালে ভারত ভ্রমণে তিনি তাজমহলের সামনে একা বসে ছবি তুলেছিলেন। যদিও প্রিন্স চার্লসও ভ্রমণে তার সঙ্গে ছিলেন। এটি অনেক কিছু ইঙ্গিত করে।

এ বিষয়ে একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হবার একমাসের মধ্যে ডিসেম্বরের ২০ তারিখ, রানি এলিজাবেথ তার সন্তান প্রিন্স চার্লস ও ডায়নাকে চিঠি পাঠিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্ক বিচ্ছেদের পরামর্শ দেন।

সম্পর্কের তিক্ততা থেকে ১৯৯৬ সালের ২৮ আগস্ট তাদের বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে শেষ হয় সম্পর্কের। তবে তখনও ‘প্রিন্সেস অব ওয়েলস’ উপাধিটি তার জন্য বজায় থাকে।

মার্সিডিজ এস-২৮০ বিপর্যয়: ১৯৯৭ সালের ৩১ অগাস্ট ফ্রান্সের প্যারিসের একটি টানেলে মর্মান্তিক গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হলে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই মৃত্যু হয় প্রিন্সেস ডায়নার। দুর্ঘটনায় তার ছেলেবন্ধু (বয়ফ্রেন্ড) দোদি-আল ফাহাদ ও গাড়ির চালক হেনরি পলের মৃত্যু ঘটে। একমাত্র প্রাণে বেঁচে যান তার দেহরক্ষী ট্রেভর রি-জোনস।

দুর্ঘটনার অনুসন্ধান: দীর্ঘদিন ধরে তথ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ ও ২৫০ জন স্বাক্ষীর দেওয়া স্বাক্ষ্য পর্যালোচনা করে বিচারকরা এই মৃত্যুর জন্য মদ্যপ চালকের অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালনোকে দায়ী করেন। সেই সঙ্গে দায়ী করা হয় ডায়নার ছবি তুলতে আসা পাপারাজ্জিদেরও। তাদের ফাঁকি দিতেই চালক বেশি গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। প্রিন্সেস ডায়নাকে বলা হতো পৃথিবীর সবচাইতে বেশি ক্যামেরায় চিত্রিত নারী।

বিচারকরা আরও বলেন, সিটবেল্ট পরা থাকলে দোদি আর ডায়না হয় তো বেঁচে যেতে পারতেন।

ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও রাজপরিবারের প্রতিক্রিয়া: অনেকে মনে করে থাকেন ব্রিটিশ রাজপরিবার ডায়নার গাড়ি দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা ‘এমসিক্সটিন’ দিয়ে এই হত্যা মিশন চালানো হয় রাজপরিবারকে কলঙ্কমুক্ত করতে।

ডায়নার মৃত্যুর পর রানি এলিজাবেথ ব্রিটেনের জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হন। তিনি ওই সময় তার চলমান স্কটল্যান্ড ভ্রমণ থেকে খুব দ্রুত ফেরেননি। এ ছাড়া, প্রিন্স চার্লসও খুব নির্লিপ্তভাবে মায়ের মৃত্যুর খবর তার সন্তানদের কাছে পৌঁছে দেন। ব্রিটিশরা এসব বিষয় খুব ভালোভাবে নেয়নি। ডায়নার মৃত্যুর পর শুধুমাত্র রীতিনীতি অনুযায়ী রাজকীয় কিছু আচার পালন করা হয়।

কতটা কষ্ট পেয়েছেন ব্রিটেনবাসী? ডায়নার অস্বাভাবিক মৃত্যুকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি ব্রিটিশরা। কেনিংস্টন প্রাসাদের বাইরে ডায়নার জন্য ব্রিটিশদের ভালোবাসা ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়। ডায়নাকে নিয়ে আজও কথা হয়, আলোচনা হয়। মৃত্যুর এত বছর পর, প্রিন্সেস ডায়না এখনও বেশ প্রাসঙ্গিক।

অন্ত্যোষ্টক্রিয়া ও সমাধি: ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবেতে ১৯৯৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর প্রিন্সেস ডায়নার অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়। বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠানটি টিভির পর্দায় ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন লোক সরাসরি দেখে।

মায়ের শেষ বিদায়বেলা, উইলিয়াম ও হ্যারি কফিনের পেছনে পেছনে হাঁটছিলেন। এল্টন জন ডায়নাকে উৎসর্গ করে ক্যান্ডেল গানটি গেয়ে শোনান।

অতঃপর নর্থ হ্যাম্পাশয়ারের পরিবারের সমাধিস্থল অলথ্রপ এস্টেটে প্রিন্সেস ডায়নাকে চিরদিনের জন্য সমাহিত করা হয়।

তথ্যসূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ

সারাবাংলা/এনএইচ

আরও পড়ুন:
বন্ধুর সঙ্গে ডায়ানার শেষ কথোপকথন

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন