বিজ্ঞাপন

বছরে ১৫ হাজার শিশুর মৃত্যু পানিতে ডুবে

September 5, 2018 | 9:00 am

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা : গত ২ সেপ্টেম্বর আশুলিয়ার বংশী নদীতে গোসলে নেমে সোহাগ খন্দকার ও মাসুদ হোসেন নামের দুই শিক্ষার্থী মারা যায়। সোহাগ স্থানীয় একটি স্কুলে ৭ম এবং মাসুদ ২য় শ্রেণির ছাত্র। এছাড়া গত ২ আগস্ট কুমিল্লার ধর্মসাগরে গোসল করতে নেমে মারা যায় দুই শিক্ষার্থী সিহাব ও ফাহিম। ২২ জুলাই চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে পুকুরের পানিতে ডুবে ৪ বছরের আকিব পাটওয়ারী ও ৫ বছরের তানিশা আক্তার নামে দুই শিশুর মৃত্যু হয়।

কেবল এই ৬ জনই নয়, প্রতিনিয়তই শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, দেশে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা। প্রতিবছর পানিতে ডুবে প্রায় ১৫ হাজার শিশু মারা যাচ্ছে, যা কিনা শিশু মৃত্যুর ৪৩ শতাংশ। দেশে প্রতিদিন গড়ে ৪০টি শিশু পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে বলেও জানান তারা।

দুই বছর আগে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি), সেভিং লাইভস ফ্রম ড্রনিং প্রজেক্ট (সলিড) ইন বাংলাদেশ, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এবং যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় এসব তথ্য পাওয়া যায়। প্রায় দুই বছর ধরে বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু নিয়ে গবেষণা করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

বিজ্ঞাপন

সিআইপিআরবির গবেষণা থেকে জানা যায়, এক লাখ আট হাজার মানুষের ওপর তারা গবেষণাটি পরিচালনা করে, যেখানে শিশু ছিল (১৮ বছরের নিচে) প্রায় ৩৯ হাজার। সেখানে দেখা যায় আত্মহত্যা, সড়ক দুর্ঘটনা, পানিতে ডুবে মৃত্যু এবং পড়ে যাওয়া-এই চারটি হচ্ছে শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ। তবে এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে পানিতে ডুবে মৃত্যু। প্রতিদিন প্রায় ৪০টি শিশু পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, “সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যায়। তাই এ সময়টাতে বড়দের উচিত শিশুদের প্রতি নজর রাখা। আবার পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ‘শহুরে ঘটনা’ না হওয়াতে নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টিগোচর হয় না। যার কারণে বাল্য বিয়ে বা শিশু শ্রমের বিষয়টি যেভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে সেভাবে পানিতে ডুবে মৃত্যুর বিষয়টিকে জাতীয়ভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। কিন্তু বিষয়টি সেভাবে চিহ্নিত করে প্রতিরোধের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”

বিজ্ঞাপন

সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) পরিচালক (অপারেশনস) সেলিম মাহমুদ চৌধুরী সারাবাংলাকে জানান, ২০১৬ সালে প্রতিদিন ৪০টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। আর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ১৪ শিশু, আত্মহত্যা করে ২৬টি শিশু।

এর মধ্যে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনায় এক বছরের নিচের শিশুদের হার ৫৩.৩ শতাংশ, এক থেকে চার বছর বয়সীদের ৭১.৭ শতাংশ। এছাড়া পাঁচ থেকে নয় বছর বয়সী ২৮.১ শতাংশ, ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী ৩.২ শতাংশ, ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৫.৬ শতাংশ শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে, বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘এক থেকে চার অর্থ্যাৎ পাঁচ বছরের কম বয়সী বাচ্চারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।’ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুরা হাঁটা শিখেই চারপাশে যেতে শুরু করে। মফস্বলে গ্রামে সেসময় শিশুদের দেখে রাখার কেউ থাকে না। বাড়ির পুরুষরা কাজে চলে যায়, নারীরা ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকে আর বড় ভাইবোন যারা থাকে তারা স্কুলে চলে যায়। এসময়টাতেই বাড়ির পাশে পুকুরে পড়ে শিশুর মৃত্যু হয়।’

‘এরপরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা স্কুলসহ অন্যান্য নিয়মিত কাজ বাড়তে থাকে, যার কারণে ক্রমান্বয়ে পানিতে পড়ে শিশুমৃত্যুর হারও কমতে শুরু করে। তাই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সময়টাতে বড়দের সজাগ থাকতে হবে, শিশুদের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে, নয়তো পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধ করা যাবে না’, যোগ করেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

সেভিং লাইভস ফ্রম ড্রনিং প্রজেক্ট (সলিড) ইন বাংলাদেশ পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে ২০১২ সাল থেকে। সলিডের পরিচালক ড. ইরতেজা ইসলাম সারাবাংলাকে জানান, ‘শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, কুমিল্লা, নরসিংদী ও চাঁদপুর জেলার সাতটি উপজেলায় পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু কমাতে তারা দিবাযত্ন কেন্দ্র করেছেন, যার নাম তারা দিয়েছেন আঁচল। এসব কেন্দ্রগুলোতে একজন নারী যার নাম দিয়েছেন তারা আঁচল মা- তিনি সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত এক থেকে চার বছর বয়সী শিশুদের নিরাপত্তার জন্য থাকেন।

ড. ইরতেজা ইসলাম বলেন, ‘আঁচলের মতো এই কার্যক্রম গ্রহণ করে এই বয়সী শিশুদের মৃত্যু রোধ করা সম্ভব।’

শিশুদের নিয়ে নানা বিষয়ে কাজ করে বছরে একবার করে প্রতিবেদন দেয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। সেখানেও পানিতে ডুবে মৃত্যুর বিষয়টি উঠে এসেছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কর্মসূচি সমন্বয়কারী আব্দুল্লাহ আল মামুন সারাবাংলাকে বলেন, “২০১৭ সালে পানিতে ডুবে ৪০৯টি এবং ২০১৬ সালে ২৯৮টি শিশুর মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে পাওয়া গেছে। কিন্তু বিষয়টি একেবারেই একটি ‘আন অ্যাড্রেসড ইস্যু’- যেটাকে কেউ নজরদারি করছে না।”

‘সাধারণত পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু ঘটনাগুলো ঘটছে গ্রামীণ এলাকাতে এবং এটা শহুরে সমস্যা নয়। যার কারণে নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না’, বলে মন্তব্য করেন আব্দুল্লাহ আল মামুন।

তিনি বলেন, “নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টিগোচর না হওয়াতে বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে না। কিন্তু জাতীয়ভাবে বাল্য বিয়ে বা শিশু শ্রমের বিষয়টি যেভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে ঠিক সেভাবেই পানিতে ডুবে মৃত্যুর বিষয়টিকে জাতীয়ভাবে চিহ্নিত করতে হবে। এর জন্য যা যা করতে হবে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তার জন্য গ্রামীণ পর্যায়ে শিশুদের জন্য সাঁতার শেখার ব্যবস্থা করতে হবে এবং ৪ বছরের কম বয়সী শিশুরা যেন ‘আন-অ্যাটেন্ডেন্ট’ না থাকে সে ব্যবস্থা পরিবারগুলোতে নিশ্চিত করতে হবে।”

আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘শিশু মৃত্যুরোধে যদি টিকাদান কর্মসূচি সাফল্য পেতে পারে তবে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ক্ষেত্রে কেন সেরকম কর্মসূচি কেন করা যাবে না প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘কোনও অবস্থাতেই যেন এসব শিশুরা একা একা না থাকে সে চর্চা বা সচেতনতা তৈরি করতে হবে।’

সারাবাংলা/জেএ/এমও

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন