বিজ্ঞাপন

শহরে যৌন হয়রানির নতুন ধরণ- প্রতিরোধ করবে কে?

September 6, 2018 | 9:10 am

তিথি চক্রবর্তী।।

বিজ্ঞাপন

তানজিম নাঈমাহ সন্ধ্যাবেলা টিউশনিতে যাচ্ছিলেন। রাস্তা পার হওয়ার সময় একটি ছেলে তাকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। কোন রকম নিজেকে সামলে নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার পর ছেলেটিকে ধরতে পেছন পেছন দৌঁড়ায় নাঈমাহ। ছেলেটি একটি ফুটওভারব্রীজে ওঠে গেলে কিছু লোকজন মোবাইল চোর ভেবে ছেলেটিকে ধরে ফেলে। নাঈমাহ লোকগুলোকে জানান ছেলেটি তার গায়ে হাত দিয়েছিল। ‘নারীর গায়ে হাত দেওয়া তো কোন ব্যাপার না, মোবাইল চুরি করলে ব্যাপারটা গুরুতর ঘটনা হত’- এটাই ছিল লোকগুলোর মনোভাব। এই পরিস্থিতিতে ছেলেটি যেন পালাতে না পারে এজন্য ওর ব্যাগে থাকা পিপার স্প্রে দেয় ছেলেটির চোখে স্প্রে করে নাঈমাহ। বিদেশে নারীরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ইদানিং পিপার স্প্রে ব্যাগে রাখছেন। নাঈমাহ’র মামা বিদেশ থেকে তেমনি একটি স্প্রে এনে দিয়েছিলেন ভাগ্নিকে।

যাই হোক, এরপর ঘটনা গুরুতর হয়ে ওঠে। লোকগুলো নাঈমাহকে মলম পার্টির সদস্য বলে মনে করে এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ, ওড়না আর ব্যাগ ধরে টানাটানি করে। মূল অপরাধী চলে যায় আড়ালে, তার শাস্তি তো হয়ইনি বরং নাঈমাহকে মলম পার্টির সদস্য সন্দেহ করে থানায় নিয়ে হাজতে রাখে পুলিশ।

সেদিনের দুঃসহ স্মৃতিচারণ করে নাঈমাহ বলেন, প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমি দোষী হলাম। ছেলেটিকে না ধরে আমিও অন্যদের মত নীরবে চলে যেতে পারতাম। অনেক মেয়েই প্রতিবাদ করে না। কিন্তু আমার মনে হয়েছে প্রতিবাদের সংস্কৃতি গড়ে ওঠা দরকার। যদি যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই প্রতিবাদ হত তাহলে অপরাধীরা এতটা সাহস পেত না।

বিজ্ঞাপন

 

বাংলাদেশে এমন নারী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যে কখনও কোনদিন যৌন হয়রানির শিকার হয়নি। ফেস টু ফেস, ভার্চুয়াল কিংবা পরিচিত অপরিচিতদের কাছ থেকে নোংরা কথার মাধ্যমে নারী টিজিংয়ের শিকার হয়ে থাকে। আগে ইভটিজাররা নোংরা কথা বলত, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, অশ্লীল গান গাইত কিংবা পাবলিক যানবাহনে, মার্কেটের ভিড়ে গায়ে হাত দিত। কিন্তু এখন যৌন হয়রানির ধরন পাল্টেছে। এখন গোপনে মেয়েদের জামা ব্লেড দিয়ে কেটে দেয়া, গায়ে মরিচের পানি ও পানের পিক ছুঁড়ে মারার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানারকম হয়রানির শিকার হন বেশিরভাগ নারী।

বিজ্ঞাপন

ফারজানা রিতু (ছদ্মনাম) পেশায় একজন আইনজীবী। একদিন ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিলেন। এ সময় তার সালোয়ার লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারা হয় মরিচ গোলানো পানি। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন কেউ হয়ত পানের পিক দিয়েছে। কিন্তু শরীরে ভীষণ জ্বালা অনুভব করার পর বুঝতে পারেন মরিচের পানি দেওয়া হয়েছে।

 

এ দেশে পাবলিক বাসে চলাচল করতে গিয়েও ইদানিং নানা বাজে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় মেয়েদের। বাসে পুরুষযাত্রীরা গায়ে হাত দেয়। বাসে ওঠার সময় বাসের কন্ডাক্টরও নানা উছিলায় মেয়েদের শরীরে হাত দেয়।

বিজ্ঞাপন

ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট্রের একটি বেসরকারি সংস্থার করা সাম্প্রতিক একটি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পাবলিক বাসে চলাচলকারী ৪১ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির ‍শিকার হন। দুর্ভোগ, যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের আশঙ্কায় পাবলিক বাস এড়িয়ে চলেন ১৩ শতাংশ নারী। এখন মাত্র ২০.৭ শতাংশ নারী পাবলিক বাসে যাতায়াত করে। ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপ অনুযায়ী, গণপরিবহনে যাতায়াত করে এমন ৯৪ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার।

শামসুন্নাহার (ছদ্মনাম) একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে পাবলিক বাসে ওঠেন। তার পেছনের সিটে বসে ছিলেন একজন পুরুষ। এই পুরুষটি ব্লেড দিয়ে তার জামা কেটে দেয়।  প্রথমে তিনি বুঝতে পারেননি। কিন্তু তারপর যখন সালোয়ার কাটতে শুরু করে তখন ব্লেডের খোঁচা লাগে শরীরে। সেই জায়গায় হাত দিয়ে দেখেন জামা কাটা। সালোয়ারও কিছুটা কাটা হয়েছে। তিনি বুঝতে পারেন পেছনে বসে থাকা পুরুষটাই এই কাজ করেছে। তিনি চিৎকার করেন এবং  বাসের অন্য যাত্রীদের বিষয়টি জানান। কিন্তু অবাক ব্যাপার হল, এত বড় ঘটনা জেনেও বাসের কোন যাত্রী তাকে সহযোগিতা করেনি। শুনেও না শোনার ভান করেছে সবাই।

আইনে ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীর প্রতি নিপীড়ন রোধে শাস্তির বিধান থাকলেও সমাজ মানসে অপরাধকে হালকা করা হয়। অল্প কিছু নারী যখন নিপীড়নের প্রতিবাদ করে তখন তাকেই শুনতে হয় নানা গঞ্জনা। তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এমনকি নিপীড়িত নারীর সম্মানহানি, যা হওয়ার হয়ে গেছে ধরে নিয়ে অন্য নিপীড়কের কাছে সে সহজলভ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। যা পরে ঘটেছে নাঈমাহর জীবনে। তাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বন্ধুমহল, আত্মীয়মহল ও পরিবারে নানাভাবে গঞ্জনা সইতে হয়েছে।

নিপীড়ন ঘটার পর সমাজ যখন নিপীড়িতকেই দোষ দেয় তখন নিপীড়ন পূর্ণাঙ্গ হয়। আরও বিপত্তি হবে জেনেও যে মেয়েরা প্রতিবাদ করে তাদেরকে সম্মান দিতে পারে না আমাদের সমাজ। উল্টো তার শ্লীলতা বা সম্মান খর্ব হয়েছে বলে লেবেল দেওয়া হয়। ফলে সাহসের সাথে রুখে দাঁড়ানোর সাহস পায়না অনেকে।

ডিএমপি অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) শেখ নাজমুল আলম বলেন, যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাবলিক বাস ও ফুটওভারব্রীজে হয়। অনেক সময় স্কুল, কলেজের সামনেও এ ধরনের ঘটনার অভিযোগ পাওয়া যায়। যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে হাইকোর্ট থেকে মামলার নির্দেশনা দেওয়া হয়। কোন অভিযোগ দিলে সেটি আইনের আওতায় এনে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হয়।

এ ধরণের হয়রানি নারীর মননে কি ধরনের প্রভাব ফেলে জানতে চাইলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সালাউদ্দিন কাওসার বিপ্লব বলেন, এগুলো এক ধরনের তীব্র মানসিক চাপ তৈরি করে। ভুক্তভোগীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে অনেক সময় লাগে। মনের মধ্যে সবসময় আতঙ্ক থাকে। ফলে নিজের প্রতি বিশ্বাস হারায় অনেকে। মানুষের যৌন চাহিদার মধ্যেও শৃঙ্খলা থাকা উচিত। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার শিক্ষা প্রত্যেকের থাকা দরকার।

যৌন হয়রানির বিকৃত রূপটি সমাজে আসার মূল কারণ কি জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন্স এন্ড জেন্ডার স্ট্যাডিজ বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ড. সোমা দে বলেন,

যৌন হয়রানি আগেও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু ধরনগুলো পাল্টে যাচ্ছে। একেকসময় একেকভাবে মেয়েরা যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আসছে। ছেলেদের বিকৃত মন ও রুচি যৌন হয়রানির মূল কারণ। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা যৌন হয়রানিকে আরও উস্কে দিচ্ছে, যার উদ্দেশ্য নারীকে অবদমন করা। এখন প্রযুক্তিগতভাবে নারী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে বেশি। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের অভাবে পর্ণ ওয়েব সাইটগুলোতে সহজেই ঢুকতে পারছে সবাই। ফলে অধিকাংশ ছেলেরা মেয়েদের সম্মানের চোখে দেখতে পারে না। এভাবে সমাজে একটি ধারনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, সহজেই মেয়েদের হেনস্তা করা ও পণ্য মনে করা যায়। যৌন হয়রানির আরেকটি কারণ হলো এদেশে সঠিকভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে আইন অনেক দুর্বল। ফলে এই অপরাধগুলোকে ছোট করে দেখা হয়।

সোমা দে আরও বলেন, সতীত্ব সম্পর্কে মেয়েদের মনে যে বদ্ধমূল ধারনা আছে সেখান থেকে তাদের বের হয়ে আসতে হবে। যৌন হয়রানির শিকার হলে মেয়েরা কুঁকড়ে যায়, বাইরে যেতে ইতস্ততা বোধ করে। নির্যাতিত হলেই একটি মেয়ের পুরো জীবন শেষ হয়ে যায় না। তাই প্রতিটি মেয়েকে সাহস নিয়ে দাঁড়াতে হবে ও নিজের প্রতি বিশ্বাস বাড়াতে হবে।

মানুষ জীবনের প্রথম শিক্ষা লাভ করে পরিবারের কাছ থেকে। এজন্য পরিবারে ছোটবেলা থেকে ছেলে ও মেয়েকে সমান সুযোগ দিয়ে বড় করতে হয়। যারা অবদমিত মন নিয়ে বড় হয় তাদের মধ্যেই বিকৃত রুচি গড়ে ওঠে। তারাই মেয়েকে ‘মেয়ে’ হিসেবে দেখে, মানুষ হিসেবে দেখতে পারে না।

 

 

ফিচারে ব্যবহৃত ছবিসূত্র – ইন্টারনেট 

সারাবাংলা/টিসি/ এসএস

 

 

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন