বিজ্ঞাপন

সড়কের আইন মানা না মানার বাস্তবতা

September 8, 2018 | 12:32 pm

রেজানুর রহমান ।।

বিজ্ঞাপন

মাত্র পনের মিনিটের একটি ভিডিও তাতেই মোটামুটি সবকিছু পরিস্কার হয়ে গেল। ঢাকার মিরপুর দশ নম্বর গোল চত্ত্বর থেকে ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি একদল তরুণ পথচারীদের পথের আইন মানার জন্য অনুরোধ করছে। কিন্তু অধিকাংশ পথচারীই পথের আইন মানতে নারাজ। কেউ কেউ চরম বিরক্তি প্রকাশ করছে পুলিশের ওপর বিশেষ করে তরুণ স্বেচ্ছাসেবিদের উপর। একজনতো স্বেচ্ছাসেবি তরুণদের ওপর রীতিমতো মারমুখি হয়ে উঠলেন। বেশ বয়স্ক ভদ্রলোক। চোখে-মুখে সমুদ্র সমান বিরক্তি। কেন তাকে পাশের ওভারব্রীজ দিয়ে যেতে বলা হলো? তরুণেরা বলার কে? অনেকটা ডেম কেয়ার ভঙ্গিতে তরুণ স্বেচ্ছাসেবিদের সামনে তর্জনী উঁচিয়ে বললেন, আমি যাবো না ওভারব্রীজ দিয়ে। তোমরা বলার কে?

তরুণদের পক্ষ থেকে কেউ একজন বলল, আমরা দেশের সাধারন নাগরিক। রাস্তার আইন মানার ক্ষেত্রে পুলিশের কাজে সহায়তা করছি। আপনি আইন অমান্য করছেন। প্লিজ, এভাবে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হবেন না। ওভারব্রীজ দিয়ে যান…। ভদ্রলোক কিছুতেই তরুণ স্বেচ্ছাসেবিদের কথা শুনলেন না। বরং তাদের ওপর চরম বিরক্তি প্রকাশ করে ঔদ্ধত্ব্য দেখানোর ভঙ্গিতে ওভারব্রীজের নীচ দিয়ে দৌঁড়ে রাস্তা পার হলেন।

ভিডিওতে দেখা গেল পথচারিদেরকে পাশের ওভারব্রীজ দিয়ে চলাচলের জন্য বারবার অনুরোধ করা হচ্ছে। কেউ অনুরোধ মানছেন। আবার কেউ মানছেন না। মিরপুর দশ নম্বর গোল চত্ত্বর বেশ ব্যস্ত এলাকা। চারদিক থেকে গাড়ি আসা যাওয়া করে। উপরে রয়েছে ওভারব্রীজ। নিয়ম অনুযায়ী পথচারিদের ওভারব্রীজ ব্যবহার করার কথা। কিন্তু অনেকেই এই ব্যাপারে অান্তরিক নন। ভিডিওটিতে দেখা গেলো বাস থেকে নেমে ডানে বামে না তাকিয়েই দৌঁড়ে রাস্তা পার হচ্ছেন অনেকে। পনের মিনিটের ভিডিওতে শতাধিক পথচারিকে আইন ভঙ্গ করতে দেখা গেল। পাশেই ওভারব্রীজ থাকা সত্বেও অনেকেই ব্যস্ত রাস্তায় নেমে চলন্ত গাড়িকে পাশ কাটিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন। ছোট দুই বাচ্চার হাত ধরে অনেক ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন এক মহিলা। তরুণ স্বেচ্ছাসেবিরা তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, পাশেই ওভারব্রীজ থাকা স্বত্ত্বেও আপনি কেন এভাবে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন? মহিলা হাসতে হাসতে বললেন, ভুল হয়ে গেছে… ভবিষ্যতে এমন ভুল আর হবে না। স্যুট-টাই পরা একভদ্রলোক ওভারব্রীজের নীচ দিয়ে হেঁটে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। তাকে থামানো হলো। বলা হলো, প্লিজ ওভা ব্রীজ দিয়ে যান… ভদ্রলোক হঠাৎ তর্ক জুড়ে দিলেন। বললেন, আমি রোজ এভাবেই রাস্তা পার হই। ওভারব্রীজে উঠতে পারব না। স্বেচ্ছাসেবি তরুণেরা অনুরোধের সুরে বলল, আপনাকে ওভারব্রীজ দিয়েই যেতে হবে। ব্যস, ভদ্রলোক রেগে উঠলেন। পারেন তো তরুণদেরকে চড়-থাপ্পড় লাগিয়ে দেন এমন অবস্থা। আশার কথা, শেষ পর্যন্ত তাকে ওভারব্রীজ দিয়েই রাস্তা পার হতে হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু কথা হচ্ছে এভাবে অনুরোধ করে তর্ক যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে রাস্তার আইন মানার ব্যাপারটা কি নিশ্চিত করা সম্ভব? দশটা-পাঁচটা অফিস করার ক্ষেত্রে আমরা আইন মানতে পারলে সড়ক পথের আইন কেন মানি না? এখানে গাড়ি থামবে, এখানে গাড়ি থামবে না। এখানে হর্ণ বাজানো নিষেধ, ওভার ব্রীজ ব্যবহার করুণ… এগুলো তো পথের আইন। তা মানতে আপত্তিটা কোথায়?

লেখাটি যখন লিখছি তখনই দেশের একটি জাতীয় দৈনিকের ভেতরের পাতায় কয়েকটি ছবির দিকে দৃষ্টি গেল। একটি ছবিতে জেব্রা ক্রসিং এর ওপরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি বাস। বাসগুলোকে পাশ কাটিয়ে কোনো মতে রাস্তা পার হচ্ছে পথচারিরা। এই ছবির নীচে ক্যাপশনে লেখা, ‘পথচারিদের জেব্রা ক্রসিং দিয়ে সড়ক পারাপার হতে অনুরোধ করছেন বিএনসিসি ও স্কাউট সদস্যরা।’ কিন্তু আইন অমান্য করে জেব্রা ক্রসিং এর উপর বাস থামাচ্ছেন বাস চালকেরা।

অন্য একটি ছবিতে দেখা যায় ব্যস্ত রাস্তার ওপর একটি মটর সাইকেলে যাচ্ছেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। তার পাশেই দুই স্কুল ছাত্রীকে নিয়ে মটর সাইকেল চালাচ্ছেন একজন ব্যক্তি। মটরসাইকেল আরোহী দুই ছাত্রী ও তাদের চালকের মাথায় হেলমেট থাকলেও পুলিশ কর্মকর্তার মাথায় হেলমেট নাই। ছবির ক্যাপশনে লেখা ‘ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশ অনুযায়ী সাধারন মটরসাইকেল আরোহীরা হেলমেট পরলেও পুলিশ সদস্যরাই নির্দেশ মানছেন না।’

বিজ্ঞাপন

অন্য আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে রাজপথে প্রকাশ্যে চলছে লেগুনা। ছবির ক্যাপশনে লেখা রয়েছে ‘লক্কর ঝক্কর লেগুনার চলাচল থামেনি এখনও। নির্দেশনা অমান্য করে রাজধানীর কিছু সড়কে এখন চলছে এমন যানবাহন…’ আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে হেলমেট ছাড়াই একটি পেট্রোল পাম্প থেকে মটর সাইকেলের জন্য জ্বালানি নিচ্ছে একজন চালক। অন্য একটি ছবিতে দেখা যায়, উল্টো পথে গাড়ি চলছে। আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে ব্যস্ত রাস্তার মাঝখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী তোলা হচ্ছে।

মোট কথা, আমরা যে যাই বলি না কেন সড়কের পরিবহন সংস্কৃতিতে তেমন কোনো পরিবতর্নই ঘটেনি। আমরা যে যার অবস্থান থেকে ‘এটা করা উচিত ওটা করা উচিত’ জাতীয় নীতি কথাই বলে যাচ্ছি। অনেকটা বলার জন্য বলা। এই যে স্কুলের ছেলেমেয়েরা এতো বড় একটা আন্দোলন করলো। রাস্তায় ড্রাইভারদের ড্রাইভিং লাইসেন্স পর্যন্ত তল্লাশী করলো। তখন পরিবহন সংস্কৃতিতে একটা বোধের সৃষ্টি হয়েছিল। ভাবা হয়েছিল এই বুঝি সব কিছু ঠিক হয়ে গেল। যারা গাড়ি চালান তারা বদলাবেন। যারা পথে হাঁটেন, গাড়িতে চড়েন তারাও বদলাবেন। কিন্তু কেউতো বদলালো না। স্কুলের ছোটো ছোটো বাচ্চাদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে জিগাতলা থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরী রোড মুখি রাস্তায় রিকশা চালকদের সারীবদ্ধ লাইন দেখেছিলাম। প্রচার মাধ্যমে এনিয়ে আশাব্যঞ্জক নানা ধরনের রিপোর্ট, প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রচার হয়েছে। কয়েকদিন আগে সায়েন্স ল্যাবরেটরীর সেই রাস্তায় দেখলাম ‘যেই লাউ সেই কদু’ অবস্থা। অর্থাৎ আগের মতোই এলোপাতাড়ি রিকশার লাইন। যে বাচ্চারা রাস্তার আইনের জন্য দেশ কাঁপানো আন্দোলন করলো তাদেরই অনেকে বাবা-মায়ের হাত ধরে রাস্তার আইন অমান্য করে রাস্তা পার হচ্ছে। যারা গাড়ি চালান সেই ড্রাইভারদের মাঝেও তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে সড়ক ব্যবস্থাপনার ওপর ১৭টি নির্দেশনা জারী করা হয়। এর মধ্যে একটি হলো রাস্তায় চলাচলের সময় প্রতিটি গাড়ির দরজা বন্ধ থাকবে। নির্ধারিত স্টপেজের বাইরে যাত্রী উঠানো ও নামানো যাবে না। প্রতিটি বাসে চালকের ছবি থাকতে হবে…সরকার নিয়ন্ত্রিত বিআরটিসি বাস ছাড়া অধিকাংশ বেসরকারী মালিকাধীন বাসে এই নিয়ম মানা হচ্ছে না। চুক্তিভিত্তিক বাস চালানোর ব্যাপারে বিধি-নিষেধ জারি করা হলেও অনেকেই তা মানছেন না। বিশেষ করে সিএনজি অটোরিকশার ক্ষেত্রে চালকেরা যেন আগের চেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। গাড়িতে মিটার আছে। অথচ কেউই মিটারে ভাড়া যেতে চায় না। মিটারে যাবার কথা বললেই অনেকে ঔদ্ধত্ব্যপূর্ণ আচরণ করে যাত্রীদের সাথে। একটু ভদ্র যারা তাদের বক্তব্য, যাবো কি করে? মিটারে তো পোষায় না। আজব কথা তো। মিটারে না পোষালে গাড়িতে মিটার থাকবে কেন?

সড়ক ব্যবস্থার ওপরও একটি দেশের ভাবমূর্তি ফুটে ওঠে। সড়কের আইন-কানুন দেখেও বুঝে নেওয়া যায় দেশটি আসলে কতটা সভ্য? আমাদের দেশের সড়ক ব্যবস্থা দেখে কি আমরা নিজেদের সভ্য বলতে পারি? প্রশ্নটা বোধকরি কঠিন হয়ে গেল। পাঠক, ক্ষমা করবেন প্রশ্নটা করার জন্য। তবে এই প্রশ্নের সন্তোষজনক একটা উত্তর দরকার।

 রেজানুর রহমান: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/পিএম

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন