বিজ্ঞাপন

‘তুমি তাকেই ব্রহ্ম বলে জেনো ‘

September 13, 2018 | 5:45 pm

সাকলাইন খুরশিদ ।। 

বিজ্ঞাপন

‘চক্ষুদ্বারা যাহাকে দেখা যায় না কিন্তু লোকে চক্ষুর বিষয় সমূহ যার দ্বারা দর্শন করে
তুমি তাকেই ব্রহ্ম বলে জেনো’

‘যিনি বাক্য দ্বারা প্রকাশিত হন না,কিন্ত যার দ্বারা বাক্য প্রকাশিত হয়
তুমি তাকেই ব্রহ্ম বলে জেনো’– উপনিষদ

উপনিষদের বাণী চিরন্তন, এর আবেদন শ্বাশত। কালপ্রবাহে এর ক্ষয় নাই, লয় নাই। ভারতবর্ষের চিরন্তন আত্মাটি যেন উপনিষদেই বাঙময় হয়ে উঠেছে। ভারতীয় ধর্ম, সংষ্কৃতি, দর্শনের আকর গ্রন্থ উপনিষদ। কিন্তু আমার শঙ্কিত মনের কোণে একটি ভয় আত্মগোপন করে আছে। আর তা হল ভারতবর্ষের মত বিশাল দেশে যেখানে একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত রূপ গড়ে উঠেছে বহু ধর্ম আর বহু সংস্কৃতির সমন্বয়ে, যেখানে রয়েছে হিন্দু মুসলমানের মত দুটি সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সহবস্থান সেখানেও ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি ধর্মকে কেন্দ্র করে মতপার্থক্যের বেদনাদায়ক ফলশ্রুতি। এর কারণ বোধহয় নিজ ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞানতা। যে ধর্মকে কেন্দ্র করে আমরা পরস্পরের বিরুদ্ধে অবন্ধুসুলভ মনোভাবের পরিচয় দেই অনেকসময় সেই  ধর্ম সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানটুকু ও আমাদের নেই। আমরা আমাদের ঐতিহ্য কে চিনি না, জানি না।

বিজ্ঞাপন

বেদ যে হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতি এর মূল উৎস একথা হিন্দুমাত্রই স্বীকার করবেন। কিন্তু অনেকে বেদের একটি সংকীর্ণ অর্থ গ্রহণ করেন। বস্তুত বেদ কোন গ্রন্থ বিশেষ নয়, বেদ একটি সমগ্র সাহিত্যের সূচক। এই সাহিত্যকে মোটামুটি তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়– সংহিতা, ব্রাহ্মণ, উপনিষদ। প্রথম দুটো ভাগের  প্রধান অংশ যজ্ঞানুষ্ঠান হলেও এগুলোতে দার্শনিক চিন্তার ধারা অপরিস্ফুটভাবে দেখা যায় যা মূলত ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের সৃষ্টি। কিন্তু উপনিষদে যে দার্শনিক চিন্তা সর্ব্বোচ্চ স্তরে পৌছেছে এতে প্রধান ভুমিকা ক্ষত্রিয়দের। এবং ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ছাড়া অন্য জাতির লোক ও যে এই দার্শনিক চিন্তার ধারক ও বাহক ছিলেন এর যথেষ্ট প্রমাণ উপনিষদে আছে। সাংসারিক জীবনের বন, মান, প্রতিপত্তির প্রতি বীতস্পৃহ এবং সম্পূর্ণ উদাসীন এক শ্রেণির লোক জীবনের প্রকৃত অর্থ নির্ধারণে উৎসুক হয়ে সংসার ত্যাগ করে ধ্যান করতেন। তাদের চিন্তাপ্রসূত উক্তিগুলোই উপনিষদে স্থান পেয়েছে।

বেদের সংহিতা অংশে উপনিষদের জন্ম ,আরণ্যক অংশে তার পরিবর্ধন।  উপনিষদের অর্থ কি তা নিয়ে যথেস্ট বিতর্ক আছে। ডয়সেন একে ‘রহস্যগত জ্ঞান’ নামে অভিহিত করেছেন। এদিকে ম্যাক্সমুলার বলেছেন, গুরুর নিকট বসে দার্শনিক বিদ্যা আয়ত্ত করা সহজ হত বলে  এর নাম উপনিষধ করা হয়েছে। তবে উপনিষদের সমার্থক শব্দ “বেদান্ত” থেকে এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ আঁচ করা যায়। বেদের প্রান্তে বেদকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছিল বলেই তাকে বেদান্ত বা উপনিষদ বলে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর উপনিষদ নামে প্রচলিত গ্রন্থগুলো পাঠ করে বলেছিলেন, ‘অবস্থাটি এমন বিভ্রান্তিকর, এ যেন কন্টকারণ্য।’

এমন পরিস্থিতি উপনিষদের দর্শন আলোচনায় একটি বিশেষ সমস্যার সৃস্টি করে কারণ সাধারণের দর্শন যেভাবে লেখা হয়, উপনিষদের দর্শন সেভাবে গড়ে উঠেনি। তথ্যকে একত্র করে যুক্তির প্রয়োগে কোন সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা উপনিষদে করা হয়নি। নানারকম সমস্যা ঋষিদের আলোড়িত করেছে , তারা এসব নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন আর যা উপলব্ধি করেছেন তা কবিসুলভ ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন উপনিষদে। ফলে উপনিষদের দার্শনিক তত্ত্বের পরিপূর্ন রূপটিকে এক জায়গায় সাজানো অবস্থায় আমরা পাই না। এমন ভাবধারার ঐক্যের সূত্রকে ধরে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত দার্শনিক তত্ত্বের কণাগুলিকে সাজিয়ে নিয়ে আমাদের সে দর্শনটিকে গড়ে তুলতে হবে।

বিজ্ঞাপন

উপনিষদে বর্ণিত ব্রহ্মবাদের প্রকৃতি সহজে হৃদয়াঙ্গম করতে পারি এরিস্টটল বর্ণিত চারটি কারণের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে। দুইটি ঘটনার মধ্যে যদি অব্যবহিত কারণ ও সর্বকালীন সংযোগ থাকে তবে প্রথমটিকে কারণ বলা যায়। এরিস্টটলের বর্ণনানুসারে কারণ চার প্রকারঃ উপাদান-কারণ, নিমিত্ত-কারণ, রুপ-কারণ এবং উদ্দেশ্য-কারণ (material cause, efficient cause, formal cause and final cause)। উদাহরণস্বরুপ, মানুষের ব্যবহার্য একটি ভোগ্যপণ্যের কথা বিবেচনা করা যাক। ধরে নেই, ভোগ্যপণ্যটি মৃৎপাত্র। মৃৎপাত্রের উপাদান-কারণ হল মাটি, নিমিত্ত-কারণ হল কুম্ভকার, রুপ-কারণও হলো কুম্ভকার- যে তার হাতের নিপুণ স্পর্শে চাকায় ঘোরা মৃৎপিন্ডকে রুপ দেয়  এবং সর্বশেষ কারণ অর্থাৎ উদ্দেশ্য-কারণ হল যে উদ্দেশ্যে শিল্পটিকে ব্যবহার করা হয়।

বিশ্ব হল সৃষ্টি আর ব্রহ্মা হলেন স্রষ্টা। এদের সম্বন্ধ উপনিষদের পরিকল্পনায় এমন নিবিড় যে ব্রহ্মের উপর একসঙ্গে এই সবগুলি কারণত্ব আরোপ করা যায় অর্থাৎ উভয়ের মধ্যে উভয়ে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তার অর্থ হল বিশ্বের মধ্যে বিশ্বশক্তি প্রচন্ডভাবে ক্রিয়াশীল। সে শক্তিই বিশ্বের আশ্রয় এবং সেই শক্তিই সমগ্রভাবে বিশ্বকে একত্রিত করেছে। বিশ্বশক্তি বিশ্বের মধ্যেই ছড়িয়ে আছে– এই হল উপনিষদের ব্রহ্মবাদের মূল সুর। ব্রহ্ম সবকিছু ব্যপ্ত করে আছেন, ব্রহ্ম সবকিছু ধারণ করে আছেন, সবকিছুর অন্তরে অধিষ্ঠান করছেন– উপনিষদের নানা বাণীতে এই কথাই বারবার উল্লেখ করা হয়েছে।  ছান্দোগ্য উপনিষদে এই সারমর্ম এসেছে এই বলে যে- এই সব কিছু ব্রহ্ম, ব্রহ্মেই তাদের জন্ম, পুষ্টি এবং বিলয়। তাহলে এরিস্টটল পরিকল্পিত চারটি কারণ কীভাবে প্রয়োগ করা যায়?

উপাদান- কারণত্ব এবং রূপ কারণত্ব (material and formal cause)
প্রথমেই ধরা যাক, ব্রহ্মের উপাদান কারণত্ব। ব্রহ্মই যে বিশ্বের উপাদান- কারণ এই কথাটির উপর উপনিষদে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। একটি উপমা প্রয়োগের মাধ্যমে এই কথাটির স্বরুপ উন্মোচিত হয়। মানুষের নির্মিত বস্তুর মধ্যে দুটো জিনিস লক্ষণীয়– একটি তার বিশেষ রূপ এবং অন্যটি তার উপাদান।যেমন মৃৎশিল্পের উপাদান মাটি এবং রূপ হচ্ছে শিল্পরূপে তার প্রকাশ। এখানে মূল তত্ত্ব হল উপাদান এবং গৌণ তত্ত্ব হচ্ছে বিভিন্ন রূপে তার প্রকাশ। উপাদানের বিকার হতেই বিশেষ রূপের বা গৌণ তত্ত্বের প্রকাশ। সেইরুপ বিশ্বের মূলতত্ত্ব হল ব্রহ্ম, তার উপাদান বিভিন্ন রূপে প্রকট হয়ে নামের দ্বারা চিহ্নিত হয়ে বহুরুপে প্রকাশিত হয়েছে। এই বচন থেকে মনে হতে পারে ব্রহ্মের রূপ- কারণত্বের উপর তেমন গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি, যেন ইঙ্গিত করা হচ্ছে যে উপাদান যখন এক তখন তার পৃথক পৃথক রূপের কোনো মূল্য নাই। কিন্ত একই ব্রহ্ম এর এই বহুত্বকে ব্যাপ্ত করেই যে তার একত্ব, বহুর মধ্যে যে যোগসূত্র তার নির্দেশ ও উপনিষদ এ আছে। বলা হয়েছে একই অগ্নি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রূপে প্রকাশ হলেও অগ্নি বলেই তাকে আমরা চিনি, তেমনি একই রূপে ব্রহ্ম বিভিন্ন জীবে বিভিন্ন রুপে প্রকট হলেও সবার মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে বিরাজ করছেন।

নিমিত্ত কারণত্ব (efficient cause)
ব্রহ্ম যে বিশ্বের অভ্যন্তরে থেকে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করেন এ বিষয়ে উপনিষদে সুস্পষ্ট উক্তি আছে। এখানেই মানুষের কারণত্বের সাথে ব্রহ্মার কারণত্বের পার্থক্য। মানুষ যা নির্মাণ করে তার বাইরে রয়ে যায়, তাকে নিয়ন্ত্রণ করে বাইরে থেকে। কিন্ত ব্রহ্ম নিয়ামক শক্তি হিসেবে বিশ্বে দুইভাবে কাজ করেন। প্রথমত, তার প্রশাসনে সমগ্র বিশ্ব বিধৃত ও পরিচালিত। সূর্য-চন্দ্র, দ্যাবা-পৃথিবী, নিমেষ-মূহুর্ত, অহোরাত্র তার প্রশাসনে ধৃত হয়ে আছে। দ্বিতীয়ত, তিনি বিভিন্ন জীবের অন্তরে বর্তমান থেকে তাদের অজান্তে নিয়ন্ত্রণ করেন। সকল ভূত তার শরীর স্বরুপ এবং তাদের অন্তরে থেকে তিনি তাদের নিয়মিত করেন বলে তিনি অন্তর্যামী। দেহ পরিবর্তিত হয় কিন্ত নিয়ামক শক্তি নিত্য এবং তা অমৃত।

বিজ্ঞাপন

উদ্দেশ্য-কারনত্ব(final cause)
উপনিষদের ঋষিগণ সামগ্রিক ভাবে একটি উদ্দেশ্য-কারণত্বও আবিস্কার করেছেন। তাদের মতে এই উদ্দেশ্য–কারণত্ব হল “রসের” আস্বাদন। এই রস কিসের ইঙ্গিত করে? তৈত্তিরীয় উপনিষদ এ বলা হয়েছে ব্রহ্ম রসস্বরূপ, কারণ তিনি রস অনুভব করে আনন্দ পান। এই আনন্দ শিল্প রসিকের আনন্দ। এখানে ব্রহ্ম যখন সব জড়িয়ে সব নিয়ে আছেন তখন শিল্পী, শিল্পরসিক এবং শিল্পকর্ম একই সত্তা হয়ে যায়। ফলে ব্রহ্মা ও রসস্বরুপ। এই আনন্দ শুধুই সুখানুভূতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, ট্র্যাজিক নাটকের মোট এই আনন্দ সুখ-দুঃখ জড়িয়ে পরিস্ফুট হয়।  শিল্পরসিক ক্লাইভ বেল এই অনুভূতির নাম দিয়েছেন ‘শিল্পতাত্ত্বিক অনুভুতি(aesthetic emotion)।’

এই আনন্দ অহেতুক এর কোন ব্যবহারিক প্রয়োজন নেই। উপনিষদ বলতে চেয়েছে ব্রহ্মা শিল্পরসিক, তাই তিনি শিল্পীর ভুমিকা গ্রহণ করে আনন্দ পান। এখান থেকেই ব্যাখা করা যায় ব্রহ্মার বহুত্ব, কারণ বিশুদ্ধ একত্বের মধ্যে রস উপলব্ধির অবকাশ নেই। সেজন্যই আদিতে একক সত্তা অবস্থায় ব্রহ্ম তার একাকিত্ব উপভোগ করলেন না। রসের উপলব্ধির জন্য তিনি বহু ও বিচিত্র রুপে প্রকট হলেন, একাকী থেকে আনন্দ পেলেন না বলেই তিনি দ্বিতীয়কে চাইওলেন। আর এভাবেই বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল দ্বৈত সংগীতের ধারা। জ্ঞাতা ও জ্ঞায়ের ভিত্তিতে, ভোক্তা ও ভোগ্যের ভিত্তিতে ব্রহ্মার আপন মাধুরি ফুটে উঠল। ঋষিরা বললেন-পৃথিবী সকল প্রাণীর নিকট মধুস্বরুপ এবং পৃথিবীর কাছে সকল প্রাণী মধুস্বরুপ।

সুতরাং উপনিষদ অনুসারে বিশ্ব একটি অঙ্গবিশিষ্ট অঙ্গী রুপে পরিকল্পিত। তা বিশুদ্ধভাবে এক নয়, সকলকে জড়িয়ে এক। তাতে বহু ও পৃথক পদার্থের সমাবেশ আছে, কিন্ত তারা একই ব্যাপক সত্তার মধ্যে বিধৃত। সেই সত্তা বিশ্বের বিভিন্ন অংশের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে ক্রিয়াশীল থেকে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে (তাই তা অন্তর্যামী) এবং দ্বৈতভাবে চিহ্নিত হয়ে বিচিত্ররুপে প্রকট হয়। জ্ঞাতা ও জ্ঞায়ের সম্বন্ধের ভিত্তিতে তার রূপ-শব্দ-রস-স্পর্শ-গন্ধময় বিচিত্র প্রকাশ ধরা পড়ে। তাই হয়তো রবিঠাকুর বলছেন-

যে ভাবে পরম – এক আনন্দে উৎসুক /আপনারে দুই করি লভিছেন সুখ
দুয়ের মিলন ঘাতে বিচিত্র বেদনা / নিত্য বর্ণ ,গন্ধ,গীত করিছে রচনা।

 

লেখক – ছাত্র, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল- khurshidsaqlain@gmail.com

 

দোহাই-
১.Deussen,Philosophy of the upanishads
২.Maxmueller,sacred books of the east
৩.উপনিষদের দর্শন –হিরন্ম্যয় বন্দ্যোপাধায়

সারাবাংলা/আরএফ 

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন