বিজ্ঞাপন

‘ওরা কুকুরকে খেতে দেয়, কাজের মেয়েকে না’

September 17, 2018 | 8:34 am

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ‘ওরা এত খাবার রান্না করাতো আমাকে দিয়ে, বেশি খাবারটুকু ফেলে দিত। কুকুর পোষে, কুকুরকে খাবার দিত-কিন্তু কাজের মেয়েকে একটা দানা পর্যন্ত দিত না। খাবার চাইতে গেলে বলত, একপাশ দিয়ে কুকুর খাবে, আরেকপাশ দিয়ে তোরা খাবি’ কথাগুলো বলছিলেন ২৩ বছরের মুনিমা ( ছদ্মনাম)।

সৌদি ফেরত এ নারী কথা বলেন আর হাতের তালু দিয়ে চোখের কোণ মোছেন। গত বৃহস্পতিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) রাতে তিক্ত অভিজ্ঞতা আর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি আরবের রিয়াদ মাহারা হিউম্যান রিসোর্স কোম্পানি ও সফর জেল ( ইমিগ্রেশন ক্যাম্প) থেকে ফেরত আসেন ৬৫ জন নারী গৃহকর্মী। এদের মধ্যে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফেরেন ৩৭ জন, তাদেরই একজন মুনিমা।

মুনিমা জানালেন, তার জন্মের সময়ে মাকে হারান, কয়েক বছরের ভেতরে মারা যান বাবা। তারপর সৎ মায়ের সংসারে আর থাকা হয়নি তার। নিজের বাড়ি বিক্রমপুর থেকে চলে যান নানাবাড়িতে। নানাবাড়িতে একসময় ঠাঁই না হওয়ায় সেখান থেকে বরিশালের একটি এতিমখানায় বড় হওয়া। মুনিমা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই নানা অত্যাচারে বড় হয়েছি। স্নেহ ভালোবাসা পাইনি।’

বিজ্ঞাপন

তারপর সাড়ে তিনবছর বয়স থেকে বড় হয়েছেন বরিশালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা এক এতিমখানায়। সেখানে ব্লক-বাটিকের কাজসহ হাতের অনেক কাজ শিখেছেন মুনিমা। একসময় বড় হয়ে বিয়ে করেন, কিন্তু স্বামীর সঙ্গে বনিবনা নেই। সাড়ে চার বছরের একটি মেয়ে রয়েছে মুনিমার। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই সৌদি যান হতভাগা এই নারী।

বলেন, ‘তিনবছরের মেয়েকে রেখে গিয়েছিলাম। স্বপ্ন ছিল, আশা ছিল-মেয়েটাকে বড় করব। আমি লেখাপড়া করতে পারিনি, নিজে কষ্ট করে মেয়েকে লেখাপড়া করাব। মেয়ের ভেতর দিয়ে নিজেকে বড় করব, কিন্তু হলো না, হয়নি। সব হারিয়ে আমি ফেরত এসেছি।’

বিজ্ঞাপন

মুনিমার চোখেমুখে আতঙ্ক আর বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। সারাবাংলার কার্যালয়ে রোববার (১৬ সেপ্টেম্বর) এসে বলছিলেন নিজের জীবনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্মম অভিজ্ঞতার বিবরণ। কথা বলতে বলতে মাঝেমধ্যে খেই হারিয়ে ফেলেন। স্মৃতি হাতড়িয়ে তবুও  বলে যান, দুঃসহ জীবনযুদ্ধের আখ্যান।

নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে মুনিমা বলেন, ‘এতিমখানা থেকে ফেরত আসার পর রমনা পার্কসহ শাহবাগের রাস্তায় পরে থাকা বকুল ফুল বেলি ফুল কুড়াতাম, মালা গেঁথে বিক্রি করতাম। সাত থেকে আট বছর হবে। এই হাতে ইট পাথর ভেঙেছি। গাড়িতে গাড়িতে চকলেট বিক্রি করেছি, লঞ্চে পানির বোতল বিক্রি করেছি’।

স্মৃতি হাতড়ে মুনিমা বলেন, ‘মতিঝিলে তখন এত দালান হয়নি, শাপলা চত্বর হয়নি। পুরান ঢাকাতে একসময় এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয়। বিয়ে হয় তার। কিন্তু বিয়ের কয়েকমাস যেতেই স্বামীর আসল চেহারা ফিরে আসে। নানা অত্যাচার করত, গায়ে হাত তুলত, নির্যাতন করত। নিজে আয় করত না, বরং মাটির ব্যাংকে রাখা গচ্ছিত টাকাটাও ভেঙে নিয়ে তার স্বামী, বলেন মুনিমা। আর কাঁদেন। বলেন, ‘ততদিনে আমি সন্তান ধারণ করেছি। ঐ অবস্থায় কে দেখে আমাকে? নদীর ওপারে ঘরে খাবার ছিল না, বাড়ি ভাড়া দিতে পারতাম না, খাবার খেতে পেতাম না। ওই অবস্থাতে পেটে বাচ্চা নিয়েই মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে হাত পাততাম, বাসাতেও কাজ করেছি। বাদামতলীতে চাউলের ফ্যাক্টরিতে কাজ করতাম। চাউল ঝাড়ু দিতাম, বস্তা তৈরি করতাম, এমনকী পোস্তগোলা বস্তিতে সাপুড়েদের সঙ্গেও থেকেছি। গর্ভে সন্তান নিয়ে পুরান বিভিন্ন মার্কেটে কাজ করেছি, বাদামতলীতে পঁচা ফল কুড়ায়ে সেগুলো বিক্রি করতাম।’

একসময় মেয়েটা হলো, কিন্তু আমার তো কেউ নেই মন্তব্য করে মুনিমা বলেন ‘আমি পথে পথে বড় হয়েছি, তাই জানি পথের প্রতিটি বাঁকে কত শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে মেয়েদের যেতে হয়। তাই মেয়েটার একটা ভালো ভবিষ্যতের আশায় আমি সৌদি গেলাম। মেয়েটাকে রেখে গেলাম গ্রামে থাকা এক দূরাত্মীয়ের কাছে টাকার বিনিময়ে। কিন্তু সেখানে গিয়ে পড়লাম কূলহীন এক সাগরে।

বিজ্ঞাপন

বলেন,  ‘প্রথম দাম্মামে ছিলাম ১৫ দিন। বিশাল বাড়ি, অনেক বাচ্চারা। মালিকও ভালো ছিল না। খাবার দিত না, শারীরিক নির্যাতন করত। গরম পানি ফেলে পা পুড়িয়ে দিয়েছে।’

এক বছর চার মাসের সৌদি জীবনে মুনিমা অসংখ্য বাড়িতে বিক্রি হয়েছেন। যোগাযোগ করতে পারেননি কারও সঙ্গে। না খেয়ে থেকেছেন, গরম পানিতে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে হাত, তালাবদ্ধ কক্ষে থেকেছেন দিনের পর দিন, এমনকী ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে চেয়েছেন।

জানালেন, তাকে যে ভিসায় নেওয়ার কথা ছিল সে ভিসায় তাকে নেওয়া হয়নি। সৌদি গিয়ে বাড়িতে বাড়িতে, মক্তবে মক্তবে তিনি কেবল বিক্রিই হয়েছেন।

একটা মক্তবে ছিলাম তিনমাস। কিন্তু ‘আমি তো টাকা কামাইয়ের জন্য আসছি। যদি ফেরত যাই, তাহলে আমার সন্তানের ভবিষ্যত কী হবে-এই ভেবে থেকে গেছি’। কিন্তু কত আর সহ্য করা যায়, শেষে সব হারিয়ে সেদিন ফেরত এসেছি, বলেন মুনিমা।

মোবাইলে মেয়ের ছবি দেখাতে দেখাতে মুনিমা বলেন, ‘কেবল আমরা নারী না, ছেলেরাও রয়েছে।  শত শত ছেলে রয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। মালিকরা কাজকে ভালোবাসে, মানুষকে না। এক মিনিট বসলেও ওরা অত্যাচার করে। তাও সারাাদিন যেত। দুই থেকে তিনপর একদিন খাবার দিত।’

মুনিমা তায়েফের একটা বাড়িতে কাজ করতেন যেখানে পুরো বাড়ি সবসময় পরিষ্কার রাখতে হতো, পুরো বাড়ির খাবার তৈরি করতে হতো জানিয়ে মুনিমা বলেন, ‘একটা মিনিট বসার সুযোগ ছিল না। ঘুমাতে ঘুমাতে রাত তিনটা, উঠতে হতো আবার ফজরের আযানের সময়।’

আমাকে বলতো, ‘তুমি খাবে, তোমার টাকা দিয়ে কিনে খাবে। আমি শুধু তোমাকে বেতন দেব, আর কিছু না। আর খাবার বলতে ছিল রুটি, আর চা। আর ওরা যা খেত সেটা আমরা বাঙালিরা খেতে পারতাম না।’

মুনিমা বলেন, ‘ওরা বাংলাদেশ থেকে কাজের লোক নেওয়ার সময় অনেক প্রশংসা করে নেয়, কিন্তু সেখানে নেওয়ার পর তাদের চেহারা পুরাই ভিন্ন। তালা মেরে ঘরে আটকায়ে রাখে, মারধর করে। ওদের এই চেহারা বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব না।’

সৌদির জেদ্দা, রিয়াদ, দাম্মাম, তায়েফ আর পাহাড়পুরীর বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করেছেন তিনি। কেবলমাত্র জেদ্দা ছাড়া আর কোনও বাড়ি থেকে পুরো বেতন পাননি মুনিমা। জানালেন, সমস্ত বেতন রেখে দেয় দাম্মারের এক বাড়িতে। তারা আমাকে বাংলাদেশে পাঠানোর কথা বলে টাকাগুলো রেখে দেয়। সে দেশের দেড় হাজার রিয়াল রেখে দেয়। পা পর্যন্ত ধরেছি, এটাই আমার শেষ সম্বল, আমার মেয়ের কাছে টাকাটা পাঠাব, কিন্তু ওরা কোনও কথা শোনেনি। টাকাটা আমি আনতে পারিনি, আমার সব জিনিস রেখে দিয়েছে।’

একটি মক্তবে কেবল বাংলাদেশের নয়, সৌদি আরবের একটি মক্তবে ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা ও নাইজেরিয়ার মেয়েরাও ছিল। সেখানে, মারধর করা হতো মেয়েদের।

মুনিমা বলেন, ‘মক্তবের মালিক ছিল সৌদির, সে একজন করে ডেকে নিয়ে যেত তিনতলার ওপরের একটা ঘরে। দেশে আসতে চাইলেই মারত। ছাতার হাতার মতো বড় লাঠি, বড় চাবুক দিয়ে পেটাতো। মক্তবে মারধর করে, ধর্ষণ করে। সেখানে কেবল সৌদি আর পাকিস্তানের লোকেরা। আমাকে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করছে ওরা, কিন্তু বেতনটা পাইনি।’

মুনিমা বলেন, ‘সে মক্তব থেকে তাকে আরেক মালিক সাড়ে পাঁচ হাজার রিয়াল দিয়ে কিনে নেয়, সে বিক্রি করে দেয় আরেকজনের কাছে। এভাবে চলে তার দিন। মক্তবে অত্যাচারে একজন মেয়ে আত্মহত্যা করেছে, তার লাশ এখনও হাসপাতালের ফ্রিজে রাখা আছে জানান মুনিমা।

মুনিমা বলেন, ‘ওরা মিথ্যা কথা বলে মেয়েদের সঙ্গে, তার কাছ থেকে টাকা নেয়। দেশে পাঠানোর কথা বলে তিন বয়স্ক নারীকে ফেলে এসেছে মরুভূমিতে।’

সবশেষে তায়েফের বাসা থেকে পালিয়ে মুনিমা রিয়াদে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সেফহোমে আসেন। সেখানে ছিলেন প্রায় তিন মাসের মতো। দূতাবাসের সেফহোমে থাকার পর তাদেরকে সফর জেল ( ইমিগ্রেশন ক্যাম্প) পাঠানো হয়। সফর জেলেও অনেক কষ্ট করেছেন জানিয়ে বলেন, ‘যে রুমে রাখা হয়েছিল সেখানে একটা জানালাও ছিল না। বেডের ওপর ছিল বেড।’

‘ওখানে সকালে একটা রুটি আর রাতেও দিত একটা রুটি। পানিটা খাওয়ার মতো একটা গ্লাসও দেয়নি সেখানে। সেখানে ১৪ দিন থেকে গত চারদিন আগে ফেরত আসি দেশে’ বলেন মুনিমা।

নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সৌদি ফেরত মুনিমার অভিজ্ঞতার মাত্রা এতোটাই তিক্ত যে তিনি নারী-পুরুষ কাউকেই সৌদি আরবে পাঠানোর বিরুদ্ধে। জানালেন, তিনি যখন সফর জেলে ছিলেন তখন পাশেই ছিল পুরুষদের বন্দিখানা।

ক্ষুব্ধ কণ্ঠে মুনিমা বলেন, ‘দুই নাম্বারি করে মিথ্যা কথা বলে অনেক পুরুষদেরও পাঠানো হচ্ছে, তাদেরকে থাকতে হয় জেলে। অথচ মানুষ দেশের সব জায়গা-জমি বিক্রি করে, মা অথবা স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে সেখানে যাচ্ছে একটু ভালো থাকার আশায়। অথচ, সেখানে গিয়ে আমরা সব হারিয়ে দেশে ফিরে আসি একেবারে নিঃস্ব হয়েই।’

‘আপনারা সবাইকে সচেতন করেন, কেউ যেন সৌদি আরব না যায়। ওখানে কোনো স্বপ্ন নেই, সবাই নিঃস্ব হয়ে ফেরত আসবে।’

‘মক্কা মদিনার দেশ-সৌদি আরব। আমরা ভাবতাম, নবী-রাসুলের দেশ, সেখানে যাই, দুটো টাকার জন্য। ওখানে প্রতিটি দিন, প্রতিটি দিন বাঙালিরা অত্যাচারিত হচ্ছে।’

সারাবাংলা/জেএ/একে

আরও পড়ুন:
সৌদি আরব ফেরত অনেক নারী মানসিক ভারসাম্যহীন

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন