বিজ্ঞাপন

নির্বাচনী জনসভা, কতটা প্রস্তুত যানজটের নগরী ঢাকা

October 1, 2018 | 12:54 pm

।। মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: বিকাল সোয়া চারটা, রোববার (৩০ সেপ্টেম্বর) , পল্টন এলাকা। বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া যানজট থেকে বাঁচতে ইতিমধ্যেই যানবাহন দিক বদলে নিজস্ব রুট বদলে দিক-বিদিকে ছুটতে শুরু করেছে। এর মধ্যে অফিস ছুটির সময়। দীর্ঘ যানজটের অভিজ্ঞতা থেকে সময় হাতে নিয়েই পথে নেমে এসেছে ঘরমুখী মানুষ। তাদেরই একজন আবদুল রফিক। মতিঝিলে প্রায় একঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও গন্তব্য (গাজীপুর) যাওয়ার কোনো বাস খুঁজে পেলেন না। বেশিরভাগ বাস সমাবেশকারীদের বহন করছে। যে কয়টা খালি আছে তাতেও জায়গা নেই তিল ধারণের।

যানজেটর নগরী ঢাকায় জ্যাম, যানবাহনের জন্য অপেক্ষা, ভোগান্তি নিত্য ঘটনা। সেই ঘটনার সঙ্গে যখন যুক্ত হয় রাজনৈতিক সভা সমাবেশ তখন শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা দীর্ঘ সময়ের জন্য অকেজো হয়ে পড়ে। বাড়ে ভোগান্তি, সময় ও অর্থের অপচয়ও। বর্তমান ঢাকায় যানবাহনের গতি প্রতি ঘণ্টায় সাত কিলোমিটারের নিচে। এরকম ব্যস্ত একটি শহর কতটা প্রস্তুত নির্বাচনী প্রচারণার জন্য- প্রশ্ন ছিল মুখে মুখে।

রোববার বিএনপির জনসভা ২টা বাজে শুরু হলেও, তার দুই ঘণ্টা আগে থেকেই জড়ো হতে থাকেন বিএনপির নেতাকর্মী সমর্থকরা। সমাবেশের অনুমোদিত স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছেড়ে শাহবাগ-মৎস ভবন সড়কে এসে ঠেকে। মূল মঞ্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হলেও শাহবাগ, মৎস ভবনের মতো স্থানে বিএনপি সমর্থকরা অবস্থান নেয়। যার ফলে মতিঝিল, গুলিস্থান, সদরঘাট, যাত্রাবাড়ীমুখী বাসগুলো আটকে যায় রমনা পার্ক সংলগ্ন সড়কে। অন্যদিকে গাবতলী, মিরপুর, মোহম্মদপুর, উত্তরামুখী বাসগুলো আটকে যায় সুপ্রিম কোর্ট সংলগ্ন সড়কে।

বিজ্ঞাপন

দীর্ঘসময়ে যানচলাচলের এই বিঘ্নের প্রভাব থাকে প্রায় সারাদিন ধরে। গভীর রাতে পর্যন্ত জ্যামে বসে থাকে নগরবাসী। সোমবার সকালেও সেই তীব্র যানজটের রেশ যেন কাটছেই না।

এই যানজটের প্রভাব যে শুধু সময় ও ভোগান্তির খতিয়ান বড় করে তাই নয়, এর অর্থনৈতিক দিকও আছে। মোহাম্মদ সাদেকুল ইসলাম (২৮) ঢাকা শহরে রিকশা চালান। বিপত্নিক এই রিক্সা চালকের দুই বছরের সন্তান থাকে বগুড়ায় আত্মীয়দের কাছে। সাদেকুল জানান, সন্তানের খোড়াকি বাবদ প্রতি সপ্তাহে এক হাজার টাকা পাঠাতে হয় বাড়িতে। প্রতিদিন রিক্সা চালিয়ে রিক্সার মালিকের জমার পরে হয়তো তিন থেকে চারশ টাকা থাকে যা এসব বিশেষ উপলক্ষ্যে দুইশতে নেমে আসে।

সাদেকুলের মতো অর্থনৈতিক ক্ষতির অভিযোগ করে ব্যাংক কর্মকর্তা আশিকুর রহমান। তার অভিযোগ এরকম সমাবেশের দিনে বাস চলাচল স্বাভাবিক থাকে না। নির্দিষ্ট গন্তব্য পৌঁছাতে ভাড়া করতে হয় সিএনজি বা অ্যাপভিত্তিক শেয়ার রাইড। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিক দিনের চেয়ে প্রায় দশগুণ বেশি খরচ হয় চলাচলে। এর মধ্যে নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে না আসতে পারলে চাকরিগত সমস্যা তো থাকেই।

বিজ্ঞাপন

আশিকুর বা সাদেকুলের কথা যে নিছকই এক একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় তা নিশ্চিত করেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউট (এআরআই)-এর ডিরেক্টর ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে ঢাকা শহরে প্রতি বছর জানজটের কারণে প্রায় ২০ হাজার কোটি থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। আর যখন এই জ্যামের পরিমাণ বাড়তে থাকে তখন বাড়ে ক্ষতির পরিমাণও, যা বহন করে এ শহরের সাধারণ নাগরিক।

এ তো গেলো টাকার হিসাব। ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংক ‘টুয়াডর্স গ্রেট ঢাকা : এ নিউ আরবান ডেভেলপমেন্ট প্যারাডাইম ইস্টওয়ার্ড’ শিরোণামে এক গবেষণায় দেখায়, জ্যামের কারণে ঢাকায় প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে।

প্রতি কিলোমিটারে ১১ হাজার ২৭ জন মানুষের ঘনত্বের নগরের যান চলাচলকে স্বাভাবিক করতে যখন সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর গলদঘর্ম অবস্থা তখন সম্প্রতি তাতে নির্বাচনী হাওয়া লাগায় উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা। ড. মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের দেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে সভা সমাবেশ খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এখন যদিও জনসভাগুলো নির্দিষ্ট স্থানের সীমানার মধ্যে আনার চেষ্টা করা হয়েছে তারপরেও জনসভার নিরপত্তার জন্য অনেক পথ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। এ ছাড়াও জনসভায় নগরের উপকণ্ঠ থেকে লোক যোগ দেয় এবং তাদের বহন করে আনা বাহনের সারিও আটকে রাখে রাজপথ। এটা নগরের স্বাভাবিক চলাচল ব্যহত করে।

এআরআইয়ের গত বছরের গবেষণায় জানা গেছে ঢাকায় যানবাহনের গড় গতি ছয়ের নেমে এসেছে। এই সমস্যা উত্তরণের জন্য ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ)’র উদ্যোগে ঢাকার জন্য স্ট্রাটিজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান করা হয়। গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ ড. এস এম সালেহ উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, এই প্ল্যান সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হলে ঢাকায় যান চলাচলের বেগ ২১ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু তার আগেই যদি এভাবে ঢাকার একদম কেন্দ্রে কর্ম দিবসে এমন সভা সমাবেশ আয়োজন করা হয় তার নগরবাসীর বাড়তি দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

বিজ্ঞাপন

নির্বাচন সামনে রেখে এরকম সভা নিয়মিত হওয়ার সম্ভাবনার বিষয়টিকে বায়বীয় মনে করছেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল করিম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, যখন কোনো জনসভা হয় আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেই, তবে নির্বাচনের আগের সময়টায় কেমন জনসভা হবে আদৌ কোনো জনসভা হবে কিনা এই বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তাছাড়া ট্রাফিক ব্যবস্থা অনেক আগে থেকে পরিকল্পনা করে রাখাও সম্ভব না। তাই যখন যা আসে আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেই।

তবে ট্রাফিকের সর্বোচ্চ এ কর্মকর্তার বায়বীয় ধারণা যদি সত্যি হয়ে যায় তবে এই নগরবাসীর কী হাল হবে তা বলতে পারছে না কেউই। ড. মিজানুর রহমান মনে করেন জনসংযোগের জন্য ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করলে ঢাকা জনসভার এই অতিরিক্ত চাপ থেকে মুক্তি পাবে। তার মতে, ঢাকা এখন আর নিয়মিত এইসব জনসভার ভার বহন করতে পারবে না।

সারাবাংলা/এমএ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন