বিজ্ঞাপন

বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতা- নারীর অবমাননা নাকি প্রতিষ্ঠা?

October 6, 2018 | 2:30 pm

রাজনীন ফারজানা।।

বিজ্ঞাপন

একজন নারী যদি ভাল ক্রিকেটার হতে চান, তাকে দারুণ ক্রিকেটীয় নৈপুণ্য দেখাতে হয়। নৃত্যশিল্পীকে দেখাতে হয় চমৎকার আর নিখুঁত নৃত্যশৈলী। জনপ্রিয় অভিনেত্রী হতে হলে তাকে দারুণ অভিনয়ে দর্শকের মন জয় করতে হয়। তাদের কারো কারো নাম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়লেও, কাউকেই বিশ্বের সেরা বলার সুযোগ নেই। তারা বড়জোর কোন ইন্ডাস্ট্রি কিংবা দেশ অথবা নিজ নিজ জগতে সেরা হন। অথচ প্রতিবছর  রীতিমতন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে একজন নারীকে বিশ্বের আবার কখনো মহাবিশ্বের (ইউনিভার্স) সেরা নারী উপাধি দিয়ে দেয়া হয়।

হ্যাঁ, বলছি মিস ওয়ার্ল্ড, মিস আর্থ, মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতার কথা। এইসব প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের প্রথম যোগ্যতা নারীর বাহ্যিক সৌন্দর্য। এরপর আসে মেধা যাচাই। সেরা সুন্দরীটি এক বছরের জন্য বিশ্বের বা মহাবিশ্বের সেরা নারী হিসেবে থাকেন। এক বছর বাদে আমরা নতুন মিস ওয়ার্ল্ড বা মিস ইউনিভার্স নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। যিনি এইসব যোগ্যতা দেখিয়ে সেরা নারীর উপাধি অর্জন করেন, পরবর্তীতে নিজের মেধা বা যোগ্যতা অনুযায়ী অভিনয়, মডেলিং কি জনকল্যানমূলক কাজে নিজের জায়গা করে নিতে না পারলে, একসময় তিনি হারিয়ে যান বিস্মৃতির অতলে। আমরা তাকে মনে রাখি না।

একইভাবে প্রতিবছর বিশ্বের সেরা পুরুষ অর্থাৎ মিস্টার ওয়ার্ল্ড বা মিস্টার ইউনিভার্সও নির্বাচন করা হয় কিন্তু সেই প্রতিযোগিতা তেমন আলোচনায় আসে না।

বিজ্ঞাপন

২০০০ সালে মিস ওয়ার্ল্ড খেতাবজয়ী প্রিয়াঙ্কা চোপড়া কিংবা তারও আগে ১৯৯৪ সালে মিস ইউনিভার্স খেতাবজয়ী সুস্মিতা সেনকে আমরা চিনলেও কয়জন স্টেফানি ডেল ভ্যালেকে মনে রেখেছি! অথচ পুয়ের্তোরিকোর স্টেফানি এইতো সেদিন ২০১৬ সালে মিস ওয়ার্ল্ড খেতাব জেতেন। এখন কেউ যদি তার সম্পর্কে জানতে চান তবে বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতার ইতিহাস গুগল করে কিংবা পুরনো নিউজপেপারেই তাকে খুঁজে পাবেন। কারণ, বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার পরে তিনি যদি অসাধারণ কিছু করতেন, তবে অবশ্যই বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেতেন। যেমনটা পেয়েছেন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, ঐশ্বরিয়া রায় কিংবা সুস্মিতা সেন, পরবর্তীতে অভিনয়ে মেধার পরিচয় দিয়ে।

স্টেফানি ডেল ভ্যালেকে না চিনলেও আমরা সঙ্গীতশিল্পী লেডি গাগা, মার্কিন উপস্থাপক ও প্রভাবশালী মিডিয়া ব্যক্তিত্ব অপরাহ উনফ্রে, জার্মানির প্রেসিডেন্ট এঙ্গেলা মার্কেলকে চিনি। এই নামগুলো ছাড়াও আরও অনেকেই আছেন যারা তথাকথিত সুন্দরের সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত না হয়েও বিশ্বের অন্যতম সেরা নারীর তালিকায় নিজের নামটি তুলতে সক্ষম হয়েছেন। একজন মাদার তেরেসা, ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেল কিংবা শেখ হাসিনাকে কোন টাইটেল জিতে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে হয়নি।

বিজ্ঞাপন

তাহলে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে কেন একজন নারীকে নিজেকে অন্যের চোখে বিচার করে দেখতে হয়? কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত ফরমেটে ‘জাজড’ বা বিচার হয়ে তাকে কেন নিজেকে বিশ্বের সেরা নারীর টাইটেল অর্জন করতে হবে?

এটা কি নারীর জন্য অবমাননাকর নয়? প্রশ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীনের কাছে। তিনি বলেন, সুন্দরী প্রতিযোগিতা অবমাননাকর, কেননা এই প্রতিযোগিতা নারী শরীরকে বস্তুকরণ করে। প্রতিযোগীদের অনেকটা চকচকে মোড়কের বস্তুর মত মনে হয়। প্রতিযোগিতা এই মোড়ককে এমনভাবে প্রধান করে তোলে যে, মনে হয়, মোড়কই পরমসত্য।

তিনি বলেন, সুন্দরী প্রতিযোগিতা একসময় শুধু দেহসৌষ্ঠবের প্রতিযোগিতা হিসেবেই শুরু হয়েছিল, পরে এর সাথে বুদ্ধিমত্তা নির্ণয় ইত্যাদিও যুক্ত হয়েছে। কিন্তু পুরো প্রতিযোগিতায় বুদ্ধিবিচারের পরিমাণ নগণ্য, এবং সেক্ষেত্রে মাপমাফিক শরীরের মতো, মাপমাফিক উত্তর দেওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যায়।

সুন্দরী প্রতিযোগিতার শুরুটা কেমন ছিল?

বিজ্ঞাপন

মধ্যযুগে মে ডে অর্থাৎ স্প্রিং ফেসটিভ্যাল বা বসন্ত উৎসব উদযাপিত হত। এই উৎসবে একজন মে কুইন নির্বাচিত হতেন। পরবর্তীতে আমেরিকাতে একজন তরুণীকে উৎপাদনশীলতা ও গোষ্ঠির আদর্শের প্রতীক হিসেবে নির্বাচনের রীতি প্রচলন হয়। এ ধরণের প্রতিযোগিতায় শুধুমাত্র অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়েরাই অংশ নিতে পারতেন।

এরপর উনিশ শতকে ১৩তম আর্ল অব এগলিংটন আর্চিবল্ড মন্টগোমারি মধ্যযুগীয় স্কটিশ রীতি ফিরিয়ে এনে আবারও সুন্দরী প্রতিযোগিতা চালু করেন। তিনি ১৮৩৯ সালে এগলিংটন ট্যুরনামেন্ট নামে এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন যেটিতে সমারসেটের ডাচেস জরজিয়ানা সেমোর বিজয়ী হন। তাকে ‘কুইন অব বিউটি’ বা সুন্দরীদের রাণি উপাধি দেওয়া হয়।

 

 

অন্যদিকে ১৮৫৪ সালে উদ্যোক্তা ফিনিস টেইলর বারনাম প্রথমবারের মত আধুনিক আমেরিকান সুন্দরী নির্বাচনের প্রতিযোগিতা আয়োজন করেন যা পরে গণরোষের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৮৮০ সালের দিকে এসে এ ধরণের প্রতিযোগিতা আবারও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে।

আন্তর্জাতিকভাবে প্রথম সুন্দরী প্রতিযোগিতা শুরু হয় আমেরিকায়। ১৯২০ সালে টেক্সাসের গ্যালভেস্টনে ‘স্প্ল্যাশ ডে’ নামে একটা প্রতিযোগিতা হয় যেখানে নানা দেশ থেকে যাওয়া সুন্দরী তরুণী ট্যুরিস্টরা অংশ নিতে পারতেন।

এ যুগের সুন্দরী প্রতিযোগিতার শুরুটা মূলত বাণিজ্যিক। অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, পুঁজিবাদী ও ভোগবাদী সমাজে সুন্দরী প্রতিযোগিতা কমে তো আসেইনি, বরং পণ্য প্রচারণা ও বিক্রয়ের সাথে যুক্ত হয়ে এর সংখ্যা ও মাত্রা বেড়েছে। প্রতিযোগিতার বিশ্বায়নের পাশাপাশি ব্যবসায়িক প্রয়োজনে সুন্দরী প্রতিযোগিতাকে প্রাসঙ্গিক করে রাখা হয়েছে। যার ফলে রূপ দিয়ে নারীকে বিচারের মানদন্ড অক্ষুন্ন থাকছে।

১৯৪৬ সালে বিকিনি আবিষ্কারের পর বিকিনিকে জনপ্রিয় করতে আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতায় নারীদের বিকিনি পরে অংশ নিতে হত। কিন্তু ক্যাথলিক চার্চ ও পোপের আপত্তিতে সুন্দরী প্রতিযোগিতা থেকে বিকিনি রাউন্ড বাদ দেওয়া হয়। এরপর রক্ষণশীল দেশগুলো থেকেও বিকিনির ব্যাপারে আপত্তি ওঠে। নানা সময়ে বিতর্কিত হওয়ায় ২০১৪ সালে অন্যতম বিউটি প্যাজেন্ট মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতা থেকে বিকিনি রাউন্ড বাদ দেওয়া হয়।

 

 

কিন্তু বিকিনি রাউন্ড বাদ দেওয়ার মানেই কি সুন্দরী প্রতিযোগিতা থেকে শারীরিক সৌন্দর্যের প্রদর্শন বাদ দেওয়া হয়েছে? কিংবা এর মাধ্যমে নারীর মর্যাদা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে? তাই যদি হত তবে বিশ্বের সেরা নারীকে কেন অবিবাহিত আর তরুণী হতে হয়! কিংবা যে নারীর সন্তান হয়েছে তার বয়স কম আর আকর্ষণীয় শারীরিক অবয়বের অধিকারী হলেও তিনি এ ধরণের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেন না। এর সাথে কি নারীর কুমারিত্বর গুরুত্ব বা কিংবা সেই মধ্যযুগীয় ‘সিম্বল অব বাউন্টিফুলনেস’ জড়িত নয়?

অর্থাৎ স্বাস্থ্যবতী অল্পবয়সী মেয়েরা, যারা সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে পারবেন তারাই সুন্দর হিসেবে বিবেচিত হবেন। এই যদি সৌন্দর্যের প্রতীক হয় তবে যাদের বয়স তিরিশের উপর বা যিনি সন্তান জন্ম দিয়েছেন তিনি আর কোনভাবেই বিশ্বের সেরা নারী কিংবা সেরা সুন্দরী নারীর উপাধি পেতে পারবেন না। এটা কি এক ধরণের বৈষম্য নয়?

একজন নারী কিংবা পুরুষের সৌন্দর্যের মানদণ্ড নির্ধারণ করে দেওয়া কি বাকি মানুষদের জন্য অবমাননাকর নয়? জানতে চেয়েছিলাম অভিনেত্রী শম্পা রেজার কাছে। তিনি গত বছর মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ প্রতিযোগিতার একজন বিচারক ছিলেন। তিনি বলেন, আমার কাছে সব মানুষই শুধু না সব সৃষ্টিই সুন্দর। সৌন্দর্যের কোন মানদণ্ড নাই। তবে এ ধরণের (সুন্দরী) প্রতিযোগিতার কথা যদি বলেন তবে বলব এটা আসলে এক ধরণের বাণিজ্যিক চিন্তা থেকে করা হয়। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করে এখানে, তাই তারা তাদের মানদণ্ড অনুযায়ী বিচার করে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মানুষকে জাজ করার পক্ষে নই। তবে গতবছর বিচারক হতে রাজী হয়েছিলাম এই ভেবে যে, একটা প্ল্যাটফর্ম পাচ্ছে মেয়েরা নিজেদের যোগ্যতা প্রদর্শন করতে। এর মাধ্যমে তারা মিডিয়া কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রে একটা জায়গা করে নিতে পারছে।

শম্পা রেজার মত একই কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. শাইখ ইমতিয়াজ। তিনি বলেন, পুরোটাই একটা পুঁজিবাদী খেলা।  সুন্দরী প্রতিযোগিতার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে তিনি বলেন, এ ধরণের প্রতিযোগিতা যেহেতু সরাসরি বিজনেস ওয়ার্ল্ডের সাথে জড়িত তাই ভোগবাদিতার এই যুগের জন্য তা প্রাসঙ্গিক। ড. শাইখ মনে করেন, প্রত্যেকটা মানুষই সুন্দর আর সৌন্দর্যকে সংজ্ঞায়িত করা নিষ্প্রয়োজন।

আরও পড়ুন, ডার্ক অ্যান্ড লাভলী- বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী ছবি

এদিকে অভিনেতা আরেফিন শুভ মনে করেন,  সৌন্দর্যের মানদণ্ড সময়ের সাথে সাথে এবং ব্যক্তিভেদে বদলে যায়। এখন যেমন ভিক্টোরিয়া’স সিক্রেট ব্র্যান্ডে ত্বকে শ্বেতীর দাগ আছে  কিংবা প্লাস সাইজ মডেলও নিচ্ছে যা আগে কল্পনাও করা যেত না। আর সুন্দরী প্রতিযোগিতাকে শুভ শুধুমাত্র একটা প্রতিযোগিতা হিসেবেই দেখেন। নাসায় যোগ দিতে যেমন কিছু নির্দিষ্ট যোগ্যতার প্রয়োজন হয় তেমনি এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেও কিছু মানদণ্ড নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। যিনি এতে অংশ নিচ্ছেন তিনি বুঝেশুনেই আসছেন, তাই এটাকে অবমাননাকর বলা যায়না বলে মনে করেন তিনি।

সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করে সাধারণত পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলো যারা পরবর্তীতে বিজয়ীদের দিয়ে পণ্যের প্রচারণা করায়। তাই ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এই প্রাসঙ্গিকতা কমেনি বরং বেড়েছে।

বাংলাদেশে যেসব সুন্দরী প্রতিযোগিতা হয় সেগুলোর মাঝে অন্যতম লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে এশিয়াটিক জেডাব্লিউটি। কথা হল এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফেরদৌস হাসান নেভিলের সাথে। তিনি বলেন, এ ধরণের প্রতিযোগিতা কয়েকজন নারীকে একটি প্ল্যাটফর্ম দেয়, যা থেকে তারা পরে দারুণ কিছু করার সুযোগ পায়। কারো জীবনে এই পরিবর্তন যদি ইতিবাচক হয় তাহলে এ প্রতিযোগিতায় কোন সমস্যা রয়েছে বলে মনে করেন না তিনি। ফেরদৌস হাসান আরো বলেন, প্রতিযোগিতার সুযোগ নিয়ে কোন নারীকে হয়রানি (exploitation) করা না হলে বা তার সাথে খারাপ কিছু না ঘটলে হলে এ ধরণের আয়োজন বরং একজন নারীকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ দেয়।

গীতি আরা নাসরীন বলেন, এসব সুন্দরী প্রতিযোগিতা যে দক্ষতাগুলো শেখায়, তা পরে কতখানি কাজে লাগে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তিনি আরও বলেন, এই যে নির্দিষ্ট শরীরের মাপ, প্রসাধন ব্যবহার, বিশেষ ঢঙে কথা বলা বা হাঁটা কতখানি উপযোগী গুণ বা দক্ষতা তা  নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। সুতরাং, সুন্দরী প্রতিযোগিতা কিছু ক্ষুদ্র বিষয়কে সকল নারীর আরাদ্ধ বলে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সেটাকেই আমি সমস্যা বলে মনে করি।

 

 

তবে ফেরদৌস হাসান বলেন, সুন্দরী প্রতিযোগিতায় শুধুমাত্র শারীরিক সৌন্দর্যই দেখা হয় না, এখানে প্রাথমিক পর্যায়ে বুদ্ধিমত্তা নির্ণয়ের পরীক্ষাও নেওয়া হয়। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বিউটি প্যাজেন্টে বিজয়ীরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার শুভেচ্ছা দূত হয়ে নানান সেবামূলক কার্যক্রমে অংশ নিয়ে থাকেন। এসব প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকে তিনি ফ্রিডম অব চয়েস বা ব্যক্তির নিজস্ব বিশ্বাস বা পছন্দ বলে মনে করেন। তাই তার মতে এটা কারও জন্য অবমাননাকর নয়।

ড. শাইখ ইমতিয়াজ বলেন, ‘বাংলাদেশের সুন্দরী প্রতিযোগিতা নিয়ে আমার আপত্তি নাই যদি এসব প্রতিযোগিতায় আন্তর্জাতিকভাবে ঠিক করে দেওয়া মানদণ্ড অনুসরণ না করে চিরকালীন বাঙালি সৌন্দর্য তুলে ধরা হয়।’

তবে তিনি মনে করেন নারীর এগিয়ে যাওয়ার জন্য শারীরিক সৌন্দর্য গুরুত্বপূর্ণ নয়।

গীতি আরা নাসরীন বলেন, বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে অন্তঃস্থ সৌন্দর্যের ওপর জোর দেওয়ার একটি শিক্ষা বিভিন্ন সংস্কৃতিতে আছে। কিন্তু সৌন্দর্যের যে বিভিন্নতা ও বোধ, সেটি এ ধরণের প্রতিযোগিতায় অস্বীকার করা হয়।

আর আরেফিন শুভ বলেন, মানুষের দেখার চোখের উপর সৌন্দর্য নির্ভর করে। কাউকে মিস ওয়ার্ল্ড বা মিস ইউনিভার্স ঘোষণা করা টা লাইফ ডিফাইনিং বা সবার জন্য আজীবনের জন্য সত্য হয়ে যায় না।

 

বাজার সংস্কৃতিতে পণ্যের বেচাকেনাই সবচাইতে গুরুত্ব পায়। এখানে পণ্যের প্রচারণা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সৌন্দর্য নিয়ে সারা পৃথিবীতেই বিরাট ব্যবসা হয়। বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো রঙ ফর্সা করার, চর্বি ঝরানোর, ঝলমলে চুল, ঝকঝকে দাঁত, ত্বকের দাগ দূর করার পণ্য তৈরি করে। অর্থাৎ তারা সৌন্দর্যের মানদন্ড ঠিক করে দিয়ে পণ্য বানাচ্ছে তারপর মনোলোভা বিজ্ঞাপন বানিয়ে সেগুলো বিক্রি করছে। আর এজন্য তাদের প্রয়োজন একজন সুন্দর মানুষ যিনি বলবেন এই পণ্য ব্যবহার করে তিনি সুন্দর হয়েছেন। অর্থাৎ সবাই মিলে প্রচার করছে সুন্দর হওয়াটাই যেন জীবনের লক্ষ্য। সুন্দর না হলে চাকরি পাবেনা, বিউটি কুইন না হলে বিয়ে হবেনা, সুন্দর না হলে সমাজে কোন সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাবে না। আর পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলো পৃথিবীর বা মহাবিশ্বের সেরা সুন্দরী হিসেবে যাকে নির্বাচন করছে, এই বক্তব্যের প্রতিনিধিত্ব করছেন তারা। সাধারণ মানুষের উপর এইসব প্রচারণার দারুণ প্রভাব পড়ে আর বারবার দেখতে দেখতে একসময় প্রভাবিত হয়ে মানুষ সেইসব পণ্য কেনে। তাই এসব বিউটি প্যাজেন্ট নিয়ে প্রচুর প্রচারণা চলে।

অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, খেলাধুলা, অভিনয় বা কর্মক্ষেত্রে নারীর এগিয়ে চলা কিংবা সাফল্যের চাইতে সুন্দরী প্রতিযোগিতা গণমানুষের কাছে কেন এতটা গুরুত্ব পায়?

তিনি বলেন, নারীর ক্ষেত্রে ‘আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী’, এই দৃষ্টিভঙ্গি, বা রূপ দিয়ে নারীকে বিচারের দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে এখনও রয়ে গেছে। এ ধরণের প্রতিযোগিতা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সেই সনাতনী ধারণাকেই পুণঃদৃঢ় করে। তিনি আরও বলেন, সমাজে সুন্দরী না হতে পারার ব্যর্থতার ধারণা চালু আছে। এমনকি নারীর অধিকার চাইছেন যারা, তাদের অসুন্দরী বলে উপহাস করার প্রবণতা আছে।

বানিজ্যিকীকরণ হোক কি বস্তুকরণ, তার মূলে গণমাধ্যমের ভূমিকাও রয়েছে প্রচুর। অধ্যাপক নাসরিন বলেন, গণমাধ্যম যেমন কোনো ছাঁচে ঢালা ধারণা জিইয়ে রাখতে সাহায্য করে, তেমন নতুন ইমেজও তৈরি করতে পারে। কিন্তু মূলধারার গণমাধ্যম যেহেতু এই বাজার ব্যবস্থারই অংশ তাই গণমাধ্যমকে আমরা সুন্দরী প্রতিযোগিতার সহায়ক হিসেবেই কাজ করতে দেখি।

বিউটি প্যাজেন্ট বা সুন্দরী প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নারীরা তাদের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ পেলেও বিউটি স্ট্যান্ডার্ড বা সৌন্দর্যের মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিয়ে নারীর কম উচ্চতা, কম পেলব ত্বক, অমসৃণ চুল যে অসুন্দর তা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। এ ধরণের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সব মানুষ সমান, এই কথাটা তাই শুধুমাত্র তত্ত্বেই রয়ে যাচ্ছে।

দ্য লাই পিকচারস টেল: এক মডেলের নিখুঁত ছবির লুকোনো গল্প
দ্য লাই পিকচারস টেল: এক মডেলের নিখুঁত ছবির লুকোনো গল্প (শেষ অংশ)
নারীর রূপ ও শরীরের গঠন- সমাজের মাথাব্যাথা ঘুচবে কবে?
মেধা সাহস আর উদ্যমের অভূতপূর্ব মিশ্রণ বেগম রোকেয়া

সারাবাংলা/আরেএফ/ এসএস

 

 

 

 

 

 

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন