বিজ্ঞাপন

দারিদ্র্য-প্রতিবন্ধকতা মহসিনকে বন্দি রাখতে পারেনি

October 6, 2018 | 7:30 pm

।। মুশফিক পিয়াল, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর ।।

বিজ্ঞাপন

একটা সময় গড়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ফর ফিজিল্যালি চ্যালেঞ্জড টিম। নানান প্রতিকূলতা আর সমস্যায় সেখানে টিকে থাকা হয়নি। পরে গড়ে তোলেন হুইলচেয়ার ক্রিকেট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ। দলের অধিনায়ক মোহাম্মদ মহসিন। সারাবাংলার সঙ্গে আলাপকালে অনেক অজানা কথাই জানিয়েছেন মহসিন। কিভাবে ক্রিকেটের ময়দান থেকে বিশ্ব দরবারে উঠে আসলেন সে গল্পই শোনালেন।

দারিদ্র্য তো ছিলই, উপরন্তু মহসিন ছিলেন প্রতিবন্ধী। তবে খেলাধুলা তাকে টানত। বিশেষ করে ক্রিকেট। শরীর বাধ সাধলেও মনে জেদ চাপে। সে থেকেই মাঠে যান। নানা প্রতিবন্ধকতা তাকে বন্দি করে রাখতে পারেনি। ক্রিকেটকে নিজের ধ্যানজ্ঞান মনে করে এগিয়েছেন সামনে দিকে। যখন হুইলচেয়ার ছিল না তখন মাটিতে বসেই ক্রিকেট খেলেছেন।

নিজের ক্রিকেট ধ্যানজ্ঞান আর লক্ষ্যের কথা জানাতে গিয়ে মহসিন বলেন, টঙ্গীর এক অজোপাড়া গাঁ এর কৃষক পরিবারে জন্ম আমার। বাবা কৃষি কাজ করেন আর মা গৃহিণী। দারিদ্রতার মাঝেই বেড়ে উঠতে থাকি। পাঁচ বছর বয়সেই পোলিও-আক্রান্ত হওয়ায় শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সঙ্গী হয় আমার। শুরু নতুন সংগ্রাম। সংগ্রামটা নিজের সাথে, নিজের পারিপার্শ্বিকতার সাথে। জীবন থেমে থাকতে হয় না বলেই থেমে যায়নি তখন। নিজের ভেতর সঞ্চয় করতে থাকি সাহস। চালিয়ে যাই লেখাপড়া। তবুও, খেলাধুলার প্রতি একটা বাড়তি আগ্রহ যেন আমাকে প্রতিনিয়ত টেনে নিয়ে যেতে শুরু করে খেলার মাঠে। আগ্রহটা আরো মজবুত হতে থাকে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আইসিসি ট্রফি জেতার পর থেকে। তখন নিজের মনের মধ্যেও এক ধরনের স্বপ্ন জন্ম নিতে শুরু করে। আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম, একদিন আমিও ক্রিকেট খেলব। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দেব বুলবুল ভাই, আকরাম ভাইদের মতো করে। ধীরে ধীরে ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা আরও বেড়ে চলতে শুরু করে।

বিজ্ঞাপন

মহসিন আরও জানালেন, ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রতিটা বিজয় আমাকে আমার ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখার পথে আরো অনুপ্রাণিত করতে থাকে। কিন্তু শারীরিক সমস্যার কারণে খেলাধুলা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে আমার জন্য। তবুও, নিজের মধ্যে এক প্রকার জেদ কাজ করত ক্রিকেটকে নিয়ে। সীমাবদ্ধতা একটা বাধা হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু, আমার নিজ এলাকায় বন্ধুদের মনমানসিকতা ও মননশীলতা আমাকে এই বাধা উৎরাতে সাহায্য করে। আমিও ক্রিকেট খেলতে শুরু করি। ধীরে ধীরে পুরোদমে ক্রিকেট খেলার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যাই আমি। যখন যেভাবে সুযোগ পেতাম ক্রিকেট খেলতাম। অনেক স্বপ্ন বাঁধতে শুরু করে দিলাম ক্রিকেট নিয়ে। মনে মনে ইচ্ছা পোষণ শুরু করি, বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়ে ক্রিকেট দল গঠনের।

নানান প্রতিকূলতার মধ্যেই গড়ে তুলি বাংলাদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ফর ফিজিল্যালি চ্যালেঞ্জড। কিন্তু, এক পর্যায়ে নানান সমস্যাজনিত কারণ দেখিয়ে এই সংগঠনের যারা ঊর্ধ্বতন পদে ছিলেন তারা হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী খেলোয়াড়দেরকে দলে অন্তর্ভুক্ত না করার প্রক্রিয়া চালু করেন। যা আমার মতো বহু হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ক্রিকেট খেলোয়াড়দের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়। কারণ, তারাও স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করবে ক্রিকেট খেলার মাধ্যমে। আমরা সুযোগ না পেলেও পার্শ্ববর্তী দেশে প্রতিভাবান হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী খেলোয়াড়রা তাদের জাতীয় প্রতিবন্ধী দলে সুযোগ পাচ্ছে। এছাড়াও, তারা আলাদা করে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ক্রিকেট দল গঠন করেছে এবং তাদের কর্মসূচির অনুসারী হয়ে অন্য ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলো তাদের হুইলচেয়ার ক্রিকেট দল গঠন করছে।

বিজ্ঞাপন

মহসিন থেমে থাকেননি। নিজের প্রিয় জায়গা থেকে বিতাড়িত হলেও সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। আবারো জেগে উঠার চেষ্টা করেন। তিনি যোগ করেন, হুইলচেয়ার ক্রিকেটারদের কথা চিন্তা করে আমি আবারো ব্যক্তিগত উদ্যোগ নেই হুইলচেয়ার ক্রিকেট দল গঠনের জন। কথা বলি, আমার বন্ধু মো. মাহবুবুর রহমান চৌধুরী পলাশ ও শারীরিক প্রতিবন্ধী হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী আরেক ছোট ভাই নূর নাহিয়ানের সাথে। আমরা তিনজন একত্রিত হয়ে নতুন করে হুইলচেয়ার ক্রিকেট সংগঠন করার জন্য আবারো মাঠে নেমে পড়ি। গাজীপুর জেলার টঙ্গী থেকে গড়ে তুলি হুইলচেয়ার ক্রিকেট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ। আমরা বর্তমানে বাংলাদেশের সকল বিভাগীয় পর্যায়ে হুইলচেয়ার ক্রিকেটার বাছাইয়ের মাধ্যেমে আমাদের তত্ত্বাবধানে বিভাগীয় হুইলচেয়ার ক্রিকেট দল গঠনের কাজ শুরু করেছি।

নিজেদের লক্ষ্যের কথা জানাতে গিয়ে মহসিন বলেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হুইলচেয়ার ক্রিকেটের মাধ্যমে শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষদের তুলে ধরা এবং হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী প্রতিবন্ধী মানুষদের সার্বজনীন প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। একটা সমন্বিত সমাজ গঠনে খেলাধুলার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত করা, বিভিন্ন রকম কর্মশালার মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন এবং দক্ষ জনশক্তি হিসেবে প্রতিবন্ধী মানুষের আত্মপ্রকাশ ঘটানো আমাদের সংগঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ফর ফিজিল্যালি চ্যালেঞ্জড টিমে যখন ছিলাম, ২০১৪ সালের জুন মাসে ভারতে তাজমহল ট্রফি খেলতে যাই। ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে ২-১ ম্যাচে সিরিজ জিতে দেশে ফিরি ট্রফি নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দলকে গণভবনে ডেকে সংবর্ধনা দেন। সফলতা হিসেবে আমাদের দল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তিনটি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ও একটি রানার আপ ট্রফি অর্জন করেছে। এছাড়া, ২০১৭ সালে ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড ২০১৭’ অর্জন করেছে।

বিজ্ঞাপন

কথা প্রসঙ্গে মহসিন জানিয়েছেন, একটা দেশকে উন্নয়ন এবং সুনামের দিকে এগিয়ে নিতে হলে যেমন সব শ্রেণিপেশার মানুষের অংশগ্রহণ দরকার, তেমনি সব ধরনের মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। দেশের শতকরা ১০ ভাগ লোক কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার, যাদেরকে বিনোদনের সাথে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। সমাজে একজন মানুষ হিসেবে নিজের দক্ষতার যোগ্য প্রমাণ দিয়ে দেশের সুনামকে আরো গতিশীল করতে চাই এবং বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে একটি উন্নত জাতি হিসাবে দাঁড় করাতে চাই। খেলাধুলা যার মধ্যে অন্যতম ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করি, বিশেষ করে ক্রিকেট। সমাজে অন্য সব মানুষের মতো আমাদের রয়েছে মৌলিক এবং বিনোদনমূলক সকল চাহিদা। এই সকল চাহিদার তাড়নায় উজ্জীবিত হয়ে আমরা আমাদের সক্ষমতার ভিত্তিতে সব ধরনের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারি। যেমন দৈনন্দিন কাজকর্ম, চাকুরি, ব্যবসা-বানিজ্য, খেলাধুলা, নাচগান ইত্যাদি।

যদিও আমাদের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ওই কর্ম পরিবেশ থাকে না বা সুযোগ কম বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। যা আমাদেরকে মানসিকভাবে কষ্ট দেয়। আমাদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ থাকলেও ক্রীড়াঙ্গনে আমাদের অংশগ্রহণ খুবই কম, বিশেষ করে বর্তমান বিশ্বে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেটে। পাকিস্তান, ভারত, ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কার মতো আমরা নিজেদের বিশ্বের কাছে আরও বেশি বেশি প্রমাণ করতে চাই।

আজ মহসিনের জন্মদিন। সারাবাংলার পক্ষ থেকে এই টাইগারকে শুভেচ্ছা জানানো হয়।

সারাবাংলা/এমআরপি

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন