বিজ্ঞাপন

মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন ‘পা ভাঙা’ সেই তরিকুল

October 7, 2018 | 8:22 am

।। তৌসিফ কাইয়ুম, রাবি করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

রাবি: এখনও ঠিকভাবে হাঁটতে পারেন না। ক্রাচে ভর দিয়ে কোনোরকম দাঁড়াতে পারলেও একটু হাঁটলেই পায়ে ব্যথা শুরু হয়। ক্ষতস্থান থেকে মাঝে মাঝে পুঁজও বের হয়। দিন কাটছে বিছানায় শুয়ে-বসেই। এতে স্বাভাবিক চলাফেরা বন্ধ হয়ে গেছে তার। নানা সংকটে মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছেন তিনি।

বলা হচ্ছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলায় আহত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলামের কথা। পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি ওয়েব ডিজাইনের কাজ শিখছিলেন। শিক্ষাজীবন শেষ করেই পরিবারের হাল ধরবেন এমনই প্রত্যাশা ছিল তার। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনকালে ছাত্রলীগের হামলায় মারাত্মক আহত হয়ে তার স্বপ্ন আজ অনেকটাই মলিন।

জানা যায়, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত ২ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের পূর্ব দিক থেকে পতাকা মিছিল বের করেন। কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন তরিকুল। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এ কর্মসূচিতে হামলা চালায়। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তরিকুলের ওপর লাঠি, বাঁশ আর হাঁতুড়ি দিয়ে আঘাত করে। এতে তরিকুলের ডান পায়ের হাড় ভেঙে যায়, আঘাত পান কোমরেও।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, গত ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্স চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষা। পায়ের সমস্যার কারণে স্বাভাবিকভাবে পরীক্ষা দিতে পারছেন না তরিকুল। পরীক্ষার প্রথম দিন সহপাঠীদের সহযোগিতায় ক্রাচে ভর দিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হন। বেশিক্ষণ একভাবে স্থির থাকতে পারেন না তিনি। তাই বিভাগের সভাপতির কক্ষে বিছানার ব্যবস্থা করা হয়েছে তার জন্য। সেই বিছানায় কখনো বসে কখনো বা শুয়ে শুয়ে কোনোরকম পরীক্ষা দিচ্ছেন। পরীক্ষা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যালের সিক বেডের জন্য আবেদন করেও  বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে অনুমতি পাননি তরিকুল।

তিন ভাইবোন আর মা-বাবা নিয়েই তরিকুলদের পরিবার। তিন ভাইবোনই পড়ালেখা করছেন। তরিকুল পরিবারে দ্বিতীয় সন্তান। স্নাতক চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলেন তিনি। সংসার চালানোর জন্য বাবার কৃষি কাজই একমাত্র মাধ্যম। রাজশাহীতে এসে অনেক জায়গায় টিউশনি খুঁজেও পাননি। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় বাড়ি থেকে খুব সামান্য পরিমাণ অর্থ পেতেন তরিকুল। তা দিয়েই কোনোরকম পড়ালেখা ও থাকা-খাওয়া চালাতে হয় তাকে। আহত হবার পর পরিবার ও সহপাঠীদের সহযোগিতায় চিকিৎসার ওষুধের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

তরিকুল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন। ঘটনার দিন কোনো ক্লাস পরীক্ষা না থাকায় নিজ কক্ষেই ছিলেন তরিকুল। দুপুরের পর পতাকা মিছিল শুরু হলে আন্দোলনে অংশ নেন তিনি। সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কোটা সংস্কার আন্দোলনের আহ্বায়ক মাসুদ মোন্নাফ বলেন, ‘মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের কাছাকাছি আসতেই আনুমানিক বিকাল ৪টার দিকে ছাত্রলীগের কয়েকজন সন্ত্রাসী রামদা, হাতুড়িসহ দেশিয় অস্ত্র নিয়ে আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। তরিকুলকে একা পেয়ে তারা মারধর করে। পরে তাকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।’

সাতদিনেও শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ৯ জুলাই তরিকুলকে ঢাকায় নেওয়া হয়। সেখানে তার পায়ে অস্ত্রপোচার করা হয়। দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকার পর তরিকুল বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এ বছর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন। কিন্তু সহপাঠীদের অনুরোধে পরীক্ষা দিতে রাজি হন তরিকুল।

ভয়াবহ সেই ঘটনা আজও চোখের সামনে  ভেসে উঠলে আঁতকে ওঠেন তরিকুল। পায়ের দিকে তাকিয়ে নীরবে চোখের জল ফেলেন তিনি। তরিকুল বলেন, ‘আমার হাজার আকুতিতেও মন গলেনি ছাত্রলীগের। তারা আমাকে আঘাত করতেই থাকে। কেউ মাথায়, কেউ বুকে, কেউ কোমরে আঘাত করে। একজন তো হাতুড়ি দিয়ে পা টাই ভেঙে দিলো।’

বিজ্ঞাপন

পায়ের সমস্যা, চিকিৎসার জন্য অর্থের জোগান, আশানুরূপ পরীক্ষা দিতে না পারা এসব মিলিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন তরিকুল। তিনি বলেন, ‘পায়ের পাশাপাশি কোমরের ব্যথার কারণে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারি না। তিন মাস হয়ে গেলো। নিয়মিত ওষুধও খাচ্ছি। কিন্তু এখনও ব্যথা আছেই।’

তরিকুলের চিকিৎসকের বরাত দিয়ে মাসুদ মোন্নাফ বলেন, ‘তরিকুলের পায়ের হাড় পুরোপুরি ভাঙা ছিলো। অস্ত্রোপচারের পর পায়ের অবস্থা এখন অনেকটা ভালো। ডাক্তার বলেছে সুস্থ হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে।’

হামলাকারীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কি ব্যবস্থা নিচ্ছে জানতে চাইলে প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি পুলিশের দেখার কথা।’

তবে রাজশাহীর মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহাদত হোসেন বলেন, ‘হামলাকারীদের ব্যাপারে থানায় কোনো অভিযোগ বা মামলা করা হয়নি। যেহেতু এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপার, তাই তারাই ভালো জানেন।’

সারাবাংলা/এমও

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন