বিজ্ঞাপন

‘জ্ঞান ফিরলে দেখি, আমি লাশের ভেতরে শুয়ে আছি’

October 10, 2018 | 12:27 am

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: জ্ঞান হারিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলাম, সবাই ভেবেছিল আমি মারা গেছি। একটু পরপর আমি হুঁশ হারাচ্ছিলাম। তখনই জ্ঞান আসার পর একটু হয়তো নড়ে উঠেছিলাম, কানে ভেসে এলো কেউ একজন বললেন, ‘আমাকে একটু সহযোগিতা করেন, এই আপাটা বেঁচে আছেন মনে হয়। আমরা একটু বাঁচাই তাকে’। তারপর হয়তো আবার জ্ঞান হারিয়েছিলাম। যখন চোখ খুললাম, দেখি আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে- অনেক লাশের মধ্যে শুয়ে আছি, চারপাশে রক্ত আর রক্ত।

কথাগুলো বলছিলেন, ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় ‍গুরুতর আহত মাহমুদা বেগম। তিনি এখনো শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন কয়েক শ’ স্প্লিন্টার।

মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) ভাটারা এলাকায় গিয়ে কথা হয় মাহমুদা বেগমের সঙ্গে। তিনি বেগম বলেন, সেই বিকট আওয়াজ- এখনও সেই আওয়াজ আমার কানে বাজে। এখনও সেই আওয়াজ কানে ভেসে আসে। কী একটা আওয়াজ হলো! চোখে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না, কেবল ধোঁয়া আর ধোঁয়া। তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার তার। ছোট চাকরি করেন মাহমুদা বেগম। ছেলে ব্যাংকে চাকরি পেয়েছে ঠিকই, তবে মেয়ে এবং নাতি-নাতনির সংসার চাকা ঘুরছে অনেক কষ্টে। তবে রাজনীতি ছাড়েননি। বর্তমানে ভাটারা থানা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী তিনি। এর আগে ছিলেন আওয়ামী লীগের ভাটারা ইউনিয়নের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা।

বিজ্ঞাপন

বলছিলেন সেদিনের কথা, যখন থেকে বুঝতে শিখেছি- তখন থেকেই আওয়ামী লীগের সমর্থক। সেদিনও অফিস থেকে ছুটি নিয়ে গিয়েছিলাম সমাবেশে। সঙ্গে ছিলেন এলাকার আওয়ামী লীগের নারী সমর্থকরা। সমাবেশে গেলে অনেকে চা খেতে ডাকে, সেদিনও ডেকেছিল অনেকে। কিন্তু আমি গেলাম না, কারণ নেত্রীর ভাষণ চলছে। সবকিছু ঠিক চলছিল, হঠাৎ দ্রুম করে একটা আওয়াজ…।

নিজের বাম হাতটা সামনে বাড়িয়ে ডান হাতের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, ‘দেখেন-সেদিনের কথা বলতে গেলে গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যায়। এরপর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন মাহমুদা বেগম। আবারও বলতে শুরু করেন, এরপর আর কিছু জানি না। হুঁশ আসার পর দেখি, আমার চারপাশে শুধু রক্ত আর লাশ। যারা উদ্ধার করছিলেন, তারা ভেবেছিলেন- আমি হয়তো মারা গেছি। একটু পরপর আমি হুঁশ হারাচ্ছিলাম। তখনই জ্ঞান আসার পর একটু হয়তো নড়ে উঠেছিলাম, কানে ভেসে এলো কেউ একজন বললেন, ‘আমাকে একটু সহযোগিতা করেন, এই আপাটা বেঁচে আছেন মনে হয়। আমরা একটু বাঁচাই তাকে’। সেখান থেকে তারা আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

শুধু উদ্ধারকর্মীরা নন- আমার সঙ্গে যাদের সমাবেশে নিয়ে গিয়েছিলাম, তারাও ভেবেছিল আমি মারা গেছি। তারা বলছিল, ‘আমাদের লাশ আমাদের দিয়ে যান’। ওই মুহূর্তে ওরাও বুঝতে পারেনি যারা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে তারা উদ্ধারকর্মী। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে আবার একটু মাথা নাড়ি- যেন বুঝতে পারে আমি বেঁচেই আছি। বলতে বলতে খেই হারান মাহমুদা। সময় নেন কথা বলতে। সময় নিয়ে বলেন, সেদিন ওদের উদ্দেশ্য ছিল আমার নেত্রী শেখ হাসিনাকে মেরে ফেলা। প্রথম সারিতে যারা ছিল তারা চলে যাবে, পুরোপুরি আওয়ামী লীগ শেষ হয়ে যাবে। আজ যদি নেত্রী মারা যেতেন আমাদের অস্তিত্ব থাকতো না। নেত্রী ছাড়া কারও কাছে আমাদের মূল্য নেই। সেই ক্লাস নাইন থেকে আওয়ামী লীগ করি, জীবনে কখনও কোনও দিন পদের জন্য যাইনি।

মাহমুদা বেগমের কথা এলোমেলো হয়ে আসে। তিনি বলতে থাকেন, সেদিনের সেই জিনিসটা…। আইভি আপা ছিলেন…। তার আগের বৃহস্পতিবারও বাড্ডায় একসঙ্গে ছিলাম। যাদের পেছনে সেদিন গেলাম, যারা আমাদের নিয়ে গেল- তারাইতো আমাদের মূল্যায়ন করে না! আমাদের দেখলে তাদের মুখ কালো হয়ে যায়- যদি কিছু চেয়ে বসি! কিন্তু তাদের কাছে আজ পর্যন্ত কিছু চাইনি। আমরা নেত্রীর হাত থেকে পেয়েছি আমাদের চাওয়া সেই নেত্রীর কাছেই, আর কারও কাছে না।

জানালেন, এখন একটু ভালো থাকার আশায় তার চাওয়া- উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়া।

মাহমুদা বেগম

বিজ্ঞাপন

“এখনও রাতে ঘুমাতে পারি না। কখনও কখনও ঘুমের ওষুধ খেয়েও লাভ হয় না। শরীরে চারশোর বেশি স্প্লিন্টার রয়েছে। শীতে, পূর্ণিমা-অমাবস্যা তিথিতে পুরো শরীরে যন্ত্রণা হয়। রাত হলেই যন্ত্রণা বাড়ে। শীতের দিনে পা কুঁচকে যায়, পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারি না। এখনও বাম হাত দিয়ে কাজ করতে পারি না। ঢামেক হাসপাতালে নেওয়ার পর ১৫ দিন পর্যন্ত পা থেকে রক্ত ঝরা বন্ধ হয়নি। রক্তক্ষরণে যেন আমি মারা না যাই, তাই হাত দিয়ে রক্ত দেওয়া হতো। তিন মাস চিকিৎসা হয়েছে, প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, পরে বাড্ডা জেনারেল হাসপাতালে। এতো গেল শরীরের কথা। কিন্তু যে স্মৃতির ক্ষত মনে থেকে গেছে….যারা এই বর্বোরোচিত হামলা চালিয়েছে- তাদের বিচার চাই। তাদের উপযুক্ত বিচার চাই।” বলেন তিনি।

আরও বললেন, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হকের কথা খুব মনে পড়ে। রুহুল হক স্যার আমার ডাক্তার ছিলেন। তিনিই আমাকে সাহস দিয়েছিলেন। দুইবার পায়ে অপারেশন হয়েছে। তৃতীয়বারে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার আগে আমি রাজি হইনি। শুনেছিলাম আমার ডান পা কেটে ফেলতে হতে পারে। তাই আমি আর যাইনি। পা কেটে ফেললে আমি চলব কিভাবে! আমার যে তিন সন্তানই ছোট। কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে অপারেশন করিয়েছি। মাথা থেকে দুইটা স্প্লিন্টার বের করা হয়েছে। আরও আছে, মাথায় খুব যন্ত্রণা হয়।

মাহমুদা বেগম

কেবল একটাই ভয়- ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ৩ অক্টোবর কুপিয়েছিল। আমার অপরাধ ছিল আওয়ামী লীগ করি, -এবার যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না আসে, তাহলে হয়তো মেরেই ফেলবে। আমার মতো যারা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত অবস্থায় রয়েছে তাদের একমাত্র ভরসার স্থান শেখ হাসিনা। তিনি না থাকলে আমাদের দেখার কেউ থাকবে না। যদি ওদের (বিএনপি) হাত থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচেও যাই, তখন না খেয়ে পথে পথে থাকতে হবে, রাস্তায় মৃত্যু হবে।

কালের সাক্ষী হয়ে আছেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য আবুল কাশেমেরও। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরে প্রয়াত আইভি রহমানকে কোলে নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে ছিলেন, কমলা রঙের শার্ট পরা, ২৮ কিংবা ২৯ বছরের সেই তরুণ আবুল কাশেম। নিজ জেলা লক্ষ্মীপুরে আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে তার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু। ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সময় ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের (উত্তর) সহ-সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন আবুল কাশেম।

তিনি বলেন, প্রচণ্ড গরম, প্রচুর মানুষ। নেত্রীর বক্তব্যের পরপরই বিকট শব্দে চারদিকে অন্ধকার হয়ে যায়। মানুষের চাপে চলে গেলাম পাশের মার্কেটের কলাপসিবল গেটের সামনে। শতশত মানুষ আমাকে মাড়িয়ে যাচ্ছে। দেখলাম, সাহারা আপা, সুরঞ্জিত দাদার পুরো রক্তাক্ত। সাহারা আপাকে গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ভাবলাম, নেত্রীর কী অবস্থা! আসার পথে দেখলাম আইভি চাচি রাস্তায় পড়ে আছেন। দুই পা বিচ্ছিন্ন। তাকে কোলে নিয়ে দেখি শ্বাস চলছে কি না। কেউ একজন এসে গা থেকে শার্ট খুলে আইভি চাচির পা ঢেকে দিলো।

সে দিনের ঘটনা যদি বলতে যাই, পুলিশের পোশাক পরা লোকজনকে আমি গুলি করতে দেখেছি, পুলিশকে লাঠিপেটা করতেও দেখেছি। এত বড় ঘটনা ঘটার পর যেখানে পুলিশ মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য যে ভূমিকা রাখার দরকার ছিল- উল্টো তারা এগ্রেসিভ ভূমিকায় ছিল। সাধারণ মানুষ যারা আহতদের উদ্ধারের জন্য এগিয়ে এসেছিল তাদেরকেও লাঠিপেটা করেছে, তাড়িয়ে দিয়েছে।

সেদিন ঘটনাস্থল কেমন ছিল জানতে চাইলে আবুল কাশেম বলেন, কালো রাস্তা সেদিন রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। চারপাশে মানুষের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, যখন মনে হয়, ঘুম হয় না। সভ্য দেশে এটা কল্পনাতীত। এত বড় তাণ্ডবলীলা…এটা ভাবা যায় না। আমার পায়ে কয়েকটি স্প্লিন্টার ছিল, সেগুলো বের করা হয়েছে। কিন্তু অনেকেই আছেন, যারা শরীরে হাজার হাজার স্প্লিন্টার নিয়ে অমানবিক জীবন যাপন করছেন। এই হামলায় জড়িতদের সর্বোচ্চ সাজা চাই, বলেন আবুল কাশেম।

সারাবাংলা/এটি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন