বিজ্ঞাপন

দেবী- মিসির আলীর হত্যাপ্রচেষ্টা!

October 24, 2018 | 5:39 pm

মিসির আলী চরিত্রটি হুমায়ুন আহমেদের মাথায় প্রথম আসে যখন তিনি স্ত্রীকে নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন নর্থ ডাকোটার ফার্গো শহরে। এরপর তিনি একটু একটু করে চরিত্রটি নির্মাণ করেন। জীবদ্দশায় তিনি মিসির আলী উপন্যাসের কয়েকটি নাট্যরূপও দিয়েছিলেন।শক্তিমান পরিচালক এবং নির্দেশক হুমায়ুন আহমেদ এবং ক্ষণজন্মা অভিনেতা আবুল হায়াতের যুগলবন্দী সম্ভবত নান্দনিক উৎকর্ষের সর্ব্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন মিসির আলী চরিত্রটিকে। হাল আমলে সেই ধ্রুপদী মিসির আলীকে নির্মম ভাবে হত্যা করলেন পরিচালক অনম বিশ্বাস গং তাদের “দেবী” ছবিতে। লেখকের মৃত্যুর অনেক বছর পর কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র কিংবা কবির মৃত্যুর অনেক বছর পর তাঁর কবিতা নিয়ে গান নতুন কিছু নয়। সেক্ষেত্রে পরবর্তী প্রজন্ম অলিখিত স্বাধীনতা ভোগ করেন (যদিও তা মূল গ্রন্থ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত)। তাই প্রমথেশ বড়ুয়া, বুলবুল আহমদ, শাকিব খান, শাহরুখ খান কিংবা প্রসেঞ্জিত যেই করুক না কেন শরৎবাবুর দেবদাস কিন্তু খুব বিচ্যুত হয়নি। কিন্তু শিল্পের স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার সুক্ষ পার্থক্যটুকু ভুলে গিয়ে এক অসাধারণ উপন্যাসকে একেবারে পেপারব্যাক হরর-এ নামিয়ে আনা হয়েছে দেবী ছবিতে।

বিজ্ঞাপন

মিসির আলী কে আত্মভোলা দেখাতে তার দুপায়ে দুরকম চটিজুতা দেখানো হল। আবার সে মানুষটি বিকেলে এক বাসায় এলেন হাতে ছাতা নিয়ে। জীবনের অভিজ্ঞতায় জেনেছি কেবল আত্মভোলারাই নন অনেক ঠেঁটা পাব্লিকও ছাতা হারায়, সেখানে মিসির আলীর মত লোক যদি ছাতা বহনের অভ্যাস করেন তবে তার পুরো মাসের আয় ছাতার পিছনেই যাওয়ার কথা। তাও না হয় বুঝতাম যদি বৃষ্টি থাকতো। একেবারে শুকনা খটখটা দিনে মিসির আলীর হাতে ছাতা, হুমায়ুন সাহেবকে সরাসরি চপেটাঘাতের মত।

মূল কাহিনীতে অশরীরীরা রানুর আশেপাশে ঘুরঘুর করে, তাকে ডাকে। আর এখানে একেবারে ভয় দেখায়। আবার মাঝে মাঝে উপকারও করে। কেন ভাই? অশরীরীরা কি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন নাকি যে একবার ওয়ান ইলেভেনে যারে মাইনাস করতে চাই পরে আবার তারে টেনে তুলতে চাই?

একটি উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে যে কিনা স্মার্ট ফোনে চ্যাট করে সে বার কে-20 মডেলের টু ডোর পাবলিকা স্টারলেট গাড়ীতে চড়ে ভার্সিটি যায়। পরিচালক টাইম মেশিনের ফিঊশন করেছেন হয়ত তবে দর্শক একবার ভাবুন স্পিলবার্গ যদি ইন্ডিয়ানা জোন্সের হাতে চাবুকের বদলে একে ৪৭ ধরিয়ে দেন কি হত? মূল বইতে চিঠি দিয়ে নীলুর প্রেম হয় কিন্তু এখানে ফেক প্রোফাইলে চ্যাটিং করে। ঠিক আছে, সময়ের প্রয়োজনে বিগত শতকের দেবদাসের হাতে একালের হান্টার বিয়ার ধরিয়ে দেয়াটা পরিচালকের স্বাধীনতাই বটে!

বিজ্ঞাপন

যে মিসির আলী আত্মভোলা, পরোপকারী তিনি কিনা তাঁর কাছে আসা লোককে ভুল ঠিকানা দেখিয়ে দেন, তাও আবার মঘা ইঊনানি ক্লিনিক? মিসির আলীর ভদ্রতাবোধ তো একেবারে নীচে নেমে গেল। আবার কমোড নিয়ে কাতুকুতু বা কমোডে গোলাপ চাষ– ভদ্রতাবোধের সাথে তো রুচিও যায় যায়! ইনিই কি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মিসির আলী? তবে কাতুকুতুতে হাসিনি কারণ প্রথম দৃশ্যেই অহেতুক এক নরবলির ভয়ংকর ঘটনায় মুড ডাউন ছিল। হলের সবারও একই অবস্থা বলে মনে হল। অপঘাতে যেসব মেয়ে মারা গেলো সবাই ভুত হলো আর ছেলেগুলো হলোনা। এটা কি রকম ব্যাপার ভাই? এতো বেশি মেয়েদের দিকে পক্ষপাত কেন?

সৌমিত্র, সব্যসাচী থেকে শশী কাপুর অনেকেই ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কিন্তু কোথাও ধারাবাহিকতা লংঘিত হয়নি। কিন্তু মিসির আলীর চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী সে আবুল হায়াতের ধারাবাহিকতা রাখতে পারেননি।

মুল উপন্যাসটি অতিপ্রাকৃত এবং যুক্তি ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব নিয়ে। এক মেয়ের অতিন্দ্রীয় ক্ষমতা আর তার উৎস নিয়ে, এক মনোবিদের সেই দুর্জ্ঞেয় রহস্যভেদের সংকল্প নিয়ে। আর এর চলচ্চিত্রায়ন পুরোটাই হরর। কিন্তু অন্য সব ক্ষেত্রে ব্যাপক কল্পনার আশ্রয় নিলেও, সংলাপের ক্ষেত্রে অধিকাংশ জায়গাতেই একেবারে মূল বইয়ের কাট টু কাট- বোধহয় সৃষ্টিশীলতায় ঘাটতি পড়েছে। বাহ ভালো তো! ভালো না?

বিজ্ঞাপন

স্যামুয়েল বেকেট লিখেছিলেন– “বই ধ্বংস করা নরহত্যার চাইতেও বড় অপরাধ। কারণ মরনশীল মানুষ তো একদিন মরবেই কিন্তু বই তো অমর”। অনম বিশ্বাস একটি বই হত্যা করেছেন।

১৯৭১ সালে ডায়রিয়া বা কলেরায় অনেকে মারা গেছেন। কিন্তু আজো ৭১ বলতে আমরা মহান শহীদদের মনে করি। ৭১ তাই আমাদের কাছে শুধু একটি সংখ্যা নয়, এক আবেগ। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ৬৮ হাজার গ্রামে কেউ না কেউ রোগে মারা গেছেন। কিন্তু আজো সে দিনের কথা বললে আমরা সালাম, বরকত, রফিক জব্বারের কথা মনে করি। ঠিক তেমনি ১৭৫৭ আমাদের কাছে স্বাধীনতা হারানোর বছর, পলাশীর বছর, মীরজাফরদের বিশ্বাসঘাতাকতার বছর। ১৭৫৭ সালে নরবলি না হইয়ে ১৮৫৮ বা ১৭৫৬ হলেও সিনেমাতে কোন সমস্যা হতনা। অথচ পরিচালক বেছে নিলেন ১৭৫৭ সাল কে।

আফসোস, এটি নাকি সরকারি অনুদানের ছবি!

লেখক: কর্মকর্তা, ডিএইচএল

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এমএম

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন