বিজ্ঞাপন

বড়রা আরো সহনশীল হবেন আশা করি!

October 25, 2018 | 2:42 pm

ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে চরিত্রহীন বলেছেন একটি লাইভ অনুষ্ঠানে । এর বিরুদ্ধে সবাই প্রতিবাদ করবে এটাই স্বাভাবিক । প্রকাশ্যে একজনকে হেনস্তা করা এটা কোন সভ্য সমাজে হতে দেয়া যায় না । হোক সে নারী কিংবা পুরুষ। মাসুদা ভাট্টিকে এভাবে অপমানিত করার বিরুদ্ধে আমরাসহ অনেকেই প্রতিবাদ করেছি এবং করছি ।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু এরই মধ্যে ঘটে গেছে অন্য ঘটনা। এরই মধ্যে প্রগতিশীল লেখালেখির কারণে প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্রান্তে দেশছাড়া হওয়া লেখক  তসলিমা নাসরিন মাসুদা ভাট্টিকে নিয়ে একটা লেখা লিখেছেন । তিনিও মইনুল হোসেনের মতো মাসুদা আপাকে চরিত্রহীন বলেছেন । লেখাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে । পড়ার সুযোগ হলো । পড়লাম তার কথা । বুঝা গেলো অনেক আগের কোনও ঘটনায় তার ব্যক্তিগত ক্ষোভ রয়েছে মাসুদা আপার প্রতি । তার লেখা একটি বইয়ের সমালোচনা নিয়েই এই ক্ষোভ। স্বাভাবিকভাবে তিনি মনে করতেই পারেন মাসুদা আপা তার পক্ষে থাকবেন, সেটা তার চাওয়া । কিন্তু মাসুদা ভাট্টিরও তো স্বাধীনতা রয়েছে কোনটার তিনি পক্ষে থাকবেন, কোনটার নয়। তসলিমা নাসরিনের আরও ক্ষোভ সাংবাদিক, সম্পাদকরা তার পাশে সেভাবে ছিলেন না। সে অভিযোগও তিনি করতে পারেন। মাসুদা ভাট্টির পক্ষে নারী সাংবাদিকরা দাঁড়াচ্ছেন- তার পক্ষে দাঁড়াননি, সে ক্ষোভও তিনি প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ তিনি করতে পারেন না।

তসলিমা নাসরিন লিখেছেন “আমি তো জনপ্রিয় কলাম লেখক ছিলাম তখন, জনপ্রিয় লেখক ছিলাম, কই কোনও বিশিষ্ট সম্পাদক আর কোনও সিনিয়র সাংবাদিককে তো আমার বিরুদ্ধে হওয়া লাগাতার অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ করতে কোনওদিন দেখিনি! আমার মাথার দাম ঘোষণা করা হলো, আমার বিরুদ্ধে লক্ষ লোকের লং মার্চ হলো, আমার ফাঁসির দাবিতে সারাদেশে দিনের পর দিন মিছিল হলো, সরকার একের পর এক আমার বই নিষিদ্ধ করলো, আমার মত প্রকাশের বিরুদ্ধে মামলা করলো, আমাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিল, কই দেশের কোনও সম্পাদক বা সাংবাদিক কেউ তো টুঁ শব্দ করেননি। সে তো করেনইনি, বরং যে সব পত্রিকায় আমি নিয়মিত কলাম লিখতাম, সে সব পত্রিকার বিশিষ্ট সম্পাদকরা আমার কলাম ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছেন। এই যে আজ ২৪ বছর আমাকে অন্যায়ভাবে কোনও সরকারই দেশে ফিরতে দিচ্ছে না, কোনও বিশিষ্টজন তো মুখ খোলেন না। নারী সাংবাদিকরা আজ মাসুদা ভাট্টির পক্ষে প্রেস কনফারেন্স করছেন। নারীর সমানাধিকারের পক্ষে প্রায় ৪০ বছর লিখছি , লেখার কারণে আমাকে যে এত হেনস্থা করলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, কই কোনও নারী সাংবাদিক তো আমার পক্ষে না হোক, আমার ওপর হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনওদিন দুটো বাক্য উচ্চারণ করেননি !”

তসলিমা নাসরিন আপার ক্ষোভ থাকাটা স্বাভাবিক বলেই মনে করি । হতে পারে তিনি যেমনটা আশা করেছিলেন কোন কারণে মাসুদা আপা তখন হয়তো সেই ভূমিকা রাখতে পারেন নি । বিষয়টি নিয়ে মাসুদা আপার জবাবটাও পড়লাম । সামাজিক মাধ্যমে তিনি বিনয়ের সাথে তসলিমা নাসরিন আপার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন । তসলিমা নাসরিন আপা এক অপরাধের শাস্তি কয়বার দিবেন ..? এমন একটি প্রশ্নও করেছেন । ঘটনাটি বিশ বছর আগের বলেও মাসুদা ভাট্টি লেখায় উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন-

বিজ্ঞাপন

‘তসলিমা নাসরিন তার মতামত দিয়েছেন আমার সম্পর্কে। আমি সে সম্পর্কে আমার ব্যাখ্যা দিতে পারি মাত্র, এর বেশি আর কীই বা করতে পারি? তবে এমন একটি সময়কে ২০ বছর আগে লেখা সমালোচনার (যার জন্য বহুবার তিনি প্রকাশ্যে আমায় গাল দিয়েছেন) জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন যখন আমি কেবল আক্রান্তই নই, আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রশ্নটিও তিনি আমলে আনেননি, আমার চেয়ে তার এই নিরাপত্তা-সংকটের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি বোঝার কথা ছিল। আজকে তার দেওয়া চারিত্রিক সার্টিফিকেট নিয়ে যারা আমাকে তুলোধনুা করছেন তারাই প্রতিদিন তার মাথা চায়, নোংরা আক্রমণে জর্জরিত করে, কখনও বা তাকে দেশছাড়া করতে চায়। কিন্তু আজ আমার বিরুদ্ধে তারই দেওয়া ‘ভীষণ চরিত্রহীন’ তকমার বরাত দিয়ে আমাকে টুকরো টুকেরো করছে। জানি না, এতে কার লাভ কী হলো? কিন্তু কিছু একটা হলো নিশ্চই ।’

আপনি অন্য একজনকে সাহায্য করার ক্ষমতা অর্জন করেছেন । এটা আপনার কর্মের ফল। এ রকম সাহায্য করার ক্ষমতা সবার থাকে না । তসলিমা নাসরিন আপাকে আমি কখনও দেখিনি । উনার লেখা পড়েছি । আর মাসুদা আপার সাথে আমার দু’একবার দেখা হয়েছে । তবে বিভিন্ন টকশো’তে আমি তার কথা শুনেছি । আমি যখন এই পেশায় আসিনি তখন তসলিমা নাসরিন আপার সম্মন্ধে যে সব নেতিবাচক কথা শুনতাম তখন আমি সেটাই বিশ্বাস করতাম । কারণ তখন আমার বিচার বুদ্ধি এতোটা প্রসারিত ছিলনা । আমরা অনেক সময় এটা না বুঝে সমালোচনায় ঝাপ দিয়েছি । এটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। একজন নারীকে সমাজে কুপোকাত করা অনেক সহজ । যদি কেউ স্ব স্ব জায়গায় এগিয়ে যায় । তখন তাকে বিভিন্নভাবে হেনস্তার শিকার হতে হয় । পরিকল্পিতভাবে তার পেছনে লাগা হয় । কিভাবে তাকে নিয়ে বির্তকের তোলা হয় । বাজারে একটা কুৎসিত গল্প ছাড়া হয়, যা মানুষ খায়- এটাই সহজ কথা । আমাদের মনে রাখতে হবে পুরুষ শাষক সমাজে আমাদের বাস । আমাদের পথ মসৃণ না এখনো । আর আপনাদের সময়ের কথা এখন ভাবলে কিছুটা অনুভব করতে পারি সেটা অনেক কঠিন সময় ছিলো । ঘরে-বাইরে কখনো নারীর সহনীয় পরিবেশ ছিল না । মনে হয় মাঝে মাঝে প্রকৃতিগতভাবেই পরিবেশ ছেলেদের পক্ষে । তাদের জন্য ক্ষেত্র সব সময় প্রস্তুত থাকে । তাদের কারো সাথে আর একটা মেয়েকে পরিবেশ বা ক্ষেত্র তৈরি করে নিতে হয় । তারপর তার কাজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়। তসলিমা নাসরিন আপা আপনি একটু পেছনে তাকান দেখেন কয়টা মেয়ে বাইরে কাজ করতো ..? হ্যাঁ আপনাদের পথ ধরেই এ প্রজন্ম এগিয়ে যাচ্ছে । প্রতিটি সেক্টরে মেয়েরা কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে । তারা তাদের যোগ্যতা প্রমাণও করছে । কিন্তু সংখ্যায় এখনো কম। বিশেষ করে উচ্চ পদগুলোতে খুবই কম । আমরা আমাদের নিজেদের পেশায় কিভাবে আরো ভালো করতে পারি, আমাদের বাধাগুলো উপড়ে ফেলতে পারি সেই পরামর্শগুলো চাই ।

এখন পথ চলতে যেয়ে সেই চিন্তা চেতনার জায়গাটা একটু বেড়েছে । তাই তসলিমা নাসরিন আপাকে বলছি আপনার সাহসিকতার তুলনা হয় না । এখন যখন নিজের পেশায় বিভিন্নভাবে নির্যাতনের-অপমানের শিকার হই তখন মনে হয় আপনার কথা । আপনি শিখিয়েছেন মাথা সোজা করে চলতে । কিন্তু আপা, এই সমাজে এখন যখন একটা মেয়েকে প্রকাশ্যে চরিত্রহীন বলে তখন আমরা আপনাকে পাশে পেতে চাই । আপনিতো তাই শিখিয়েছেন । আপনার ব্যক্তিগত কষ্টের সাথে আমরাও সমানভাবে ব্যথিত । আমি অতি ক্ষুদ্র একজন মানুষ । আপনাদের মতো এতো বড় মাপের মানুষকে কিছু বলা হয়তো আমার সাজে না । ছোট মুখে হয়তো বড় কথা বলে ফেললাম । এরজন্য ক্ষমা করবেন । কারণ আমরা আপনাদের কাছ থেকে আরো সহনশীলতার আশা করি । আপনারা বড়রা আরো সহনশীল হন। নারীদের নিয়ে আর তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর শুনতে চাই না , দেখতেও চাই না । আমরা আপনাদের কাছ থেকেই শিখবো, একজন মানুষ আর একজন মানুষের বিপদে এগিয়ে আসবো …. যারা প্রকাশ্যে নারীদের হেনস্তা করে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো । আর একটি অনুরোধ সবাইকে করতে চাই- আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি কারো পক্ষ-বিপক্ষে নই । আমার মন যা বললো তাই লিখলাম ।

বিজ্ঞাপন

শাহজাদা পারভীন সাজু: বিশেষ প্রতিনিধি, জিটিভি

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন