বিজ্ঞাপন

‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নাগরিকদের জন্যও প্রতিবন্ধক’

October 27, 2018 | 8:16 pm

।। সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি শুধুমাত্র সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে না, এই আইন দেশের নাগরিকদের জন্যও প্রতিবন্ধক। তাই আইনটির আপত্তিকর ধারাগুলো সংশোধন করা না হলে এর বিরুদ্ধে সব শ্রেণির নাগরিকদের রুখে দাঁড়ানো উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

শনিবার (২৭ অক্টোবর) বিকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘মুক্ত গণমাধ্যম: প্রেক্ষিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। আইন ও মানবাধিকার বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ল’রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ) এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) একাংশের মহাসচিব শাবান মাহমুদ বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে তথ্য, আইন এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয়। সেখানে আইনমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছিলেন আমাদের এই উদ্বেগের জায়গাগুলোয় সংশোধনী আনা হবে এবং আইনটি চূড়ান্ত হওয়ার আগে সংশোধনী হবে কিন্তু সেক্ষেত্রে আইনমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন, তিনি কথা রাখেননি। এই একটি জায়গায় আমাদের উদ্বেগ, উৎকন্ঠা আরও ঘনীভূত হয়েছে। কোনো অবস্থাতেই সংশোধনী ছাড়া আইনটি বাস্তবায়ন বা কার্যকর হোক তা মেনে নিতে পারিনা। এই আইনটি পাশ করার মাধ্যমে সরকার নিজেদের স্বৈরাচারী সরকার বলে পরিচয় দেবে না বলে আমরা বিশ্বাস করি।’

বিজ্ঞাপন

দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, ‘আমাদের সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে সরকারের তৃতীয় একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দেখা গেল বৈঠকটি হওয়ার আগেই আইনটি পাস হয়ে গেল। এতে আমাদের উদ্বেগের কারণ রয়ে গেছে। এ আইনে আমরা মাত্র ৯টি ধারার বিষয়ে আপত্তি দিয়েছি। আমরা কিন্তু পুরো আইনকে প্রত্যাখ্যান করিনি। আইনটিকে আমরা ফেলেও দেইনি। আমরা শুধু বলেছি এই ধারাগুলো স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী। কোথায় পরিপন্থী তা আমরা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছি। এ আইনটি শুধুমাত্র গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য ক্ষতিকারক নয়। এটা আরও ব্যাপক। আমরা সরকারের প্রতি আস্থা রাখতে চাই। আস্থা রেখেই আমরা একটি সমাধানের পৌঁছাতে পারবো। আমরা রাস্তায় প্রতিবাদও করবো, সরকারের সঙ্গে আলোচনাও চালিয়ে যাব। আমরা এ প্রতিবাদে সারাদেশের মানুষকেও সম্পৃক্ত করতে চাই।’

আইনটির কয়েকটি ধারার অপ্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের দ্বারা ৫৭ ধারা যে বাতিল হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। ৫৭ ধারাটি থেকে যাচ্ছে। আইনটির ৫(৩) ধারাতে নিরাপত্তার জন্য গঠিত এজেন্সির কার্যক্রম বিধি দ্বারা পরিচালিত হওয়ার করা বলা হয়েছে। এর ফলে সরকার যখন যাকে মনে করবে তাকে ধরতে নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করতে পারবে। আইনটির ৮ (২) ধারায় পুলিশ দ্বারা কোনো কনটেন্ট বন্ধ করতে বিটিআরসি’কে ‘অনুরোধ’ জানানোর কথা বলা হয়েছে। এই অনুরোধ মূলত আদেশ। তাহলে এর দ্বারা বিটিআরসি পুলিশের অধীনস্ত হয়ে গেলো। এরপর ২৮ ধারায় কোনো ওয়েবসাইট বা কোনো মাধ্যমে কেউ কোনো বিষয়ে কারো বিরুদ্ধে কিছু প্রচার করে ফেললে সেটি এ আইনের মধ্যে যাবে এবং তার বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে। এর ধারার দ্বারা ৫৭ ধারার প্রতিফলন ঘটেছে। এছাড়াও আইনটির ২৩, ২৯ ও ৪৩ ধারা দ্বারা সাধারণ জনগণও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। যেখানে কোনো জামিন সংক্রান্ত বিধান নেই।’

ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ন্যায়সঙ্গতভাবে ব্যবহার হচ্ছে না। টানাহেঁচরা, গালিগালাজ করে আইনটি ব্যবহার হচ্ছে। তাই আইনটির ধারাগুলো সংশোধন প্রয়োজন।’

বিজ্ঞাপন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘এই আইনের অপরাধের সংজ্ঞায় অস্পষ্টতা আছে, যার ইচ্ছামত ব্যাখা ও অপ্রপ্রয়োগ করা সম্ভব। এই আইনে গুজব, ভাবমূর্তি, মূল্যবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ- শব্দগুলো রাখা হয়েছে। এগুলো নিয়ে সংজ্ঞা আসেনি। এই আইনের দ্বারা কোনো সংস্থাকে যদি অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হয় এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয় না তখন সেটি অবশ্যই কালো আইন। এই আইনের অধীনে পুলিশের ক্ষেত্রে তল্লাশি, জব্দ, গৃহে প্রবেশ, গ্রেফতারসহ বেশ কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পুলিশকে অবাধ দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধকতাও আইনটির বিধানে তুলে ধরা হয়েছে। তাই এ আইনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো প্রত্যেক মানুষের দায়িত্ব। এটি শুধু আইনজীবী, সাংবাদিকের সমস্যা নয়, এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সব নাগরিকের দায়িত্ব।’

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, ‘সবাই যদি মনে করি আইনটি সবার স্বার্থে এবং জনগণের স্বার্থে হয়নি, তবে আইনটি অবশ্যই সংশোধন করা যাবে। আইনটি কোনো বাইবেল নয় যে সংশোধন বা বাতিল করা যাবেনা। প্রধানমন্ত্রী যদি প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন তবে অবশ্যই বাস্তাবায়ন করবেন।’

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আইনটি ভালো করে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যে কাউকে যেকোনো অবস্থায় আইনটির অধীনে ফেলে দেওয়া যায়। বিশেষ ক্ষমতা আইনের থেকেও এটি ভয়ানক আইন। তাই শুধু সাংবাদিক নয় এই আইনের প্রয়োগের আগেই আমরা সকলেই আইনটি নিয়ে কথা বলি। এই আইনের অবশ্যই সংশোধনী হওয়া দরকার।’

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মোখলেছুর রহমান বাদল বলেন, ‘প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর অপপ্রয়োগটাও এগিয়ে যায়। সে লক্ষ্য নিয়েই আইনটি করা হয়েছে। তবে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের সংশোধনীর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি দেখবেন। তাই অবশ্যই যদি এ আইনের অপপ্রয়োগ হয় তবে আইনটির পরিবর্তন সম্ভব।’

বিজ্ঞাপন

সংগঠনের সভাপতি সাঈদ আহমেদ খান বলেন, ‘গণমাধ্যমকে ঘায়েল করার জন্য বেশ কিছু আইন আছে। মাঝে মাঝে প্রয়োগ হয় আবার হয় না বলেই আইনগুলো সম্পর্কে আমরা জানিনা। তা সত্ত্বেও সম্প্রতি ডিজিটাল সিকিউরিট আইন পাশ করা হয়েছে। আমরা দেখেছি কোন আইন করার আগে কোনো সুপারিশ থাকে। অথচ এই আইন করার আগে কোনো আইন কমিশনের কোন সুপারিশ ছিলো কিনা তা কিন্তু আমাদের জানা নেই।’

বৈঠকে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ন সম্পাদক মিজানুর রহমান খান। অনুষ্ঠানটি ল’রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি সাঈদ আহমেদ খানের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক হাসান জাবেদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত হয়।

সারাবাংলা/এজেডকে/এমও

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন