বিজ্ঞাপন

চেনার জন্য চীনে ।। পর্ব-৩

October 31, 2018 | 2:23 pm

পলাশ মাহবুব ।।

বিজ্ঞাপন

সিসিটিভি’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার স্ট্যাফেনি জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি গ্রেট ওয়ালের নাম শুনেছো?
ওদের ধারণা ওরা যেমন নিজের দেশের বাইরের দিন-দুনিয়ার খবর খুব একটা রাখে না, আমরাও বুঝি সেরকম। কিন্তু আমরাতো সেরকম না। বাংলাদেশিরা আশেপাশের খবরাখবর রাখে। গর্বিত বাংলাদেশি হিসেবে আমি মাথা নাড়ি।
গ্রেটওয়ালের কথা শুধু শুনিনি, দেখেছিও।
আমার কথা শুনে স্ট্যাফেনি ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায়।
দেখেছো! তুমি না বললে চীনে এটাই তোমার প্রথম ভিজিট, তাহলে কিভাবে সম্ভব? ছবিতে দেখেছো। বুঝতে পেরেছি।
এবার আমি উল্টো মাথা নাড়ি- না। বুঝতে পারোনি। আমি বাস্তবেই দেখেছি।
হোয়াট!
সন্দিহান স্ট্যাফেনির চোখ বড় বড় হয়ে যায়।
হাউ কুড ইট পসিবল!
বিস্মিত স্ট্যাফেনির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি আমি।
শোনো, আমাদের দেশে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আছে যার নাম ‘গ্রেটওয়াল’। সেই রেস্টুরেন্টে আমি বেশ কয়েকবার গিয়েছি। সো, বুঝতেই পারছো আমি গ্রেটওয়াল দেখেছি।
আমার জবাব শুনে স্ট্যাফেনিসহ উপস্থিত সবাই একচোট হাসে। হাসাহাসি শেষে আমরা রওনা করি গ্রেট ওয়ালের উদ্দেশ্যে।

গ্রেটওয়ালের ঢোকার গেটে আমরা।

চীনে এসে গ্রেটওয়াল না দেখা আর বিয়ে করতে গিয়ে কবুল না বলা একই কথা। চীন ভ্রমণের তৃতীয় দিন আমাদের জন্য গ্রেটওয়াল, দ্য মহাপ্রচারী দেখার ব্যবস্থা করেন আয়োজকরা। একই সঙ্গে দিনটি আমাদের জন্য উন্মুক্ত রাখা ছিল। যদি কেউ ইচ্ছে করে তাহলে সে গ্রেটওয়াল দেখতে যাওয়া বাদ দিয়ে হোটেলে বসে নিজের মতো সময় কাটাতে পারে। কিংবা করতে পারে দরকারি অন্য কোনও কাজ।
কিন্তু আমরা কি অত বোকা? কলা বেচতে এসে রথ দেখবো না, তা কি হয়! বিশে^র এগারো দেশ থেকে একত্রিত হওয়া আমরা আঠারো জনই গ্রেটওয়াল দেখার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে যাই। আমাদের সবাইকে নিয়ে গ্রেটওয়ালে উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় টিম বাস।

চীনের রাজধানী বেইজিং-এর একটা অংশ দিয়ে গ্রেটওয়াল চলে গেছে। বেইজিংয়ে ছাওয়াং ডিস্ট্রিক্ট থেকে সেখানে যেতে আমাদের ঘন্টাখানেকের মতো লাগলো। গ্রেটওয়াল যে আদতে বিশাল এক বস্তু সেটা বোঝানোর সব ব্যবস্থাই সেখানে করা আছে। যারা দেখতে আসেন তাদের প্রতি মুহুর্তে বোঝানো হয় একটা অসামান্য জিনিস দেখতে যাচ্ছেন তারা। গ্রেটওয়ালের কাছাকাছি এসে আমরাও সেই ভাব অনুভব করতে শুরু করি।
বাস থেকে নামার পর আমাদের একজন গাইড রিসিভ করেন। তিনি শুরুতেই গ্রেটওয়াল সম্পর্কে আমাদের কিছু ধারণা দিয়ে দেন। একই সঙ্গে বলে দেন তোমাদের উচিত হবে নিজেদের কিছুটা হালকা করে নেয়া।
গাইড আমাদের ওয়াশরুম দেখিয়ে দেন।
আমাদের সঙ্গে ছিলেন নেপালের ন্যাশনাল টেলিভিশনের সিনিয়র সাংবাদিক গাজুরধান রাই। গাজু দা, গুজগুজ করে বললেন, গ্রেটওয়াল দেখাতে এনে এখন টয়লেট দেখিয়ে দিচ্ছে কেন!
আফগানিস্তান ন্যাশনাল টেলিভিশন নেটওয়ার্কের বাশির আহমেদ শামীম তৃতীয় দফায় বেইজিং এসেছে। আগেও গ্রেটওয়াল দেখেছে সে। অভিজ্ঞতার আলোকে মাথা নাড়ে শামীম। তার মতে ওয়াশরুম দেখানোটা যুক্তিযুক্ত। কারণ গ্রেটওয়াল দেখার জন্য তোমাকে অনেকটা পাহাড়ি পথ হেঁটে উঠতে হবে। সুতরাং নিজেকে হালকা করে নেয়াই শ্রেয়।
শামীমের যুক্তি গাজু দাসহ আমাদের সবাই যুক্তিযুক্ত মনে করি। কারণ যে যত হালকা সে তত দ্রুত ওপরে উঠতে পারবে। এটাই স্বাভাবিক।
হালকা হয়ে আমরা নতুন আরেকটা বাসে উঠি। যে বাস লম্বা আর দীর্ঘ এক সিঁড়ির সামনে এনে আমাদের নামিয়ে দেয়। এখান থেকেই শুরু হবে গ্রেটওয়ালে ওঠার মূল যাত্রা।

বিজ্ঞাপন

উঠছি পাহাড়ি পথ বেঁয়ে।

গ্রেটওয়ালে ওঠার দুই ধরণের ব্যবস্থা আছে। আমাদের গাইড জানতে চাইলো, তোমরা কি পাহাড়ি পথ হেঁটে উঠতে চাও নাকি ক্যাবল কারে করে সেখানে যেতে চাও। ক্যাবল কারে গেলে সবাই একশ আরএমবি করে বের করো।
পকেটে হাত দেয়ার বদলে মাথায় হাত দেয় শ্রীংলকার সুরেন্দ্র আবেপালালা।
নো, নো। নো আরএমবি। উই ওয়ান্ট টু ওয়াক।
আমরা বাকিরা মাথায় হাত না দিলেও সুরেন্দ্রর পক্ষে মত দেই। ক্যাবল কারে উঠলে তো আশেপাশের কিছুই দেখতে পাবো না। আমরা হেঁটেই উঠবো।
শেষ পর্যন্ত আমরা হেঁটেই উঠি। এবং উঠতে গিয়ে টের পাই জীবনে যত ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি তার মধ্যে এটা অন্যতম। কারণ গ্রেটওয়ালে পৌঁছাতে প্রায় দুই হাজারের মতো আাঁকা-বাঁকা পাহাড়ি সিঁড়ি পেরুতে হয়েছে আমাদের। একশ সিঁড়ি পেরুনোর পরই আমরা হু-হা করে সিঁড়িতে বসে পরি। পাঁচ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে আবার ওঠা শুরু করি।
এন্কজিন এসেছে মোঙ্গোলিয়া থেকে। একমাত্র তাকেই দেখলাম গটগট করে ওপরে উঠে যাচ্ছে। এবং আমরা যখন মাঝে-মধ্যেই জিভ বের করে বসে পড়ছিলাম তখন সে বেশ বিরক্ত হচ্ছে।
হোয়াটস রং!
রেগে গেলে আমি আবার বাংলায় কথা বলতাম। এন্কজিনের ঢং দেখে বাংলায় বললাম, রং তো তুমি করতেছো। আমাদের জান বের হওয়ার দশা আর হে কয় হোয়াটস রং!
এন্কজিন আমার বাংলা বোঝে না, তবে হাসে। হাসতে হাসতে সে বললো, মঙ্গোলিয়াতে তার অফিস একটা পাহাড়ের ওপরে। প্রতিদিন তাকে একঘন্টা একঘন্টা মোট দুই ঘন্টা পাহাড়ে ওঠানামা করতে হয়।
এন্কজিনের কথা শোনার পর আমরা তার হোয়াটস রং-এর মর্মার্থ বুঝতে পারি।

গ্রেটওয়ালে।

গ্রেট ওয়ালকে চীনারা বলে ছাং ছং অর্থাৎ দীর্ঘ প্রাচীর। গ্রেট ওয়াল আদতেই বিশাল দৈর্ঘ্যরে এক দেয়াল। পাথর আর মাটি দিয়ে তৈরি এই দেয়ালের দৈর্ঘ্য ২১,১৯৬ কিলোমিটার। উচ্চতা স্থান ভেদে ৫ থেকে ৮ মিটার পর্যন্ত। চীনের মহাপ্রাচীর হচ্ছে মানুষের হাতে তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থাপত্য। পুরো চীনকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রেখেছে এই গ্রেটওয়াল বা মহাপ্রাচীর। প্রতিদিন প্রায় কয়েক লক্ষ দর্শনার্থী এই প্রাচীর দেখতে আসেন।

মিস লি’র সঙ্গে।

আমরা যখন গ্রেটওয়ালে পা রাখি তখন সূর্য প্রায় মাথার ওপরে। তবে শীতের দিন হওয়ায় সূর্যের উত্তাপ টের পাইনা আমরা। টের পাই মনের উত্তাপ।
গ্রেটওয়াল! বিশে^র শ্রেষ্ঠ সাত বিস্ময়ের একটি। আমরা দাঁড়িয়ে আছি তার ওপর। আমাদের অনেকের মধ্যে ওহ মাইগড! ওহ মাইগড শুরু হয়ে গেছে ততক্ষনে।
আমাদের দলনেতা এআইবিডি’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মিস লি। আমি তাকিয়ে আছি তার দিকে। ষাটোর্ধ্ব এই ভদ্রমহিলা পুরোটা পাহাড়ি পথ হেঁটে উঠছেন। একটু ক্লান্ত মনে হচ্ছে না তাকে। গ্রেটওয়ালে ওঠার পর আবার এখন বলছেন, চলো, আমরা সামনের দিকে মাইল দুয়েক পথ হেঁটে আসি। এসেছি যখন যতোটা সম্ভব দেখে যাই। কি বলো?

বিজ্ঞাপন

পলাশ মাহবুব : কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার। উপ সম্পাদক, সারাবাংলা।

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন