বিজ্ঞাপন

টেগোর টেরেস- মহানগরীর বুকে এক মুঠো রবীন্দ্রনাথ

November 2, 2018 | 1:11 pm

রাজনীন ফারজানা ।। 

বিজ্ঞাপন

হলুদ রঙের ঝকঝকে নতুন বহুতল ভবনটা তখন হেমন্ত বিকেলের মিঠে রোদে ঝলমল করে হাসছে। বনানীর এই বাড়িটাই খুঁজছিলাম।  খোঁজার কারণ, এই বাড়িটার ছাদে সবুজে ছাওয়া এক নতুন রেস্তোরা- টেগোর টেরেস। জায়গাটাকে ঠিক রেস্তোরার গণ্ডিতে আটকে রাখা যাবেনা।  একে বলতে পারেন, রবীন্দ্র আরাধনার মন্দির।

টেগোর টেরেস

বারোতলায় পৌঁছে লিফটের দরজা খুলতেই কাঁচের দেওয়ালের ওপাশে চোখে পড়বে সবুজ এক উদ্যান। সেই উদ্যানের ঠিক মাঝ বরাবর গোলাকার এক বেদির উপর বসানো রবি ঠাকুরের মুখ। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর অলোক রায়ের হাতে গড়া কবিগুরু এখানে যেন চোখ বুজে ধ্যানে বসেছেন। আর তাকে ছায়া দিতে পেছন থেকে ডালপালা মেলেছে একটি বকুল গাছ। এই বেদিটার চারপাশে ছড়ানো ছিটানো কিছু চেয়ার টেবিল। প্রথম দেখায় রেস্তোরা কম, কোন এক শৌখিন ব্যক্তির যত্নে গড়া ছাদ বাগান মনে হবে জায়গাটাকে।

বিজ্ঞাপন

টেগোর টেরেস

এটাই টেগোর টেরেস। যে টেরেসের প্রতিটা কোণে, প্রতিটা আঙ্গিকে মিশে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। টেগোর টেরেসের উদ্যোক্তা স্থপতি দম্পতি মুস্তাফা খালিদ পলাশ এবং শাহজিয়া ইসলাম অন্তন। কথা হল শাহজিয়া ইসলামের সাথে। তিনি বললেন, রবীন্দ্রনাথ আছেন তাদের সবটা জুড়ে। তাদের দিন শুরু হয় রবিঠাকুরের সাথে, দিনের শেষেও যেন তিনিই মিশে থাকেন। রবীন্দ্রনাথকে শুধু মননেই নয়, জীবনে ধারণ করেন তারা। শাহজিয়া ইসলাম বলছিলেন, ‘অনেক আগে থেকেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কিছু করার ইচ্ছা ছিল তাদের কিন্তু জীবনের নানা ব্যস্ততায় হয়ে ওঠেনি। এখন যখন অন্য কাজ কিছুটা কমে গেছে তখনই মনে হয়েছে এই ব্যাপারে একটু সময় দেই।’

টেগোর টেরেস

বিজ্ঞাপন

টেগোর টেরেস নামকরণ প্রসঙ্গে তিনি বললেন, রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় ছাদ উঠানের একটা কনসেপ্ট ছিল। অনেক কিছুই ছাদে অনুষ্ঠিত হত। বাল্মিকি প্রতিভাও ছাদেই মঞ্চায়িত হয়েছিল। ছাদেই ছিল নন্দন বাগান। তাই তাদের ইচ্ছা ছিল এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা যেখানে কিছুক্ষণের জন্য হলেও যেন মনে হয় ওই সময়েই চলে গিয়েছি। তাই নাম টেগোর টেরেস।
টেগোর টেরেস

টেগোর টেরেসে স্মৃতি ধরে রাখার উদ্দেশ্যে তাই পুরনো জিনিসের ব্যবহার চোখে পড়ার মত। এখানকার ডিজাইনের পুরোটাতেই রবীন্দ্রনাথের প্রভাব। ঢোকার দরজাটাই একটা ভারী কাঠের তৈরি এন্টিক খিড়কি দরজা। দরজার বাইরের দিকে সূক্ষ্ম কারুকার্য আর ভেতরের দিকে রবিঠাকুরের গান প্রিন্ট করা। এই অংশটাতে ঢুকতেই চোখে পড়বে ঘরময় সবুজ গাছাপালা, পেইন্টিংস, বইপত্র আর নানারকম এন্টিক জিনিসপত্র। এসব ঘিরে নানারকম সিটিং এরেঞ্জমেন্ট। টেবিলগুলোতে রবীন্দ্রনাথের খেরো খাতার লেজার করা। আর কাউন্টারের সামনের অংশে পাবেন আগুনের পরশমনির কথা।

টেগোর টেরেস

তারা ভরা রাত থিমে করা হয়েছে ভেতরের অংশের ছাদ। বাইরের রুফটপ অংশে সত্যিকারের আকাশে সত্যিকারের চাঁদতারা, মেঘ, বৃষ্টি সবেরই দেখা মিলবে। আবার ঘরের ভেতরেও অন্ধকার কৃত্রিম আকাশে অসংখ্য তারা জ্বলতে দেখা যায়। সবগুলো আলো যখন জ্বলে তখন উপরের দিকে তাকালে হঠাত করে বিভ্রম সৃষ্টি হয় আর মনে হয় সত্যিই বুঝি অমাবস্যার রাতে হাজার হাজার তারা জ্বলছে আর নিভছে। সেসময় চাইলে এখানে শুনতে পারবেন,

বিজ্ঞাপন

আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,

তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,

বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥

টেগোর টেরেস

টেগোর টেরেসে মাটির কাছাকাছি ভাবটা রাখতে ব্যবহার করা হয়েছে বাঁশের চিক। ভাস্কর্য আর কুশনেও রয়েছে বৈচিত্রের ছোঁয়া।

টেগোর টেরেস

কাউন্টারের একপাশে একসেন্ট ওয়ালে প্লাস্টারের উপর পড়েনি কোন রঙের প্রলেপ। বরং সেখানে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা স্থপতি ও চিত্রশিল্পী মুস্তাফা খালিদ পলাশের নিজের হাতে আঁকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ধূসর আর সাদার মিশেলে আঁকা রবীন্দ্রনাথ এখানে স্বপ্নময় দুটি শান্ত চোখ মেলে তাকিয়ে আছেন। এই ছবি যে দিকের দেওয়ালে সেই পাশের দেওয়ালের দুইদিকে দুটি করে রবিঠাকুরের স্কেচ। সেগুলিও মুস্তাফা খালিদ পলাশেরই করা।

টেগোর টেরেস

ঘরময় সাজানো এন্টিক জিনিসপত্রের মধ্যে আরও আছে, একটা পুরনো দিনের গ্রান্ডফাদার ক্লক, একশো বছরের পুরনো রেডিও, একটা গ্রামোফোন, সারিন্দা, তানপুরা ইত্যাদি।

টেগোর টেরেস

সারিন্দার পেছনের অংশে দারুণ কারুকাজ করা। এন্টিকের চমক আছে এখানকার ফ্রেশরুমেও। কাঁচের ছাদের নীচে ফ্রেশরুমের বেসিন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে একটা পুরনো দিনের বড় আকারের কাঁসার হাড়ি। এই হাড়িটা বসানো হয়েছে একটা খিড়কি দরজার একটা পাল্লার উপর। শুধু এই পাল্লাটাই যে এন্টিক তাই নয়, এখানকার আয়নাটাও পুরনো দিনের কাঠের কারুকার্য করা পাল্লা দেওয়া আয়না। রবীন্দ্রনাথের জীবনে তার সাথে বজরার সম্পর্ক ছিল ভীষণ। জমিদারীর দায়িত্ব পালনকালে তিনি কোলকাতা থেকে বাংলাদেশের শিলাইদহ কুঠিবাড়ি কিংবা শাহজাদপুর কাছারিবাড়িতে যাওয়া আসা করতে বজরা ব্যবহার করতেন। এই বজরায় বসেই সৃষ্টি হয়েছে তার অসংখ্য কালজয়ী রচনা। সেই স্মৃতিকে ধরে রাখতে টেগোর টেরেসের ফ্রেশরুমের একধারে কাউন্টারের উপর একটা ছোট বজরা রাখা হয়েছে।

টেগোর টেরেস

ছাদবাগানের মূল আকর্ষণ এখানে খোলা ছাদের নীচে সবুজ গাছাপালার মাঝে বসে একটা বই নিয়ে বা গান শুনতে শুনতে কাটিয়ে দেওয়া যাবে অনেকটা সময়। গাছাপালা পছন্দের ক্ষেত্রেও সবার আগে এসেছে রবি ঠাকুরের পছন্দ। এখানে আছে মাধবীলতা, বকুল, কামিনী, বেলী আর বিল্ডিঙের নীচে আছে রবিন্দ্রনাথের পছন্দের নীল অপরাজিতা।

শাহজিয়া ইসলাম বলেন, টেগোর টেরেস ঠিক ট্রিবিউটের উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছে তা না, রবীন্দ্রনাথের মাঝে ঘিরে থাকার ইচ্ছা থেকেই এমন করা। ছোট পরিসরে হলেও তাদের মত রবীন্দ্রপ্রেমী যারা তারা যেন এসে কিছুটা সময় মনের মত করে কাটিয়ে যেতে পারেন তাদের জন্যই করা। একইসাথে তরুণ প্রজন্ম যারা দেশি সংস্কৃতি, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে ভুলতে বসেছে তাদেরকে আকৃষ্ট করাও একটা উদ্দেশ্য। এখানে বই পড়া ও গান শোনার ব্যবস্থা আছে। রয়েছে রবীন্দ্রনাথের লেখা ও তাকে নিয়ে লেখা অনেক দুর্লভ আর মূল্যবান বইয়ের সংগ্রহ। এছাড়াও আছে শুদ্ধ সঙ্গীতের বিশাল সংগ্রহ। কাউন্টারের পাশে টিভিস্ক্রিনে চলবে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বানানো প্রামাণ্যচিত্র। এছাড়া কেউ চাইলে হেডফোন দিয়েও পছন্দের গান শুনতে পারবেন।

টেগোর টেরেস

এখানে এসে যখন কেউ বই পড়ে বা গান শুনে সময় কাটাবেন তখন খাওয়ার জন্য কিছু প্রয়োজন সেই উদ্দেশ্যে এখানে খাবারের ব্যবস্থা রাখা। বইয়ের তাকের পাশেই দেওয়ালের পেইন্টিঙে কবিগুরুর স্বপ্নময় দুচোখ যেন বলছে,

আজি হতে শতবর্ষ পরে

কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি

কৌতূহলভরে… 

অন্তন বলেন, ‘আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য খাবার নয়, মুখ্য উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথকে অনুভব করা।’ তাছাড়া ‘আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে ভুলতে বসেছি বলতে গেলে। বিশেষত নতুন প্রজন্ম যেন এর থেকে অনেকটা দূরে সরে গিয়েছে। তাদেরকে আকৃষ্ট করতেও অনেকটা সাথে খাবার দাবারের আয়োজন’, যোগ করেন তিনি। খাবার বাছাইতে তাই বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। মূলত ‘ড্রাই ফিঙ্গার ফুড’ অর্থাৎ হাত না ভেজে এমন খাবার রাখা হয়েছে এখানে। দেশি নাস্তা ঝালমুড়ি, বাদাম মাখা, চানাচুর মাখার পাশাপাশি এখানে পাওয়া যাবে তরুণদের পছন্দের স্যান্ডুইচ, বার্গার, ফ্রাপে, স্মুদি এবং নানারকম পানীয়। শুক্র শনিবার বা ছুটির দিনে এখানে পাওয়া যাবে লুচি, আলুর দম, সবজি, ঘরে করা দই ইত্যাদি।

টেগোর টেরেস

শাহজিয়া ইসলাম আরও বলেন, তরুণদের জন্য এখানে আলাদা করে কিছু নাই। তবে কারও মাঝে যদি বেড়ে ওঠা থেকেই বাংলা সংস্কৃতি, রবীন্দ্র, নজরুল থাকে তবে এই জায়গা তাকে আকর্ষণ করবে। তাদের আশা এভাবে আস্তে আস্তেই তাদের সংস্কৃতির প্রতি প্রেম বাড়বে। ইতোমধ্যেই ইতিবাচক সাড়া পেতে শুরু করেছেন বলেও জানালেন অন্তন। লোকজন এসে তাদেরকে বলছেন এমন পরিবেশ তারা খুঁজেও পান না। ধীর স্থিরভাবে এমন সুন্দর সবুজ পরিবেশের মাঝে বসে বই পড়ার বা গান শোনার লোভেই তারা আসছেন বলে জানিয়েছেন।

টেগোর টেরেস

এই ভবনের তৃতীয় তলাতেই আছে ঢাকা গ্যালারি। টেগোর টেরেসের অংশ না হলেও মাল্টিপারপাস এই হল আর আর্ট গ্যালারিটাও তাদের। অন্তন বলেন, তারা দুজনেই গান আর আবৃত্তি পাগল মানুষ। তাই এমন একটা স্বয়ংসম্পুর্ণ হল বানানো যেখানে আর্ট এক্সিবিশন হবে, আয়োজন করা যাবে অনুষ্ঠান। এখানে অত্যাধুনিক সাউন্ড প্যানেল, লাইটিং, প্রফেশনাল পেইন্টিং সব ব্যবস্থা রয়েছে।

টেগোর টেরেস

শাহজিয়া বলেন, ঢাকা গ্যালারি টেগোর টেরেসের অংশ না হলেও যার নীচে কোন অনুষ্ঠান বা আর্ট এক্সিবিশনে আসবেন তারা কিছু খেতে চাইলে টেগোর টেরেসে এসে কিছুটা সময় কাটানো সহজ হবে তাদের জন্য।

টেগোর টেরেসের সবুজে ঘেরা অঙ্গন কিছুক্ষণের জন্য হলেও টেনে নিয়ে যাবে পুরনো সময়ে, অনুভব করাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আর টেনে নিয়ে যাবে মাটির কাছাকাছি। তাই এখানে একবার আসলে ফেরার পথে কি ভেবে ছাদের দিকে মুখখানি ফেরানোর ইচ্ছাই যে জাগবে তাই নয়,  ‘মনে কি দ্বিধা’ না রেখেই বারবার ফিরে যেতে চাইবেন টেগোরের টেরেসে।

বনানী ১২’র ১২ নম্বর রাস্তায় ৪৪ নম্বর বাড়ির ছাদে আজ (২ নভেম্বর) উদ্বোধন হচ্ছে টেগোর টেরেসের।

 

ছবি- আশীষ সেনগুপ্ত  

সারাবাংলা/আরএফ/এসএস

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন