বিজ্ঞাপন

অপহরণ নয়, স্বেচ্ছায় ভারতে গিয়েছিলেন ‘নিখোঁজ’ মনিকা রাধা

November 8, 2018 | 1:07 pm

।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম ব্যুরো :অপহরণ নয় নিজের ইচ্ছায় ভারতে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামের নিখোঁজ সঙ্গীত শিক্ষক মনিকা বড়ুয়া রাধা। শুধু তাই নয়, সেখানে গিয়ে বিয়ে করে নাম বদলে বসবাস শুরু করেছিলেন তিনি। ভারত-বাংলাদেশের সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে উদ্ধারের পর মনিকা পুলিশকে নিজেই এই তথ্য দিয়েছেন।

উদ্ধারের পর মনিকা পুলিশকে আরও জানিয়েছেন, ভারতে পালানোর আগে সংসারে বিভিন্ন টানাপড়েনে হতাশ হয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সাংবাদিক পত্মী মনিকা রাধা। এছাড়া নিখোঁজ থাকা অবস্থায় তার দুই বোনসহ বাবার পরিবারের একাধিক সদস্যের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল বলেও জানিয়েছেন মনিকা।

সাড়ে ছয় মাস আগে মনিকার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা চট্টগ্রামসহ সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। মনিকাকে উদ্ধার এবং তার কথিত স্বামী কমলেশ কুমার মল্লিককে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে সেই রহস্যের জট খুলে দিয়েছে চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশ।

বিজ্ঞাপন

বৃহস্পতিবার (৮ নভেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগম জানান, ফেসবুকে পরিচয়ের মাধ্যমে ভারতের ব্যবসায়ী কমলেশ কুমার মল্লিকের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে মনিকার। ১২ এপ্রিল চট্টগ্রামে এসে মনিকাকে নিয়ে যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান কমলেশ।

‘মনিকা জানিয়েছেন, সেখানে বিয়ে করে কোলকাতায় একটি ফ্ল্যাটে তারা বসবাস করছিলেন। মনিকা নাম বদলে নেন অনামিকা মল্লিক। স্বামীর সূত্রে সোশ্যাল সিকিউরিটি কার্ডও পান তিনি।’

বিজ্ঞাপন

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া সারাবাংলাকে জানান, ব্যবসার কাজে বাংলাদেশে আসা কমলেমকে গত ৪ নভেম্বর ঢাকার ধানমন্ডি থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। কমলেশের মাধ্যমে মনিকাকে কৌশলে সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ৬ নভেম্বর বাংলাদেশে আনা হয়। পরে তাকে হেফাজতে নেয় গোয়েন্দা টিম।

কমলেশ ও মনিকাকে জিজ্ঞাসাবাদে তারা এই ঘটনার বিস্তারিত জানিয়েছেন বলে সারাবাংলাকে জানান এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

চট্টগ্রামের সাংবাদিক দেবাশীষ বড়ুয়া দেবুর স্ত্রী মনিকা (৪৫) গত ১২ এপ্রিল লালখান বাজারের হাই লেভেল রোডের বাসা থেকে গান শেখানোর জন্য বের হয়েছিলেন, এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন। ২৮ এপ্রিল অপহরণ সন্দেহে মামলা করেন দেবাশীষ। মামলায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। দুই মেয়ের জননী মনিকা চট্টগ্রাম নগরীর কাতালগঞ্জের লিটল জুয়েলস স্কুলে গান শেখাতেন।

বিজ্ঞাপন

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে বড় মেয়ের মাধ্যমে ফেসবুকে নিজের নামে একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন মনিকা। বিভিন্নজনের কাছ থেকে বন্ধুত্বের অনুরোধ আসতে থাকে। একপর্যায়ে আগস্টের শেষ সপ্তাহে আসে কমলেশের কাছ থেকে বন্ধুত্বের অনুরোধ। মনিকা গ্রহণ করেন। শুরু হয় ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে কথাবার্তা। এরমধ্যে নিজের সংসারের কথা, স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্যসহ বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা দুজনের মধ্যে হয়। ডিসেম্বর পর্যন্ত ফেসবুকে যোগাযোগের পর কমলেশের পরামর্শে দুজন হোয়াটস অ্যাপে যোগাযোগ শুরু করেন। তখন মনিকা ফেসবুকে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। ফেসবুকে মনিকা এবং কমলেশের যোগাযোগের বিষয়টি জানতেন মনিকার বড় মেয়ে। তিনি একবার মায়ের ফেসবুকে ঢুকে কমলেশকে ব্লকও করেন।

গোয়েন্দা কর্মকর্তা রাজেশ বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, বাসায় রান্নাবান্না এবং গানের টিউশনি ছাড়া সারাক্ষণ হোয়াটস অ্যাপে দুজন কথা বলতেন। সেখানে স্বামীর গভীর রাত করে বাসায় ফেরাসহ নানা বিষয়ে সংসারের কথা মনিকা কমলেশের সঙ্গে শেয়ার করতেন। জিজ্ঞাসাবাদে কমলেশ ও মনিকা বিষয়টি আমাদের জানিয়েছেন। তবে আমরা তদন্তের শুরুতেও এসব বিষয়ে তথ্য পেয়েছিলাম।

সূত্রমতে, মনিকার সঙ্গে যোগাযোগের পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে কমলেশ কোলকাতা থেকে ঢাকায় চট্টগ্রামে আসেন। ওঠেন নগরীর আগ্রাবাদ হোটেলে। সেখানে মনিকা গিয়ে কমলেশের সঙ্গে দেখা করেন। তারা দুজন হোটেলের কম্পাউন্ডে বসে কথা বলার ভিডিও ফুটেজ সংরক্ষিত আছে নগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে।

‘এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে টাকাপয়সা নিয়ে স্বামী দেবাশীষের সঙ্গে মনিকার ঝগড়া হয়। মনিকার জমানো টাকা থেকে ব্যাংকক বেড়াতে যাবার জন্য ৪০ হাজার টাকা চান দেবাশীষ। মনিকা এতে অসম্মতি জানান। ঝগড়ার জেরে মনিকা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। বিষয়টি মনিকা জানান কমলেশকে। তখন কমলেশ মনিকাকে আত্মহত্যা না করে তার কাছে চলে যাবার জন্য বলেন এবং বিয়ে করবে বলে কথা দেন।’ বলেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা

রাজেশ বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা মনিকার দাবি যে, তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। এবং সাংসারিক ঝগড়ার জেরে এটা করতে চেয়েছেন বলে তিনি দাবি করেছেন। বিষয়টি তদন্তসাপেক্ষে নিশ্চিত করে বলা যাবে।’

সূত্রমতে, কমলেশের ভারতে যাবার এবং বিয়ে করার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান মনিকা। ১২ এপ্রিল কোলকাতা থেকে সরাসরি ফ্লাইটে চট্টগ্রামে আসেন কমলেশ। নগরীর একে খান এলাকায় গিয়ে যশোরের বেনাপোল পর্যন্ত শ্যামলী পরিবহনের দুটি টিকেট সংগ্রহ করেন। বাস ছেড়ে দেবে বলে তড়িঘড়ি করে বের হতে গিয়ে মনিকা চশমা, ওষুধ, টাকা-পয়সা নেননি।

১৩ এপ্রিল রাতে তারা যশোরের বেনাপোলে পৌঁছেন। ১৪ এপ্রিল ভোরে কমলেশ বৈধভাবে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। মনিকাকে নেওয়া হয় অবৈধ পথ দিয়ে। কমলেশ মনিকাকে নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বিরাটি এলাকায় (কোড নম্বর-৭০০১৩২) মধুসূধন ব্যানার্জি সড়কের সিদ্ধেশ্বরী ভবনের ২/এ ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাটটি তার নিজস্ব।

মনিকা নগর গোয়েন্দা পুলিশকে জানিয়েছেন, সেখানে যাবার এক সপ্তাহের মধ্যে তারা পশ্চিমবঙ্গে পুরী জগন্নাথ দেবের মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করেন। তবে সরকারিভাবে নিবন্ধন করেননি।

নাম পাল্টে অনামিকা মল্লিক উল্লেখ করে সোশ্যাল সিকিউরিটি কার্ড নেন। জন্মসাল লেখেন ১৯৮৭ সালের ৬ আগস্ট। বাস্তবে মনিকার জন্ম ১৯৭২ সালে বলে জানান এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

গোয়েন্দা কর্মকর্তা রাজেশ বড়ুয়া সারাবাংলাকে জানান, কমলেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশপরগণা জেলার বারাসাতের নপাড়ার শ্রীপল্লী গ্রামের বীরেন কুমার মল্লিকের ছেলে। ভারত থেকে বাংলাদেশে কেমিকেল রফতানি এবং বাংলাদেশ থেকে টি-শার্টসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাক আমদানির ব্যবসা করেন কমলেশ।

‘তদন্তে নেমেই আমরা কমলেশের সঙ্গে মনিকার যোগাযোগের তথ্য পেয়েছিলাম। মোবাইল ও তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা তাদের ভারতে চলে যাবার বিষয়টিও নিশ্চিত হয়েছিলাম। কমলেশ ব্যবসার কাজে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে আসেন, সেটা আমরা জানতাম। সেজন্য তাকে ধরার অপেক্ষায় থাকি।’

‘এর মধ্যে খবর পাই, গত তিন মাস ধরে মনিকার সঙ্গে তার দুই ছোট বোন মন্টি বৈঞ্চব ও নন্দিতা বৈঞ্চবের যোগাযোগ আছে। তাদের মধ্যে নিয়মিত কথাবার্তা হয়। এমনকি তাদের মাধ্যমে দুই মেয়ের খোঁজখবরও নিয়মিত নিতেন মনিকা। তবে বিষয়টি আমাদের জানানো হয়নি। আমরা যদি এই যোগাযোগের খবর আগে পেতাম, তাহলে আরও সহজেই মনিকাকে উদ্ধার করতে পারতাম।’

মনিকা-রাধা

রাজেশ বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘মনিকাকে উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে ঢাকা-চট্টগ্রামে মানববন্ধন করেছে তার পরিবার। পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার কমিশনসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও তারা অভিযোগ করেছেন। অথচ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার বিষয়টি আমাদের কাছ থেকে লুকানো হয়েছে। উদ্ধারের পর মনিকা নিজেও আমাদের বলেছেন দুই বোনসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার কথা। বোনরাই তাকে বলেছে, তুমি দেশে আসলে তোমাকে গ্রেফতার করবে পুলিশ। এই ভয়ে মনিকা দেশে ফেরেননি।’

এই বিষয়ে জানতে চাইলে মন্টি বৈঞ্চব সারাবাংলাকে বলেন, ‘তিন মাস নয়, কয়েকদিন আগে ভিন্ন নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে যোগাযোগ হয়েছে। আমরা সেটা আমার বোনের অ্যাকাউন্ট কি-না সেটা নিয়ে সন্দিহান ছিলাম। আর মনিকা দিদিকে উদ্ধারে শুধু সিএমপি কিংবা ডিবি নয়, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট কাজ করছিল। ডিবিকে না জানালেও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানিয়েছিলাম। এখানে ভুল বোঝাবুঝির কোন অবকাশ নেই।’

কমলেশকে আটক ও মনিকাকে উদ্ধারের বর্ণনা দিয়ে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (উত্তর) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান সারাবাংলাকে জানান, গত ৩ নভেম্বর বাংলাদেশে প্রবেশ করেন কমলেশ। ৪ নভেম্বর ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ির সামনে থেকে তাকে আটক করা হয়। প্রথমে কমলেশ মনিকার বিষয়টি অস্বীকার করেন। পরে তার মোবাইল ঘেঁটে দুজনের ছবি পাওয়া যায়।

রাজেশ বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের হেফাজতে থাকা কমলেশ যোগাযোগ করেন মনিকার সঙ্গে। ৫ নভেম্বর বিকেলে মনিকা সাতক্ষীরা ভোমরা সীমান্ত সংলগ্ন জিরো পয়েন্টে আসেন। কিন্তু আমাদের দেখে বুঝে যান, তার স্বামী আটক হয়েছেন। এসময় তিনি জিরো পয়েন্ট থেকে ফিরে যান। কমলেশের বারবার অনুরোধে একপর্যায়ে ৬ নভেম্বর আবারও অবৈধ পথে মনিকা বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তখন আমরা তাকেও আমাদের হেফজতে নিই।

ছবি : শ্যামল নন্দী

সারাবাংলা/আরডি/এসএমএন

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন