বিজ্ঞাপন

‘ইউটার্নের সুযোগ’ নিতেই খালেদার জন্য ৩ ফরম!

November 13, 2018 | 8:51 am

।। আসাদ জামান ও আব্দুল জাব্বার খান ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ সাত দফা দাবির একটিও পূরণ হয়নি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, তথা বিএনপির। তারপরও বর্তমান সংবিধানের আলোকে শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপিসহ নবগঠিত এই রাজনৈতিক জোট। এরই মধ্যে মনোনয়ন ফরম বিক্রিও শুরু করেছে দলটি। আর এ কার্যক্রমের শুরুতেই দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নামে কেনা হয়েছে তিনটি সংসদীয় আসনের মনোনয়ন ফরম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেবল দলীয় আনুগত্য বা শ্রদ্ধার নিদর্শন নয়, এর পেছনে বড় ধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা কৌশলও আছে বিএনপির।

সোমবার (১২ নভেম্বর) সকাল থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করে বিএনপি। শুরুতেই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ফেনী-১ আসনের জন্য খালেদা জিয়ার পক্ষে মনোননয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। এরপর বগুড়া-৬ আসনের জন্য খালেদা জিয়ার পক্ষে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান; আর বগুড়া-৭ আসনের জন্য খালেদা জিয়ার পক্ষে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন দলের স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মির্জা আব্বাস।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দু’টি মামলায় ১৭ বছর দণ্ডাদেশ পাওয়া খালেদা জিয়ার জন্য তিনটি আসনে মনোনয়ন ফরম কেনার পেছনে বড় ধরনের রাজনেতিক উদ্দেশ্য বা কৌশল আছে বিএনপির। আইন ও সংবিধান সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল থাকা সত্ত্বেও ফেনী-১, বগুড়া-৬ ও ৭ নির্বাচনী আসনে খালেদা জিয়ার জন্য মনোননয় ফরম কেনা নিছক খালেদা জিয়ার প্রতি আনুগত্য বা শ্রদ্ধা দেখানোর জন্য নয়। মূলত, খালেদা জিয়ার প্রার্থিতাকে ইস্যু করে নির্বাচন থেকে ইউটার্ন নেওয়ার একটা সুযোগ হাতে রেখেই নির্বাচনি ট্রেনে উঠেছে বিএনপি।

বিজ্ঞাপন

সোমবার মনোনয়ন ফরম বিক্রির শুরুতে এ ধরনের একটা ইঙ্গিতও দিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি পরিষ্কার করে বলেছেন, ‘আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি। নির্বাচনের পরিবেশ এখন পর্যন্ত কিছুই নেই। নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত না হলে আমরা সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করব।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও বিএনপি চাইবে তাদের নেত্রী অন্তত নির্বাচন করার সুযোগ পাক। জেল থেকে নির্বাচন করলেও দলের নেতাকর্মীদের মনোবল বহুগুণ বেড়ে যাবে। আর নির্বাচিত হতে পারলে খালেদা জিয়ার করামুক্তি সহজ হয়ে যাবে।

কিন্তু আইনের মারপ্যাঁচে খালেদা জিয়া যদি নির্বাচন করতে না পারেন বা সরকার খালেদা জিয়াকে নির্বাচন করতে না দেয়, তাহলে বিএনপির জন্য সামনের দিনগুলো আরও কঠিন হয়ে যাবে। এমন একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে নির্বাচন করে সরকারকে বৈধতা দেওয়ার পথে নাও হাঁটতে পারে বিএনপি। আর সেজন্যই কারাবন্দি খালেদা জিয়ার জন্য তিনটি আসনে মনোনয়ন ফরম কিনেছে তারা।

বিজ্ঞাপন

অবশ্য খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলছেন, আদালত তার সাজা স্থগিত করলে নির্বাচনে অংশ নিতে কোনো বাধা থাকবে না। এখনও যে সময় আছে, তার মধ্যেই আদালতের মাধ্যমে এ বিষয়টি ফায়সালা করা সম্ভব। তারা বলছেন, কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে নির্বাচনের অংশগ্রহণের নজির বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে আছে।

অন্যদিকে সরকার পক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, এ অবস্থায় খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেওয়া সম্ভব নয়। বিচারিক আদালতের রায় হাইকোর্টে বৃদ্ধি পাওয়ায় তার আর নির্বাচন করার সুযোগ নেই। তাছাড়া যেটুকু সময় হাতে আছে, তার মধ্যে আপিল শুনানি শেষ করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা খালেদা জিয়ার পক্ষে অসম্ভব। এ অবস্থায় তার পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রায় আনিশ্চিত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সংবিধানের বিধান অনুযায়ী কারও দুই বছর বা তার চেয়ে বেশি মেয়াদে সাজা হলে তিনি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্য হবেন না। কিন্তু আদালত যদি সেই সাজা স্থগিত করেন, তাহলে তার নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা থাকবে না। এ নজির ভারতসহ উপমহাদেশের অনেক দেশেই আছে। তাছাড়া বর্তমান ক্ষমতাশীল দল আওয়ামী লীগের অনেকেই সাজা মাথায় নিয়ে নির্বাচন করেছেন।’

এই অল্প সময়ের মধ্যে আবেদন করে খালেদা জিয়াকে কি নির্দোষ প্রমাণ করা সম্ভব?— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা একদিনের মধ্যেই সম্ভব। দরখাস্ত দিলে একদিনেই আদালত সাজা স্থগিত করতে পারেন। এর জন্য বেশি সময়ের প্রয়োজন নেই।’

বিজ্ঞাপন

খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘লিভ টু আপিলের মাধ্যমে আমরা প্রসিডিউর শুরু করব। আশা করি কয়েকদিনের মধ্যে এ বিষয়ে আদালত থেকে একটা ফায়সালা আসবে এবং আমাদের নেত্রী নির্বাচন করতে পারবেন।’

তবে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখন যে অবস্থা আছে, উনি (খালেদা জিয়া) যেহেতু সাজাপ্রাপ্ত, সেহেতু নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য অযোগ্য। এটা সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে আছে। এই ধারায় বলা আছে, নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অনূর্ধ্ব দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে তার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হয়ে থাকলে তিনি নির্বাচনের যোগ্য হবেন না। এটা হলো সংবিধানের বিধান।’

‘এখন প্রশ্ন হলো— উনি (খালেদা জিয়া) একটি মামলায় ১০ বছর এবং আরেকটিতে সাত বছর সাজা পেয়েছেন। এ মামলায় তিনি আপিল করার সুযোগ পেলেও আপিল শুনানি করে নির্দোষ প্রমাণ করা অনেক সময়ের ব্যাপার। কাজেই এই পরিস্থিতিতে সংবিধানে যে বিধান আছে, তাতে তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। ফলে এই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন বলে আমার মনে হয় না,’— বলেন ব্যারিস্টার শফিক।

এসব মামলায় আপিল আবেদন করলে মামলাটি বিচারাধীন হবে। ফলে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন— খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের এমন বক্তব্যের জবাবে সাবেক এই আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আপিল আবেদন করলেই বিচারাধীন হবে না। এসব মামলায় উনি সাজা পেয়েছেন। বিচারাধীন হলো— যে মামলাটা বিচারিক আদালতে ট্রায়াল চলছে।‘

তিনি বলেন, একটি মামলায় বিচারিক আদালতে সাক্ষ্যপ্রমাণ ও যুক্তিতর্ক শেষ করে বিচারিক আদালত রায় দিয়ে দিলো। এতে বিচার কাজ শেষ। আবার আরেকটিতে উনি হাইকোর্টে আপিল করে সাজা আরও বেড়েছে। ফলে সাজা তো বহাল থাকলো। সাজার রায় বহাল রেখে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। এখন ধরেন, উনি আপিল করবেন। আপিল কবে শুনানি হবে? সার্টিফায়েড কপি নিতে হবে। এরপর আবার আপিল বিভাগ আছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলো স্টেজ অতিক্রম করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা আমার মনে হয় অসম্ভব ব্যাপার। সেজন্য উনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।

দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি মনে করি, খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় সাংবিধানিকভাবে বাধা আছে। উচ্চ আদালতে তিনি খালাস পেলে নির্বাচনে অংশে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু যে সময় আছে, তাতে এই প্রক্রিয়া শেষ করা অসম্ভব ব্যাপার।’

সাজা স্থগিত রেখে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ আছে— বিএনপি আইনজীবীদের এমন বক্তব্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি।’

সারাবাংলা/এজেড/এজেডকে/টিআর

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন