বিজ্ঞাপন

ভোটের আগেই ‘এমপি’

November 16, 2018 | 7:30 pm

একাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্যে রাজনৈতিক দলগুলো মনোনয়ন ফরম বিক্রি করার পর থেকে মনে হচ্ছে ‘সংসদ সদস্য (এমপি)’ হতে চাওয়া, কিংবা হয়ে যাওয়া অনেক সহজ। ব্যাঙ্ক কিংবা পকেটে টাকা আছে- এতটুকুই যথেষ্ট। সে টাকা দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিশেষত আওয়ামী লীগ, কিংবা বিএনপি, অথবা জাতীয় পার্টির একটা মনোনয়ন ফরম কিনে আনলেন, ফেসবুকে প্রচার করলেন, কিছু অনলাইনে সচিত্র সংবাদ হলো; আর আপনি হয়ে গেলেন ‘এমপি’, দলের মনোনয়ন আর ভোটের আগেই ‘এমপি’। এখানে নির্বাচন কিংবা জনগণের ভোটের হিসাব সে অনেক দূরের পথ।

বিজ্ঞাপন

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ তাদের মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে ৩০ হাজার টাকায়। বিএনপির মনোনয়ন ফরমের দামও একই, তবে সে টাকা পরিশোধে দুইটা ধাপ রেখেছে দলটি। প্রথম দফায় ফরম কেনার সময়ে ৫ হাজার টাকা দিয়ে ফরম নিতে হবে, এবং জমা দেওয়ার সময়ে জামানত হিসেবে দিতে হবে আরও ২৫ হাজার টাকা। জাতীয় পার্টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করছে ২০ হাজার টাকায়। বিকল্পধারা বাংলাদেশের মনোনয়ন ফরমের দাম ২১ হাজার টাকা। এভাবে একেক দলের ফরমের দাম একেক। ত্রিশ হাজার টাকার থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন ৫শ’ টাকা। এদিকে বিনামূল্যে ফরম বিতরণ করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও গণফোরাম- এমনই খবর গণমাধ্যমের।

রাজনৈতিক দলগুলোর এই মনোনয়ন ফরম বিক্রি মূলত বাণিজ্যিক এক প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে দলগুলোর তহবিল স্ফীত হয়। এই তহবিল স্ফীতির প্রক্রিয়ায় দলের নেতাপর্যায়ের মানুষেরা নির্বাচনের আগে সম্পৃক্ত হন। তবে এবারের নির্বাচন অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্যে আওয়ামী লীগ যেখানে ২ হাজার ৬০৮টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছিল এবার সেখানে বিক্রি করে ৪ হাজারেরও বেশি ফরম। গতবারের চাইতে এবার মনোনয়ন ফরমের দাম বেশি থাকলেও মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ওপর সে প্রভাব পড়েনি। জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের হিসাব মাথায় আনলে প্রতি আসনে এবার মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা ১৩-এর বেশি। এরমধ্যে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে কেবল বরগুনা-১ আসনের জন্যে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন ৫২ জন প্রার্থী। বরগুনার ওই আসনের এমন মনোনয়ন বিক্রির তথ্য গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবার মনোনয়ন ফরম বিক্রি করে আয় করেছে ১৩ কোটি টাকারও বেশি। ক্ষমতাসীন দলটির তুলনায় পিছিয়ে নেই বিএনপিও। কেবল প্রথম দুইদিনেই এক যুগের কাছাকাছি সময় ক্ষমতায় বাইরে থাকা দলটি তিন হাজারের বেশি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে। শেষ পর্যন্ত তাদের এই বিক্রি আওয়ামী লীগকে ছাড়িয়ে যায় কিনা সেটাও দেখার। তবে আওয়ামী লীগের চাইতে বিএনপির মনোনয়ন ফরম ক্রেতাদের জন্যে সুবিধার যে তারা শুরুতেই ৩০ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে না, ৫ হাজার টাকা দিয়ে প্রাথমিকভাবে ফরম কিনতে পারছে। ফলে তাদের এই মনোনয়ন ফরম বিক্রি আর জমা নেওয়ার মধ্যে একটা সংখ্যাগত পার্থক্য থাকাটা স্বাভাবিক, এবং এটা বেশ বড় সংখ্যাও হতে পারে।

বিজ্ঞাপন

আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়ন ফরম যারা কিনছেন তাদের মধ্যে রাজনীতিবিদদের বাইরে পেশাজীবী, ক্রীড়াবিদ থেকে শুরু করে অভিনেতা, অভিনেত্রীরাও আছেন। তাদের নিয়ে আলোচনা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে ভোটের আগেই তাদেরকে ‘এমপি’ হিসেবে অনেকটা আখ্যা দেওয়ার পর্যায়েও চলে গেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে স্রেফ ত্রিশ-বিশ কিংবা পাঁচ হাজার টাকা খরচ করলেই ‘এমপি’ হওয়া যায়। এই প্রবণতা সুখের নয়, এটা আমাদের আইন প্রণেতাদের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করছে কিনা সেটাও দেখার।

বাস্তবতা বিবেচনায় নিলে দলীয় মনোনয়ন ফরম কেনা মানে দলের মনোনয়ন প্রাপ্তি নয়। এটা উন্মুক্ত একটা ক্ষেত্র যেখানে দলের নেতা-কর্মী কিংবা অন্য দলের কেউ অথবা নির্দলীয় কেউই মনোনয়ন ফরম কিনতে পারে, এখানে কোন বাধা নাই, বিধিনিষেধ নাই। কারও মনোনয়ন পত্র কেনা মানে তিনি সেই দলের বড় নেতা এমনও না। স্রেফ নির্ধারিত অঙ্কের টাকা নিয়ে নিয়ম মোতাবেক হাজির হয়ে গেলে মনোনয়ন ফরম পাওয়া যাচ্ছে। এই মনোনয়ন ফরম বিক্রিতে বিক্রয়কারী সংগঠন কাউকে মনোনয়ন দানের নিশ্চয়তা দিচ্ছে না, এবং যারা কিনছেন তারাও জানেন সেটা। এরবাইরে আছে দলের মনোনয়ন পেলে এরপর নির্বাচন কমিশনে মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়া, সেটা সঠিক রীতিতে নিয়ম অনুযায়ি হলে তবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন; এবং সবশেষে জনগণের ভোট পেলে তবেই ‘এমপি’ হওয়া। অথচ স্রেফ ত্রিশ, বিশ কিংবা পাঁচ হাজার টাকার মনোনয়ন ফরম কিনে নেওয়ার পর অনেককেই আমাদের অনেকেই ‘এমপি’ বলেও সম্বোধন করছেন।

ভোটের আগে কাউকে এভাবে ‘এমপি’ বানিয়ে দেওয়া, কিংবা এমপি-রূপ কাউকে উপস্থাপন করা অনুচিত। আর এটা সবচেয়ে বেশি হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এই মাধ্যমে সচেতন কিংবা অচেতনতায় কেউ কেউ এটা করছেন; কারও ইঙ্গিত আবার অন্যকে হেয় কিংবা ঠাট্টাচ্ছলে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের নাগরিকদের অধিকার রয়েছে নির্বাচনে অংশগ্রহণের, আবার ভোটারদের অধিকারও রয়েছে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের। অংশগ্রহণের এই অধিকার আইন দ্বারা বিধিবদ্ধ। সকল নাগরিকের নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার থাকলেও সেটা বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়া মেনেই অংশ নিতে হয়। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর এই মনোনয়ন ফরম বিক্রিতে যোগ্যতা-অযোগ্যতার প্রশ্ন থাকছে না, এখানে প্রাথমিক যোগ্যতাটা আর্থিক সঙ্গতির। তাই আলোচনায় আসার জন্যে অনেকেই এমন মনোনয়ন ফরম কেনার দিকে ঝুঁকছে বললেও হয়ত ভুল হবে না।

এর প্রমাণ আবার হাতেনাতে, এবং সেটা বরগুনা-১ আসন। স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করলে একটা নির্বাচনী আসনে অর্ধশতাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকার কথা নয়, কিন্তু সেটাই ঘটল এবার। হতে পারে গত ১০ বছরে ওই এলাকার আওয়ামী লীগের সকল কর্মী বড় নেতা হয়েছেন, এবং সেটা দেশের আইন প্রণেতা হয়ে যাওয়ার মত নেতা। বিশ্বাস হয়? আমার হচ্ছে না!

১৩ কোটি টাকার মনোনয়ন ফরম বিক্রি করে অর্থনৈতিক লাভ দেখে আওয়ামী লীগের হয়ত খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু একই সঙ্গে এত এত মনোনয়নপ্রত্যাশীর মাঝ থেকে সঠিক প্রার্থী বাছাই করা কষ্টসাধ্যও। তবে শেষ পর্যন্ত প্রতি আসনে তাদের একজনকেই বেছে নিতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও নিজস্ব মাঠজরিপের মাধ্যমে তারা প্রার্থী নির্বাচন করবে ঠিক, কিন্তু এত লোককে সংগঠিত রাখা এবং দলের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করাতে পারাটাও কিন্তু চ্যালেঞ্জের। একই কথা প্রযোজ্য বিএনপির ক্ষেত্রেও। দলের লোকজন যেভাবে ফরমের পেছনে ছুটছেন সেভাবে মাঠে ছিলেন না গত দশ বছর। সরকারবিরোধী বিভিন্ন কর্মসূচিতে মাঠে ছিলেন না এদের বেশিরভাগই। এখন নির্বাচনী ঢামাঢোলে তারা ফিরেছেন, এবং ওখানে ব্যর্থ হলে ফের লম্বা অবকাশে যে যাবেন না সে নিশ্চয়তাই বা কোথায়?

গ্রামে শেকড় বলে জানি সেখানকার সংস্কৃতি; আর গ্রামপ্রধান বাংলাদেশ সে সংস্কৃতিকেই ধারণ করে। গ্রামের কেউ ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার (সদস্য) বা চেয়ারম্যান পদে একবার দাঁড়ালেই চিরদিনের জন্যে সে পদবিটা নিজের করে নেন। আত্মীয়-পরিজন থেকে শুরু করে এলাকায় সে পদবিতেই পরিচিত হয়ে ওঠেন। নির্বাচনের জয়-পরাজয় ওখানে মুখ্য নয়। জিতলেও মেম্বার-চেয়ারম্যান; হারলেও মেম্বার-চেয়ারম্যান! এবারের নির্বাচন সেই সংস্কৃতিকে সামনে নিয়ে এসেছে হয়ত। এখনকার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে মনোনয়ন ফরম কেনাটাই এখন পদবি-লাভের উপাদান হয়ে ওঠছে। কয়েক হাজার টাকা খরচ করে কোনো একটা দলের মনোনয়ন ফরম কিনে এখন তাই হাজার-হাজার লোক ‘এমপি’ হয়ে গেছে! দলের মনোনয়ন লাভ, নির্বাচন কমিশনে জমাদান, নির্বাচনে অংশগ্রহণ আর নির্বাচনে জয়ী হওয়া- এত দূর চিন্তা, এত খবর রাখার সময় কই!

বিজ্ঞাপন

কবির য়াহমদ, সাংবাদিক

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন