বিজ্ঞাপন

‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ২

December 2, 2018 | 9:27 pm

।। ফারুক ওয়াহিদ ।।

বিজ্ঞাপন

১৯৭১-এর ২ ডিসেম্বর মহান বিজয় মাসের দ্বিতীয় দিনটি বাংলার হেমন্তের নীলাকাশে মিষ্টি সোনা চাঁপা ফুলের রংয়ের রোদের ঝিলিক মাখা বিজয়ের আরেকটি দিন- সেই দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। যুদ্ধ ও রণকৌশলে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বৃহস্পতি তখন তুঙ্গে। এই প্রিয় বৃহস্পতিবারই মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা বাহিনী গেরিলা আক্রমণ ছেড়ে সম্মুখ রণাঙ্গনে যোগ দিয়ে যুদ্ধের গতি আরো বাড়িয়ে দেয়। প্রতিদিন মুক্তিবাহিনীর কাছে নাস্তানাবুদ হচ্ছিল পাকিস্তানি বাহিনী। মুক্তির সংগ্রামে উত্তাল ছিল বাংলার মাটি- এ যেন “বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি”। মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের কাছে অপ্রতিরোধ্য বিজয়ের পথে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায় এবং দিশেহারা হয়ে তারা পিছু হঠতে থাকে।

মুজিবনগরের বাংলাদেশ সরকার অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায় বাংলাদেশের বিজয় আসন্ন। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধাদের নিত্যনতুন বিজয়ের খবর প্রচারিত হতে থাকে এবং মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা আক্রমণ ছেড়ে সম্মুখ রণাঙ্গনে যুদ্ধ করতে থাকলে তাদেরকে আরো উৎসাহ দেওয়ার জন্য স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে বাজতে থাকে রক্তগরম করা যুদ্ধজয়ের গান- যা রণাঙ্গনে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করে।

বিজ্ঞাপন

 

২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সেক্টরে মুক্তিবাহিনী তিন দিক থেকে আক্রমণ করলে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী আজমপুর রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে পালিয়ে যায়। আজমপুর রেলওয়ে স্টেশন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এলেও পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিবাহিনীর ওপর পাল্টা আক্রমণ করে এবং আখাউড়া রেল স্টেশনে তখনও চলছে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচন্ড সম্মুখযুদ্ধ- পাকিস্তানিরা এই যুদ্ধে ট্যাঙ্ক ব্যবহার করেছে। সম্মুখ যুদ্ধে প্রকম্পিত হয়ে উঠে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া এলাকা এবং সাথে সাথে আখাউড়া সংলগ্ন আগরতলা শহরও কেঁপে উঠে। কসবা থেকে মুকুন্দপুর আর আখাউড়া থেকে উজানিসার পর্যন্ত তিনদিনের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের ধরাশায়ী করে ফেলে। কুমিল্লা-সিলেট সিএণ্ডবি রোডের সংযোগ মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে এবং চট্টগ্রাম-কুমিল্লা-ঢাকা রেল যোগাযোগও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেয। তিনদিনের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের অবরুদ্ধ করে রেখেছে এবং অনেক পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হযেছে।

সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ সমসেরনগর বিমান বন্দর মুক্তিবাহিনী সম্পূর্ণ দখল করে নেয়। মুক্তিবাহিনী ঘোড়াশালে পাকিস্তানি সৈন্যদের শক্ত অবস্থানের ওপর চারদিক থেকে একযোগে আক্রমণ করে অনেক পাকিস্তানি সৈন্যকে হতাহত করতে সক্ষম হয় এবং এখান থেকে বেশকিছু গোলাবারুদও উদ্ধার করে মুক্তিবাহিনী।

বিজ্ঞাপন

এদিনে চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনী উত্তরে ফটিকছড়ি ও রাউজান থানা এবং দক্ষিণে আনোয়ারার অধিকাংশ স্থান তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রামের পথে পথে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা হানাদারদের সাথে খন্ড খন্ডভাবে সম্মুখযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

সীমান্ত এলাকাগুলোতে সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করলে মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দেয় ভারতীয় বাহিনী। বীর মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় গভীর রাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে উত্তরে অবস্থান পঞ্চগড়ে ক্ষিপ্রগতিতে আকস্মাৎ আক্রমণ করে পঞ্চগড় মুক্ত করে নেয় এবং ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে বিজয়ের বেশে এগিয়ে যেতে থাকে।

মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় ও বোমা বিস্ফোরণে ঢাকার রামপুরা বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র, চট্টগ্রামের পাঁচটি বিদ্যুৎ সাব স্টেশন ও দুটি পেট্রোল পাম্প বিধ্বস্ত হয় যা আন্তর্জাতিক মিডিয়া সমূহে মুক্তিবাহিনীর এই সাফল্যের খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, আকাশবাণী এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদে প্রচারিত হতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিত্য নতুন বিজয়ের সংবাদ।

খুলনা অঞ্চলে লে. জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনী সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা আগেই শত্রুমুক্ত করেছিল এবং পাকিস্তানি সেনাদের পিছু হটিয়ে মুক্তিবাহিনী সাতক্ষীরার উপকণ্ঠে পৌঁছে যায়। রূপসা নদীর ওপারে খুলনার কাছে ঘাঁটি স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল।

বিজ্ঞাপন

এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানা মুক্ত করে এবং টাঙ্গাইল আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকে।

একাত্তরের এই দিনে ময়মনসিংহ, জামালপুরসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় গণহত্যা চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা রাজধানী ঢাকাকে দখলমুক্ত করার লক্ষ্যে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ করে করে ঢাকার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে।

[লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, ২ নং সেক্টর বাঞ্ছারামপুর]

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন