বিজ্ঞাপন

বুদ্ধিজীবী দিবসেও মলিন মিরপুরের জল্লাদখানা বধ্যভূমি

December 14, 2018 | 4:01 pm

।। সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে বাঙালি জাতি বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের। শুক্রবার (১৪ ডিসেম্বর) রাজধানীর রায়ের বাজার বধ্যভূমি ও মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী প্রাঙ্গণসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শহীদদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হলেও অনেকটা নিশ্চুপ আর প্রাণহীন থেকে গেছে মিরপুর জল্লাদখানা বধ্যভূমি। শ্রদ্ধা জানানো তো দূরের কথা বধ্যভূমির প্রধান ফটকটিও সকাল নয়টা পর্যন্ত ছিল তালাবন্ধ। যে কারণে দু-একজন দর্শনার্থী বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বধ্যভূমিতে এসেও ভেতরে প্রবেশ করতে না পেরে ফিরে গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

জল্লাদখানা বধ্যভূমি, স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৯৭১,

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল-শামসরা ট্রেনিং-প্রাপ্ত জল্লাদ দিয়ে স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালিদের নিষ্ঠুরভাবে জবাই করে সেখানকার পাম্প হাউজের কূপের (বর্তমানে সেফটি ট্যাংক) ভেতরে ফেলে রাখত। দেশ স্বাধীন হবার পর এই জল্লাদখানা বধ্যভূমি ও তার আশপাশের জমি থেকে প্রায় তিন ট্রাক মানুষের দেহাবশেষ উদ্ধার করে তা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু পাম্পের ট্যাংকের ভেতরের দেহাবশেষ আজও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

বিজ্ঞাপন

জল্লাদখানা বধ্যভূমি, স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৯৭১,

১৯৭৩ সালের দিকে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন জল্লাদখানার জায়গাটি ঘুরে দেখেন এবং স্মৃতি সংরক্ষণের কথা জানান। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় এটিকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বধ্যভূমিটির ভেতরে থাকা পাম্প হাউজের একটি ছোট্ট ঘরের ভেতর বাম দিকে ‘জল্লাদখানা স্মৃতিপীঠ’ হত্যাকাণ্ডের দলিল হিসেবে দেয়ালে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ডানে কালের সাক্ষী সেই কূপটি স্বচ্ছ কাচ দিয়ে ঢেকে রাখা আছে। এর পাশের কিছু অংশ কালো রংয়ের টাইলস দিয়ে আবিষ্ট করে রাখা হয়েছে। পাশেই দেয়ালে তসবি, স্যান্ডেল, টুপি, ম্যানিব্যাগ, সাইকেলের চেইন ও কলম সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে সর্বসাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য। এসব স্মৃতিচিহ্ন শুধুমাত্র একটি বধ্যভূমি নয়, মুক্তিযুদ্ধের একটি পরিপূর্ণ ইতিহাসও বটে।

জল্লাদখানা বধ্যভূমি, স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৯৭১,

বিজ্ঞাপন

কিন্তু প্রচার-প্রচারণার অভাবে আজও নীরবে-নিভৃতে থমকে আছে জল্লাদখানা বধ্যভূমিটি। সেখানে যে মুক্তিযুদ্ধের এত বড় একটি স্মৃতি চিহ্ন আছে সেটিও স্থানীয়দের অধিকাংশই জানেন না। আবার দু-একজন শুধু জানেন জায়গাটির নাম জল্লাদখানা, কিন্তু সেখানে আসলে কি ঘটেছিল তার ইতিহাস সম্পর্কেও তাদের নেই তেমন কোনো ধারণা। যে কারণে বধ্যভূমির ব্যাপারে স্থানীয়দেরও তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।

সরেজমিনে ভোর সোয়া ছয়টার সময় মিরপুর জল্লাদখানা বধ্যভূমিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোন দর্শনার্থী নেই। জল্লাদখানায় প্রবেশের প্রধান ফটক তালাবন্ধ। তার পাশের দেয়ালে এক টুকরো কাগজে লেখা ‘পরিদর্শনের সময় প্রতিদিন সকাল ১০ থেকে বিকাল ৫টা (শীতকালীন)’। এটি দেখে বুঝা গেল ১০টার আগে এটি উন্মুক্ত হবে না।

জল্লাদখানা বধ্যভূমি, স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৯৭১,

গেইটের একটু সামনে সীমানা দেয়ালের পাশে ছোট্ট টং দোকানের গফুর নামে একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি চা বিক্রির জন্য সবে চুলাটা জ্বালিয়েছেন। তবে আজ যে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস জীবিকার তাড়নায় তা তিনি ভুলেই গেছেন। তিনি এও ভুলে গেছেন যে, কাক ডাকা ভোরে যে জায়গায় দোকান খুলেছেন সেখানে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছেন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীরা।

বিজ্ঞাপন

গফুর বলেন, আজকে বুদ্ধিজীবী দিবস আপনি না বললে মনেই পড়তো না। কিন্তু দেখেন দিবসটি উপলক্ষে এখানে কোনো লক্ষণ আছে? প্রতিবছর এদিনে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় লোকজন গিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। কিন্তু এখানে কাউকে আসতে দেখি না।

তার কথা অনুযায়ী সেখানে অপেক্ষা করলেন এই প্রতিবেদক। সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত বধ্যভূমি পরিদর্শন কিংবা শ্রদ্ধা জানাতে কাউকে দেখা যায়নি। এমনকি শহীদ পরিবার কিংবা মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের কাউকে দেখা যায়নি। তবে সাড়ে আটটার সময় মোস্তফা জামান নামে একজন তার ভাগ্নেকে সাথে করে এসেছিলেন জল্লাদখানাটা ঘুরে দেখানোর জন্য। কিন্তু গেইটে গিয়ে তালাবন্ধ দেখে ফিরে গিয়েছেন তিনি।

জল্লাদখানা বধ্যভূমি, স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৯৭১,

 

মোস্তফা জামান বলেন, আসছি আজ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে জল্লাদখানা বধ্যভূমিটা ভাগ্নেকে দেখানোর জন্য। কিন্তু এটা তো তালা মারা। যে কারণে ফিরে যাচ্ছি। তবে অন্তত আজকের দিনটাতে ভোর থেকে এটা খোলা রাখা উচিত ছিল। এটা তালাবন্ধ থাকা দেখে সত্যি কষ্ট পেলাম।

মোস্তফা জামান চলে যাওয়ার পনের মিনিট পর অর্থাৎ সকাল পৌনে নয়টার দিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ভারপ্রাপ্ত মেয়র জামাল মোস্তফা মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়ে জল্লাদখানা বধ্যভূমি পরিদর্শনে আসেন। কিন্তু এসে দেখেন সেটি তালাবন্ধ। দায়িত্ব-রত কাউকে তিনি সেখানে খুঁজে পাননি। পরে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ডেকে পাঠান তিনি। প্রায় ২০ মিনিট তিনি জল্লাদখানায় প্রবেশের অপেক্ষায় থাকেন। এসময় এমন পরিস্থিতির জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন।

জল্লাদখানা বধ্যভূমি, স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৯৭১,

সকাল নয় চার মিনিটে অবশেষে ডিএনসিসির মেয়রের কারণে জল্লাদখানার গেইট খোলা হয়। পরে তিনিসহ তার সঙ্গে আসা ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা এ এস এম মামুন ও মেয়রের ব্যক্তিগত সহকারীসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা প্রবেশ করেন। এরপর তারা জল্লাদখানার বিভিন্ন নিদর্শন ঘুরে দেখেন এবং কিছুক্ষণ সেখানে সংশ্লিষ্টদের সাথে অবস্থানের পর চলে যান। এসময় তাঁদের কাউকে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য নীরবতা পালন কিংবা শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় দোয়া করতে দেখা যায় নি।

জল্লাদখানা পরিদর্শন শেষে ডিএনসিসির ভারপ্রাপ্ত মেয়র জামাল মোস্তফা সারাবাংলাকে বলেন, স্বাধীনতার সময় আমাদের এ অঞ্চলে যারা ছিলেন যারা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তাদেরকে ধরে নিয়ে এসে জবাই করে হত্যার মাধ্যমে এখানে কূপে ফেলতো। তাই এ দিবসটি গভীর শোক এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বলছি, এমন নৃশংস গণহত্যা যেন পৃথিবীর কোথাও না হয় সেটাই আমরা প্রার্থনা করবো আল্লাহর কাছে।

জল্লাদখানার সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধায়ক প্রমিলা বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, আমরা প্রতিদিন সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এটি উন্মুক্ত রাখি। তবে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় কিংবা মুক্তিযোদ্ধা যাদুঘর কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে আজ ভোর থেকে এটা খোলা রাখার এমন কোনো নির্দেশনা দেয়নি। তবে নির্দেশ পেলে আমরা অবশ্যই ভোর থেকেই এটা খোলা রাখার ব্যবস্থা করতাম।

সারাবাংলা/এসএইচ/এনএইচ

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন