বিজ্ঞাপন

এই প্রথম বাংলাদেশের পরাজয় চেয়েছি!

December 23, 2018 | 8:43 am

প্রভাষ আমিন ।।

বিজ্ঞাপন

প্রথমবারের মত ট্রেবল জয়ের সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল বাংলাদেশের সামনে। ট্রেবল মানে টেস্ট এবং ওয়ানডে সিরিজের পর টি-২০ সিরিজও জেতার সুযোগ। দৈত্য হয়ে ওঠা লুইস যখন ব্যাট করছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বুঝি রানের রেকর্ড-টেকর্ড করে ফেলবে। নিদেনপক্ষে ২৫০ রান তো হবেই। তখন আফসোসই হচ্ছিল, সাকিব কেন টস জিতে ফিল্ডিং নিতে গেলেন। মাহমুদুল্লাহ আর সাকিব মিলে সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৯০ রানে অলআউট করে বুঝিয়ে দিলেন, হাল ছাড়া যাবে না। জবাবে যখন লিটন দাস দৈত্য হয়ে গেলেন, মনে হচ্ছিল খেলা বুঝি ১৫ ওভারেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু খেলাটি বদলে গেল চতুর্থ ওভারে।

শুধু স্কোরকার্ড দেখলে মনে হবে, খেলাটি বুঝি বাংলাদেশের দিকেই ঘুরলো। থমাসের এক ওভারে ৩০ রান নিয়ে বাংলাদেশ রান চেজে অনেকটাই এগিয়ে যায়। ৪ ওভার শেষে বাংলাদেশ ১ উইকেটে ৬২ রান। নিশ্চিত জয়ের দিকেই এগিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ৯ বলে ৩০ রানের সেই ওভারেই নৈতিকভাবে হেরে যায় বাংলাদেশ, দারুণভাবে খেলায় ফিরে আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। থমাসের ওভারের পঞ্চম বলটি আম্পায়ার ‘নো’ ডাকেন। সেটিতে বাউন্ডারি মারেন লিটন, তাই রান আসে পাঁচ। এরপর ফ্রি হিটে মারেন ছক্কা। পরে রিপ্লেতে দেখা যায়, আসলে ‘নো’ নয়, বলটি ‘ইয়েস’ ছিল। আম্পায়ারের মানবিক ভুল হিসেবে সেটি কেউ ধর্তব্যে নেননি। কিন্তু পরের বলেই আবার একই ঘটনা ঘটে। ইনিংসের শেষ বলটিও ‘নো’ ডাকেন বাংলাদেশের আম্পায়ার তানভির আহমেদ। ‘নো’ কল শুনেই হয়তো লিটন তুলে মেরেছিলেন, মিড অফে ক্যাচ উঠেছিল, ক্যাচ ধরেও ছিলেন ক্যারিবিয় ফিল্ডার। কিন্তু যেহেতু ‘নো’ তাই ক্যাচ হয়নি। আম্পায়ার ফ্রি হিট দিলেন।

কিন্তু এবার সাথে সাথেই মাঠে বড় পর্দায় দেখা গেল আগের মত এটিও ‘নো’ বল নয়। এবার তীব্র আপত্তি জানালো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। রিভিউ চাইলো। কিন্তু ‘নো’ বল কলের রিভিউ হয় না। কিন্তু অনড় ক্যারিবিয়রা। অধিনায়ক ব্র্যাফেট ছুটে গেলেন সীমানার কাছে। দলের ম্যানেজম্যান্টের সাথে কথা বললেন। এলেন রিজার্ভ আম্পায়ার শরফুদ্দৌলা, ম্যাচ রেফারি জেফ ক্রো, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং কোচ মুশতাক আহমেদ, বাংলাদেশের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। সবার আলোচনায়ও সমাধান হলো না। মাঠের আম্পায়ারের কলই বহাল থাকলো- নো বল এবং ফ্রি হিট। সবাই মিলে যে সিদ্ধান্ত নিলেন তা ন্যায্য হলো না। বলটি ‘নো’ ছিল না, এটা যেমন ঠিক; আবার বলটি বৈধ ডেকে লিটন দাসকে আউট দেয়াও ন্যায্য হতো না। কারণ লিটন দাস তো ‘নো’ কল শুনেই তুলে মেরেছিলেন। তবে ব্র্যাফেট যেভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন, দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন; তা দারুণ প্রশংসনীয়। প্রতিবাদে আমি ব্র্যাফেটের পাশেই ছিলাম।

বিজ্ঞাপন

সবচেয়ে ভালো হতো বলটি ডেড ঘোষণা করলে। তাতে কারোই ক্ষতি হতো না। এতকিছুর পরও পরের বলটি ফ্রি হিট ঘোষণায় আমি লজ্জা পেয়েছি, কষ্ট পেয়েছি। ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা। সেই স্পিরিটের সাথে গেল না বিষয়টা। তখন পর্যন্ত বিষয়টি আম্পায়ারের ভুল হিসেবেই বিবেচ্য ছিল। আম্পায়াররাও মানুষ, ভুল তারা করতেই পারেন। কিন্তু একই ওভারে দুটি বৈধ বলকে যিনি ‘নো’ ডাকেন, তার আন্তর্জাতিক ম্যাচে দাড়ানোই উচিত না। যার বিরুদ্ধে লোকাল ক্রিকেটে বাজে আম্পায়ারিংএর অনেক অভিযোগ, তাকে কেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আনতেই হলো? এই সিরিজেই এই তানভির আহমেদের সাথে তর্কে জড়িয়ে জরিমানা গুনতে হয়েছে সাকিবকেও। তানভির আহমেদ অভিষেক সিরিজটিকে নিজের জন্য দুঃস্বপ্ন তো বানালেনই, কলঙ্কিত করলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটকেও।

তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে বাঁচিয়ে দেয়ার সুযোগ ছিল সৌম্য সরকারের সামনে। আম্পায়ারের ভুলের দায় ব্যক্তির ওপর দিয়েই যেতে পারতো। কলঙ্কটা ক্রিকেটের গায়ে নাও লাগতে পারতো। আমি আশা করেছিলাম, অফিসে কয়েকজনের সাথে আলোচনাও করেছিলাম; সৌম্য সরকার ফ্রি হিটের সুবিধাটি নেবেন না, ডিফেন্স করবেন। কিন্তু সৌম্যকে ছক্কা মারতে দেখে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছিল, কষ্ট পেয়েছি। বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান ছক্কা মারছে, আর আমার কষ্ট লাগছে; এমন অদ্ভূত অনুভূতি আগে কখনো হয়নি। সৌম্য সরকারের ছক্কার আগ পর্যন্ত এ ঘটনায় বাংলাদেশ দলের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। আম্পায়ার ‘নো’ ডেকেছেন, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কীইবা করার ছিল।

কিন্তু সৌম্য সরকার কি ভুলে গেলেন, ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা। তার এই শটটি কোনোভাবেই ক্রিকেটিং স্পিরিট বা স্পোর্টিং স্পিরিটের সাথে যায় না। বিতর্কিত সেই ফ্রি হিটে শট খেলার সিদ্ধান্তটা কি সৌম্যের একার, নাকি অধিনায়কের, নাকি টিম ম্যানেজম্যান্টের? যে বা যারাই করুক, তারা বাংলাদেশের একজন অন্ধ সমর্থককে কষ্ট দিয়েছেন, তাদের জন্য করুণা।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ অনেকবার বাজে আম্পায়ারিংএর শিকার হয়েছে। তাই এই অনুভূতিটা আমরা জানি। ক্যারিবিয় সমর্থকদের বেদনাটা আমি অনুভব করি। আমাদের যেমন খারাপ লেগেছে, ক্যারিবিয়দেরও নিশ্চয়ই খারাপ লেগেছে। আম্পায়ারদের ভুলের দায় বাংলাদেশ দলের নয়। কিন্তু সৌম্য সেই অন্যায় ফ্রি হিটে ছক্কা মেরে নৈতিকভাবে হারিয়ে দিলেন বাংলাদশকে। পোয়েটিক জাস্টিস বলে একটা কথা আছে। পরের ওভারেই পরপর দুই বলে সৌম্য আর সাকিবকে ফিরিয়ে দিয়ে দারুণভাবে খেলায় ফিরে আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১ উইকেটে ৬৪ রানের নিরাপদ পথ থেকে মুহূর্তেই বাংলাদেশ ৪ উইকেটে ৬৬ রানের অতলে। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মনোবল তখন তুঙ্গে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বদলে যায় তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। এরপর বাংলাদেশ কত রানে হেরেছে, সেটা আর বিবেচ্য নয়। বাংলাদেশ আসলে হেরে গেছে সেই ফ্রি হিটেই।

জীবনে এই প্রথম বাংলাদেশের পরাজয় চেয়েছি। চেয়েছি অন্যায়ের হাত ধরে কোনো জয় যেন বাংলাদশকে কলঙ্কিত না করে, আমাদের কষ্টার্জিত অনেক অর্জনকে যেন মলিন না করে। অন্যায় সবসময় অন্যায়। সেটা ভারত করলেও অন্যায়, পাকিস্তান করলেও; এমনকি বাংলাদশকে করলেও।

খেলে জেতার যে গৌরব, যে আনন্দ; চোট্টামির জয়ে তা নেই। এমনকি বাংলাদেশ ক্রিকেটের বেড়ে ওঠার সময়, যখন একটি জয় আসতো অনেকদিন পরপর মহার্ঘ্য হয়ে; তখনও আমি বৃষ্টি আইন বা কোনো ফাঁক ফোকর দিয়ে জয় আসুক চাইনি। আমি চেয়েছি, এখনও চাই বাংলাদেশের প্রতিটা জয় হোক অর্জনের, অহঙ্কারের, গৌরবের। পরিসংখ্যানে আমার আগ্রহ নেই, ক্রিকেট বাণিজ্যে আমার ঘেন্না। আমি চাই খেলাধুলা হবে স্পোর্টিং স্পিরিটে; যাতে মিশে থাকবে সম্মান, মর্যাদা, গৌরব। খেলার মাঠ কিন্তু যুদ্ধ বা রাজনীতির মাঠের মত নয়।

প্রভাষ আমিন
২২ ডিসেম্বর, ২০১৮

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এমএইচ

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন