বিজ্ঞাপন

‘আমার তিনটা বাচ্চা আছে, আমি সুস্থ হতে চাই’

January 24, 2019 | 6:34 pm

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ‘আমার তিনটা বাচ্চা আছে, আমি সুস্থ হতে চাই।  আমি হাসপাতালের বিছানায় থাকব, আমার তিনটা বাচ্চা না খেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরবে আর আসামির কোনও বিচার হবে না, সে বহাল তবিয়্যতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।  আমি এই অন্যায়ের বিচার চাই।’ বৃহস্পতিবার (২৪ জানুয়ারি) ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের কেবিনে এসিডদগ্ধ তাসলিমা আক্তার এভাবে নিজের ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দেন।

এসিডে শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়ে যাওয়া তাসলিমা আক্তার বলেন,  ‘আমার স্বামী আমানুল্লাহর ছোড়া এসিডে শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মন আর স্বপ্নও ‍পুড়েছে।’

কেবিনে গিয়ে দেখা গেছে, ‘তাসলিমা আক্তারের পুরো মুখ পুড়ে কালো হয়ে গেছে।  বাম হাত, পেটের বামপাশ ও পুরো বুক পুড়ে গেছে।  বাম হাতসহ বুক ব্যান্ডেজ করা। তাতে স্যালাইন চলছে। ডান চোখ ক্ষতিগ্রস্ত, দেখতে সমস্যা হচ্ছে।  শুয়ে আছেন হাসপাতালের বিছানায়। ’

বিজ্ঞাপন

তাসলিমা বলেন, ‘নারীর নাকি অধিকার বেশি, কই অধিকার বেশি? আসামি ঘুরতেছে।  আর আমি ভুগতেছি।  আমার বাবা-মা অসহায়, আমার তিনটা বাচ্চা কই আছে, কী খাইতেছে, কোনও খোঁজ আছে?’

কথা বলতে বলতে একটু থামলেন তিনি।  কপালে দুশ্চিন্তর ভাঁজ।  একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তসলিমা বলেন, ‘একটু জায়গা কিনেছি। ইচ্ছা ছিল আবার যাইয়া একটু বাড়ি করমু, একটা দোকান কইরা দিমু। আমি বাচ্চাদের নিয়া থাকতাম। এখন আমাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হইয়া গেছে, আমি এর বিচার চাই।’।

এদিকে, তাসলিমার সঙ্গে থাকা ছোট বোন আকলিমা বেগম জানালেন, ২০০৩ সালে স্থানীয় মাদ্রাসার মৌলভী আমানুল্লার সঙ্গে বিয়ে হয় তাসলিমা আক্তারের। খুব ছোট বয়সে মাদ্রাসার শিক্ষক পেয়ে বাবা-মা বিয়ে দেয়, কিন্তু সুখের হয়নি সে সংসার। খাওয়া দিতো না, নতুন কোনো কাপড়ও দিতো না। উল্টো যৌতুকের জন্য অত্যাচার করতো। ’

বিজ্ঞাপন

বোন যখন এসব কথা বলছিলেন, তখন বিছানা থেকে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তাসলিমা।  বলেন, ‘কতবার চইলা আসতে চাইছি, কিন্তু বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনরা নিষেধ করছে। বলছে, পোলাপান হইলে ঠিক হইয়া যাইবো, কিন্তু হয় নাই।’ এসময় স্বগতোক্তি করেন, ‘অমানুষ কী কখনো মানুষ হয়?’

তাসলিমার কথা শেষ হতেই আকলিমা বলেন, ‘অত্যাচার সইতে না পেরে ২০০৫ সালে প্রথম ছেলের পর মারধরের কারণে তাসলিমা বাবার বাড়ি চলে আসেন। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির সবাই তখন বলে, ছেলে হয়েছে। এবার ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু হয়নি, এরমধ্যে তিন সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু অত্যাচার থামেনি, বরং দ্বিতীয় বিয়ে করেছে তার স্বামী।’

আরও পড়ুন: বিনামূল্যে পরীক্ষা, তবুও শনাক্তের বাইরে ৭০ শতাংশ নারী

এ সময় আকলিমার স্বামী নূরে আলম বলেন, ‘তাসলিমার শ্বশুর বাড়িতে বাবার বাড়ি থেকে চাল-ডাল-সবজি যেতো। ঘরে কিছু না থাকলেই তাসলিমার ওপর চলতো অত্যাচার। অত্যাচার থেকে বাঁচতেই তাসলিমা সৌদি আরব যান ২০১৬ সালে।  সেখান থেকে প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার টাকার মতো পাঠান ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার জন্য। কিন্তু তাদের আদতে কোথাও ভর্তিই করানো হয়নি।  পুরো টাকাটাই নিজে খরচ করেছেন তাসলিমার স্বামী।’

বিজ্ঞাপন

নূরে আলম আরও বলেন, ‘সৌদি আরব থেকে গত দুই মাস আগে দেশে আসেন তাসলিমা।  দেশে ফিরে দেখেন স্বামী আবার বিয়ে করেছে।  সংসার খরচের টাকার কথা বলতেই নানা অত্যাচার চলে তাসলিমার ওপর, গলায় এখনো দাগ ছিল, হাতে ছিল ক্ষতচিহ্ন।  তখন সংসার করবো না জানালে স্বামী হুমকি দেন, তোরে এমন কাজ করমু যে, সমাজে চলতে পারবি না, কাউরে মুখ দেখাইতে পারবি না, কাজ করতে পারবি না।’

স্বজনরা জানান, সৌদি আরব থেকে ফিরে এসে বাবার বাড়ির পাশে বাসা ভাড়া নেন তাসলিমা।  ইচ্ছে ছিল আরও দুই বছর বিদেশে থেকে ছেলেকে একটা দোকান করে দেবেন, মেয়েদের লেখাপড়াটুকু চালিয়ে যাবেন।

আকলিমা বলেন, ‘গত ২২ জানুয়ারি বিকাল থেকেই তাসলিমার স্বামী বাড়িতে এসে হাজির হন। সেই রাতে আগেই দরজা খুলে রেখেছিলেন।  কম্বল তুলে ঘুমন্ত তাসলিমার মুখে এসিড ছুড়ে পালিয়ে চলে যান তিনি।  এসিড লাগে ছোট মেয়ের পায়েও। সেদিনই প্রথমে নরসিংদী সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে এই হাসপাতালে স্থানান্তর করতে বললে রাত সাড়ে চারটার দিকে এখানে নিয়ে আসি।’

এদিকে, এসিডদগ্ধ তাসলিমার কথা জানালে তাকে দেখতে যান বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন।  তিনি বলেন, ‘‘তাসলিমার হাত, বুক, মুখসহ প্রায় ১৫ শতাংশ ‘মিক্সডবার্ন’।  ডান চোখ ক্ষতিগ্রস্ত। অস্ত্রোপচার করতে হবে। ’

দরিদ্র রোগী তাসলিমার এত খরচ করার সামর্থ্য নেই জানালে ডা. সামন্তলাল সেন বলেন, ‘ওষুধ-পত্রসহ সব খরচ আমরা বহন করব।  আমি এর দায়িত্ব নিলাম।

এ ঘটনায় কোনও মামলা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তাসলিমা বলেন, ‘কেস কইরা কী হইবো? কারও কাছে বইলাই কী হইবো? নারীর প্রতি অন্যায়ের কোনও বিচার আছে, সমাজে নারীর কোনও মর্যাদা নাই।’ যদিও ঘটনার পরদিনই তাসলিমার বাবা বাদি হয়ে মাধবদী থানায় মামলা করেছেন।  কিন্তু আসামিকে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।’

আসামি গ্রেফতার না হওয়া প্রসঙ্গে জানেত চাইলে মাধবদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মমর্তা আবু তাহের দেওয়ান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা আসামিকে গ্রেফতারের বিষয়ে সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। তার মোবাইল ট্র্যাকিং করে আগাচ্ছি আমরা। ’ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, আসামিকে গ্রেফতার করা হবে বলেও জানানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

সারাবাংলা/জেএ/এমএনএইচ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন