বিজ্ঞাপন

কেন তৃণমূলে কাজ করতে চান না চিকিৎসকরা?

January 29, 2019 | 10:08 am

।। এমএকে জিলানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: সম্প্রতি রাজধানী ঢাকাসহ আট জেলার ১০ হাসপাতালে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ চিকিৎসককে অনুপস্থিত দেখতে পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এক অনুষ্ঠানে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, কোনো চিকিৎসক কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে ওএসডি করা হবে। তবে এর আগেও জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে চিকিৎসকদের উপস্থিতি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এমন কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রোগীদের অভিযোগ, তাতেও তৃণমূল পর্যায়ে চিকিৎসকদের উপস্থিতি বাড়েনি।

চিকিৎসকরা কেন তৃণমূল বা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কাজ করতে আগ্রহী হন না, এ বিষয়ে সারাবাংলার পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য খাতের একাধিক বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকের সঙ্গে কথা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তৃণমূল পর্যায়ে সেবা দেওয়ার জন্য চিকিৎসকদের উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে তৃণমূল বা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা, কাজের সঠিক পরিবেশ, থাকা-খাওয়ার পরিবেশ এবং উন্নত চিকিৎসার স্বার্থে পাঠাগার সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

চিকিৎসা খাতের বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতের চিকিৎসকরা কাজের ধরন অন্য যেকোনো পেশা থেকে ভিন্ন। তাই দুদক অভিযানে যাওয়ার আগে একবার স্বাস্থ্য খাতের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে নিলে ভালো হতো এবং সঠিক চিত্র পাওয়া যেত।

বিজ্ঞাপন

তবে সারাবাংলার সঙ্গে আলাপকালে সব চিকিৎসকই বলেছেন, তারা সবাই সেবা দেওয়ার মানসিকতা থেকে এই পেশায় এসেছেন। তারা সেবা দিতে চান, কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পরিবেশ।

চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি ‘গ্রহণযোগ্য’ নয়, ব্যবস্থা নেবে মন্ত্রণালয়

কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে কর্মরত চিকিৎসক ডা. শেখ ফৈয়াজ সামসুদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা যারা চিকিৎসা পেশায় নিজেদের নিয়োগ করেছি, তারা সেবা করার মানসিকতা নিয়েই এই পেশায় এসেছি। কিন্তু জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসকদেরও ন্যূনতম সুযোগ থাকতে হবে। আমি ১০ বছর আগে পাবনার চাটমোহর উপজেলায় প্রথম সরকারি চাকরিতে যোগ দেই। তখন ওই উপজেলায় আমাকে একটি পরিত্যক্ত সরকারি স্থাপনায় থাকতে দেওয়া হয়। সেখানে খাবারের কোনো ভালো ব্যবস্থা ছিল না। যেখানে থাকার জায়গা দিয়েছিল, সে জায়গাটি পরিত্যক্ত এবং জঙ্গলবেষ্টিত থাকায় কয়েক দফায় বিষাক্ত সাপের আক্রমণ হয়। আর থাকার জায়গা থেকে চুরি হওয়ার বিষয় তো স্বাভাবিক ছিল।’

বিজ্ঞাপন

ডা. শেখ ফৈয়াজ আরও বলেন, ‘সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, চাটমোহরে চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে বেশ কয়েক দফায় স্থানীয় চেয়ারম্যানের হুমকি পেতে হয়েছে। কারণ হচ্ছে, আমি তাদের কথামতো স্থানীয় ক্লিনিকে প্র্যাকটিস করতাম না এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীদের যে সেবা দিতাম, তাতে তাদের বাইরের ক্লিনিকে যেতে হতো না। এ জন্য স্থানীয় চেয়ারম্যান আমরা ওপর বিরক্ত ছিলেন এবং আমাকে প্রতিনিয়ত ভয়-ভীতি দেখাতেন।’

একজন চিকিৎসককে কোনো জায়গা নিয়োগ দেওয়ার আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন উল্লেখ করে এই চিকিৎসক বলেন, ‘চাটমোহর থেকে দাউদকান্দি উপজেলায় আমার বদলি হলো। এখানে থাকা-খাওয়ার কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক সমস্যা ছিল। প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক কর্মীরা মারামারি করে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসত। চিকিৎসক হিসেবে কে কোন দলের কর্মী, তা আমার দেখার বিষয় না। কিন্তু একদল এসে শাসাত, যারা এসেছে তাদের চিকিৎসা দেওয়া যাবে না, চিকিৎসা দিলে আমার ক্ষতি হবে। তো সেবা দিতে গিয়ে প্রতিনিয়ত এমন ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হয়।’

হাসপাতালে দুদক: বিভক্ত চিকিৎসকরা

পেশাজীবি পরিষদের মহাসচিব এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ডা. কামরুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ যে তিনি ভালো কথা বলেছেন। যেকোনো খাতেরই উন্নতির জন্য তাকেই তদারকি করতে হয়। চিকিৎসা খাতের সেবার উন্নতির জন্য এই খাতের প্রশাসনের দায়িত্ব রয়েছে। দুদকেরও এখতিয়ার আছে। কিন্তু স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করলে ভালো হতো।’

বিজ্ঞাপন

স্বাস্থ্যসেবা এখন জটিল একটা পর্যায়ে আছে উল্লেখ করে ডা. কামরুল হাসান বলেন, ‘সমাধানের আগে সমস্যাগুলো বুঝতে হবে। সারাদেশে সব মিলিয়ে মাত্র ৮৬ হাজার চিকিৎসক রয়েছেন, যা ১৬ কোটি মানুষের জন্য অপ্রতুল। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মেডিকেল কলেজ ১১১টি। এখানে স্বাস্থ্য খাতের জনবলের সমন্বয় করার বিষয় রয়েছে। প্রতিবছর প্রায় দুই হাজার চিকিৎসক পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করতে আসেন। এখানে একটা গ্যাপ আছে। নতুন মেডিকেল কলেজে সংশ্লিষ্ট জেলার মেডিকেল অফিসারকে উঠিয়ে এনে লেকচারার বানানো হচ্ছে। এরপর নানা ধরনের সংযুক্তি রয়েছে। সব মিলিয়ে চিকিৎসক স্বল্পতা রয়েছে। একটা উপজেলায় চিকিৎসকের পদ রয়েছে ৩৩টি, যেখানে পদায়ন রয়েছে মাত্র ছয় থেকে সাত জনের। এই অল্প কয়েকজনের পক্ষে সেবা দেওয়া সম্ভব না।’

বিএসএমএমইউয়ের সাবেক এই উপাচার্য আরও বলেন, ‘প্রথম কথা হলো— চাকরির বিধি মানতে হবে। ম্যানেজমেন্টের জায়গা ঠিক রাখতে হবে। মন্ত্রী থেকে শুরু করে যে চেইন রয়েছে— মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, পরিচালকের কার্যালয়, সিভিল সার্জনের কার্যালয়সহ ম্যানেজমেন্টের সব জায়গাগুলোতে আরও সমন্বয় প্রয়োজন। একটা মেয়ে বা ছেলের বিরুদ্ধে অভিযাগ করার আগে আমাদের দেখা প্রয়োজন, যেখানে তার পোস্টিং সেখানে তার আসা-যাওয়ার নিরাপত্তা বা ভালো ব্যবস্থা রয়েছে কিনা। ম্যানেজম্যান্টকে অনেক কিছু ম্যানেজ করতে হয়, এই বিষয়গুলো দেখা প্রয়োজন। শুধু হুইপিং করে কাজ হবে না, পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ম্যানেজমেন্টের সমন্বয় করা প্রয়োজন। সুপারভিশন, মনিটরিং ও ফলোআপ— এই বিষয়গুলো শক্তিশালী করা প্রয়োজন।’

ডা. কামরুল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা মেনেই সমস্যার সমাধান করা যায়। শিক্ষানবিশরা মাত্র ১৫ হাজার টাকা বেতন পায়, অথচ এরাই হাসপাতালগুলোর প্রাণশক্তি।’

১০ হাসপাতালে দুদকের অভিযান, ৯২ চিকিৎসক অনুপস্থিত

ক্যানসার ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আকরাম হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘নীতিগতভাবেই মনে করি যে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি স্বাস্থ্য খাতের পুরানো সমস্যা। তবে আমি বিশ্বাস করি, চিকিৎসকরা সঠিক সময়েই অফিস করার মানসিকতা নিয়ে কাজ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত বা অন্য কারণে বেশিরভাগ উপজেলা বা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎকদের আবাসস্থলসহ বিভিন্ন দরনের প্রতিকূলতা রয়েছে। সেই প্রতিকূলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে এবং পাশাপাশি এলাকাতে কাজ করার জন্য চিকিৎসকদের মোটিভেট করা অর্থাৎ তৃণমূল জায়গাতে থেকেও যে ক্যারিয়ার গড়া যায়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলে দুর্গম অঞ্চলেও যে কেউ কাজ করতে উৎসাহিত হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তৃণমূল জায়গায় যে চিকিৎসকরা সেবা দিচ্ছেন, তাদের যদি পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনসহ অন্য ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া যায় এবং তাদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও বেশি সুযোগ দেওয়া যায়, তবে গ্রামে-গঞ্জে যাওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের অনীহা থাকার কথা নয়। আবার চিকিৎসকরা কী চান, সেটাও তাদের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। তবে চিকিৎসকদের উৎসাহিত করতে হবে। বিশেষ করে হার্ড টু রিচ (অত্যন্ত প্রত্যন্ত অঞ্চল বা দুর্গম অঞ্চল) এলাকায় যে চিকিৎসদের নিয়োগ দেওয়া হবে, তাদের শহরের চিকিৎসকদের চেয়ে বেশি সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন। যত বেশি দুর্গম অঞ্চলে চিকিৎসকরা যাবেন, তাদের বেতন-ভাতা বা অন্যান্য সুবিধা তত বেশি হবে— এমন নীতি হওয়া উচিত। তাহলে সবাই দুর্গম এলাকায় কাজ করতেও উৎসাহ পাবেন।’

ডা. আকরাম আরও বলেন, ‘জেলা বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে চিকিৎসকরা বৈকালিক বা নির্দিষ্ট রোস্টারের বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারবেন— এমন একটি ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাবনা ২০০৭ সালে ছিল। এমন উদ্যোগ নিলে অনেকে স্বেচ্ছাতেই উপজেলায় কাজ করতে যাবেন। আসলে মূল লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের সেবা নিশ্চিত করা। সব সরকারই একই ধরনের মতামত ব্যক্ত করছেন। চিকিৎসকরাও একমত, তারাও কাজ করতে চান। কিন্তু এর জন্য প্রকৃত অর্থে পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্সদের সংখ্যাও কম। গ্রামে প্রতি ১৫ হাজারে একজন চিকিৎসক এবং শহরে প্রতি ৫০০ জনে একজন করে চিকিৎসক রয়েছেন। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, এক হাজার জনের জন্য একজন চিকিৎসক প্রয়োজন। যেখানে আমাদের শহর থেকে গ্রামের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক।’

তিনি আরও বলেন, ‘স্বাস্থ্য অবকাঠামোগুলোকে অর্গানাইজ করা প্রয়োজন। ইউনিয়ন ওয়ার্ড ও উপজেলা হাসপাতালের মধ্যে সঠিক সমন্বয় করা প্রয়োজন। উপজেলায় কনসালট্যান্ট পর্যায়ের অনেক পদ রয়েছে। ওই জায়গাতে একাডেমিক পরিবেশ গড়তে হবে, যেন চিকিৎসকরা পড়ালেখা করতে পারেন। কেননা ভালো চিকিৎসার জন্য পড়ালেখার বিকল্প নেই। তাই উপজেলা পর্যায়ে এমন পরিবেশ গড়তে হবে যেন সেখানে পাঠাগার থাকে, থাকা-খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা থাকে, চিকিৎসকদের ছেলেমেয়েদেরও পড়ালেখা করার সুযোগ থাকে। এগুলো ন্যূনতম চাহিদা, যা পূরণ করা প্রয়োজন।’

সারাবাংলা/জেআইএল/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন