বিজ্ঞাপন

পিলখানা হত্যা: পূর্ণাঙ্গ রায়ের অপেক্ষা, ঝুলে আছে বিস্ফোরক মামলা

February 25, 2019 | 4:02 am

।। আব্দুল জাব্বার খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: পিলখানা হত্যা মামলায় হাইকোর্টে আপিলের রায় শেষ হলেও ঝুলে আছে বিস্ফোরক মামলা। এর ফলে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বিচারপ্রার্থীরা। বহুল আলোচিত পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ১০ বছরেও বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়ায় খালাসপ্রাপ্ত অন্তত তিনশ জনের জামিন মিলছে না।

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের দশ বছর আজ

আসামিপক্ষের আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন এদিকে হাইকোর্টে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ না হওয়া, অন্যদিকে বিচারিক আদালতে বিস্ফোরক মামলায় মাত্র ৭৮ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। এর ফলে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বিচার প্রার্থীরা। তবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেছেন, এটি বিশ্বের বৃহত্তম একটি মামলা। যার আসামি সংখ্যা অনেক। এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হতে সময় লাগবে এটাই স্বাভাবিক। আর বিস্ফোরক মামলাটি চলতি বছরের মধ্যেই শেষ হবে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আরেক আইনজীবী।

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে মর্মান্তিক এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। হত্যা মামলায় ১৩৯ জনের ফাসিঁ, ১৮৫ যাবজ্জীবন সাজা দিয়ে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে হাইকোর্ট রায় দেন। তবে পূর্ণাঙ্গ রায় এখনও প্রকাশ হয়নি। অন্যদিকে বিস্ফোরক মামলাটি বিচারিক আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি মনে করি রাষ্ট্রপক্ষ কৌশলে এটি দীর্ঘায়িত করছে। একদিকে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ না হওয়া অন্যদিকে বিচারিক আদালতে বিস্ফোরক মামলায় শেষ না হওয়ায় সাজা খাটা শেষ হলেও তারা মুক্তি পাচ্ছেন না।’

মামলাটি কালক্ষেপণের জন্য রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এমনটি করছে বলেও অভিযোগ করেন এ আইনজীবী। হাইকোর্টে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে বিচারিক আদালতে কম সাজা প্রাপ্তদের জামিন চেয়ে আবেদন করা হবে বলেও জানান আইনজীবী আমিনুল ইসলাম।

বিজ্ঞাপন

আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী শামীম সর্দার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি মনে করি এই ধীর গতি প্রসিকিউশন পক্ষের একটা প্রাক্টিস, যেটা আসামিদের বের হওয়ার পথে একটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্য করা হচ্ছে। হত্যা মামলাটি প্রতিকার্য দিবসে শুনানি হলেও বিস্ফোরক মামলাটি দীর্ঘ সময় পর পর শুনানি হচ্ছে। অথচ আইনের বিধান হলো একটি ঘটনায় যে কয়টি মামলা হবে সব কটি মামলা একই সঙ্গে পাশাপাশি চলবে। হত্যা মামলায় যারা সাক্ষী, বিস্ফোরক মামলায়ও একই সাক্ষী। তাহলে কেন এ মামলাটি নিষ্পত্তি করতে দেরি হবে। দুটি মামলার অভিযোগ গঠন কিন্তু একই সঙ্গে হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘হত্যা মামলায় দেড় শতাধিক আসামি খালাস পেয়েছে। বিপুল সংখ্যক আসামির বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। তার মধ্যে ১০ বছর পর্যন্ত যে সমস্ত আসামির সাজা হয়েছে। তাদের কিন্তু গ্রেফতারের দিন থেকে এ পর্যন্ত সাজা খাটা শেষ হয়েছে। বিদ্রোহে যাদের সাজা হয়েছে তাদের সকলেরই সাজা খাটা শেষ হয়েছে। এই আসামিদের জেলে রাখার মত আর কোনো উপায় প্রসিকিউশনের হাতে নেই। এখন বিস্ফোরক মামলাটি যদি দ্রুত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়ে রায় হয়। তাহলে বিচারপ্রার্থীরা ন্যায় বিচার পাবে।’

হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন,  ‘যেহেতু এটি ইতিহাসের একটি বৃহত্তম মামলা। এত সংখ্যক আসামি কোনো মামলায় ছিল না। দুই বছর যাবৎ এ মামলায় হাইকোর্টে আপিল শুনানি হয়েছে। এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় লিখতে সময় বেশি লাগবে এটাই স্বাভাবিক।’

বিজ্ঞাপন

বিস্ফোরক মামলার বিচারিক আদালতের প্রধান আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ থেকে কোনো ধরনের সময় ক্ষেপণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে না। আমরা কোনো সময় আবেদনও করিনি। মামলা তার নিজস্ব গতিতে চলছে। এ বছরের মধ্যে এ মামলাটির বিচার কাজ শেষ হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী। মামলায় কালক্ষেপন করা হচ্ছে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের দাবি মিথ্যা বলেও অভিযোগ করেন তিনি।’

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় পিলখানায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে ডিএডি তৌহিদসহ ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ২০১৭ সালের নভেম্বরে রায় দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন আদালত। আর এ মামলায় খালাস পান ৪৫ জন।

দুই দিনব্যাপী দীর্ঘ রায়ে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন বিশেষ বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা দেন। বেঞ্চের অপর দুই বিচারপতি হলেন মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।

পিলখানার ঘটনাটিকে কলঙ্কজনক উল্লেখ করে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে আদালত সাত দফা সুপারিশ করেন।

আদালত রায়ে নিম্ন আদালতের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ পাওয়া ১৫২ জনের মধ্যে ১৩৯ জনের ফাসিঁ বহাল রাখেন। বাকী ৮ জনকে যাবজ্জীবন, ৪ জনকে খালাস এবং বিচার চলাকালীন অবস্থায় একজনের মৃত্যু হয়।

নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়েছে। ১২ জনকে খালাস দেওয়া হয়েছে এবং আসামিদের মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছিল নিম্ন আদালত। তাদের মধ্যে ১৮২ জনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড, আট জনকে সাত বছরের কারাদণ্ড, চারজনকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে হাইকোর্ট। আর এর মধ্যে খালাস দেওয়া হয়েছে ২৯ জনকে।

এ মামলায় নিম্ন আদালতে খালাস পাওয়া যে ৬৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেছিল, তাদের মধ্যে ৩১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে হাইকোর্ট। এর মধ্যে চারজনকে সাত বছর করে কারাদণ্ড এবং ৩৪ জনের খালাসের রায় বহাল রেখেন হাইকোর্ট।

আলোচিত পিলখানা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের মধ্য দিয়ে মামলাটির বিচারপ্রক্রিয়ার দুটি ধাপ শেষ হলো। এরপরের ধাপ হিসেবে রয়েছে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ।

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিদ্রোহ চলাকালে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় প্রথমে রাজধানীর লালবাগ থানায় হত্যা এবং বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে এসব মামলা নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। সিআইডি দীর্ঘ তদন্ত শেষে হত্যা মামলায় ২৩ বেসামরিক ব্যক্তিসহ প্রথমে ৮২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। পরে সম্পূরক অভিযোগপত্রে আরও ২৬ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করায় আসামির সংখ্যা হয় ৮৫০ জন। এছাড়া বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ৮০৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় সিআইডি। পরে আরও ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে মোট ৮৩৪ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। বিচার চলার সময় বিডিআরের ডিএডি রহিমসহ চার আসামির মৃত্যু হয়।

মামলার আসামিদের মধ্যে বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীকেও দণ্ড দেওয়া হয়। সাজা ভোগকালীন বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু অসুস্থ হয়ে মারা যান।

রাজধানীর পুরান ঢাকার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ইতিহাসের কলঙ্কজনক এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন, ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে (তিন বছর থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত) কারাদণ্ড দেন।

এছাড়া ২৭৮ জনকে খালাস এবং ৪ জন আসামি বিচার চলাকালে মারা যাওয়ায় মামলার দায় থেকে তারা অব্যাহতি পান। রায়ে খালাসপ্রাপ্ত আসামিদের সাজা চেয়ে আপিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ। অন্যদিকে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা তাদের সাজা বাতিল চেয়ে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। আপিল শুনানির জন্য সুপ্রিমকোর্টের বিশেষ ব্যবস্থায় সর্বমোট ৩৭ হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়। এ জন্য মোট ১২ লাখ ৯৫ হাজার পৃষ্ঠার ৩৫ কপি ও অতিরিক্ত দুই কপি পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়। রক্তাক্ত ওই ঘটনার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিডিআর) নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) রাখা হয়।

সারাবাংলা/এজেডকে/এমআই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন