বিজ্ঞাপন

বন্ধ হয়ে গেছে কর্ণফুলী তীরের উচ্ছেদ অভিযান

February 28, 2019 | 10:59 pm

।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ঢাকঢোল পিটিয়ে কর্ণফুলী নদীর তীর থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে শুরু করা অভিযান, প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষেই কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নদীর তীর রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ শুরু হওয়ায় উচ্ছেদ আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে।

তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে- মূলত তিনটি কারণে অভিযান বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে মূল কারণ হচ্ছে- বাজেট বরাদ্দ না থাকা। এছাড়া উচ্ছেদের আওতায় থাকা নদীর তীরের অধিকাংশ জায়গার মালিক চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দরের জায়গা বন্দর উদ্ধার করবে- এমন চিন্তাভাবনা থেকে জেলা প্রশাসন পিছিয়ে গেছে। এরপর সম্প্রতি নদীর তীরবর্তী একটি বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডে ৮ জনের মৃত্যুর ঘটনার পর জনবসতি উচ্ছেদে সময় নেওয়ার কৌশল নিয়েছে জেলা প্রশাসন।

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুধু উচ্ছেদ করলেই তো হবে না, উদ্ধার করা জমি তো রক্ষণাবেক্ষণও করতে হবে। না হলে সেই জমি তো আবারও দখল হয়ে যাবে। সেজন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে চট্টগ্রাম বন্দর, জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা নিয়ে বৈঠক হয়েছিল। সেখানে উচ্ছেদ ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেটি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত আমরা উচ্ছেদ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

বিজ্ঞাপন

উচ্ছেদ অভিযান, কর্ণফুলীর তীর

চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যানের প্রস্তাবের ভিত্তিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।

গত ৪ ফেব্রুয়ারি কর্ণফুলীর তীরে নগরীর সদরঘাট থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হয়। টানা পাঁচদিন অভিযান চালিয়ে ২৩০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের মাধ্যমে ১০ কিলোমিটারেরও বেশি ভূমি দখলমুক্ত করা হয়। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় প্রথম পর্যায়ের অভিযান।

বিজ্ঞাপন

প্রথম পর্যায়ের উচ্ছেদ শুরুর পর আরও দু’টি ধাপে উচ্ছেদের কথা জানিয়েছিল জেলা প্রশাসন। চিহ্নিত করা দুই এলাকার মধ্যে আছে- নগরীর বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে পতেঙ্গা এবং সদরঘাট থেকে চাক্তাই।

জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে জানান, প্রথম পর্যায়ে দখলমুক্ত করা ভূমির প্রায় অংশ চট্টগ্রাম বন্দরের মালিকানাধীন। বারিক বিল্ডিং থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলাকার প্রায় পুরো অংশ চট্টগ্রাম বন্দরের মালিকানাধীন। শুধুমাত্র আরএস জরিপ অনুযায়ী লালদিয়ার চর এলাকায় নদীর তীরবর্তী কিছু ভূমি খাস হিসেবে জেলা প্রশাসনের আওতাভুক্ত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট আছে। তারা তো নিয়মিত অভিযান চালাতে পারে। তাদের নিজস্ব ভূমি ব্যবহার নীতিমালাও আছে। বন্দরের ভূমি উদ্ধারে জেলা প্রশাসনের প্রয়োজন নেই।’

সূত্রমতে, নগরীর পতেঙ্গায় বোট ক্লাবের পরেই লালদিয়ার চরের অবস্থান। সেই চরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের যে সীমানা চিহ্নিত করা আছে তাতে প্রায় ১৭০০ পরিবারের বসবাস। উচ্ছেদ ঠেকাতে সেখানকার বাসিন্দারা নিয়মিত বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি লালদিয়ার চর এলাকায় স্থানীয়দের একটি সমাবেশে যোগ দিয়ে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল পুনর্বাসনের আগে উচ্ছেদের বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করেন। এই অবস্থায় লালদিয়ার চরে আর কোনো অভিযান চালাতে আগ্রহী নয় জেলা প্রশাসন।

বিজ্ঞাপন

সূত্র আরও জানায়, লালদিয়ার চরের মতো একাধিক জনবসতি আছে নগরীর সদরঘাট থেকে চাক্তাই পর্যন্ত এলাকায়। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী চাক্তাই বেড়া মার্কেট এলাকায় একটি বস্তিতে আগুন লেগে ৮ জনের মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পর বক্তব্য আসে- উচ্ছেদের জন্য মৌখিকভাবে এলাকা ছাড়তে বলার পর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে এলাকার সংসদ সদস্য মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এই ঘটনার নেপথ্যে নাশকতা আছে কি-না সেটা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন।

নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগুনে ৮ জনের মৃত্যুর পর যেসব বক্তব্য এসেছে তাতে আমরা মানসিকভাবে পিছিয়ে গেছি। কারণ ওই বস্তি আরএস অনুযায়ী সরকারি জমি নয়। বিএস-এ আছে। কিন্তু হাইকোর্ট তো আরএস মূলে উচ্ছেদ করতে বলেছে। এখন সেসব এলাকায় নদীর তীরে গড়ে ওঠা অন্য জনবসতি-স্থাপনা উচ্ছেদে যাওয়াও ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের ধারণা, এই উচ্ছেদ অভিযানটা বন্ধ করার একটা চক্রান্ত এই অগ্নিকাণ্ড হতে পারে।’

তবে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো.ইলিয়াস হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সদরঘাট থেকে চাক্তাই এবং শাহ আমানত সেতুর নিচে যেসব অবৈধ জনবসতি-স্থাপনা আছে সেগুলো আমরা উচ্ছেদ করতে পারি। কারণ সেখানে সবই জেলা প্রশাসনের জায়গা। ইতোমধ্যে সেখানে মার্কিংয়ের কাজ চলছে। তবে মাস্টারপ্ল্যানটা হওয়ার পর কাজ শুরু করলে ভালো হবে বলে মনে করছি।’

সূত্রমতে, উচ্ছেদ অভিযানের জন্য জেলা প্রশাসন প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা বাজেট চেয়েছিল ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাছে। মন্ত্রণালয় থেকে সেই টাকা দেওয়ার আশ্বাস এসেছিল। তবে প্রথম পর্যায়ের উচ্ছেদ শুরুর পরও টাকা দেওয়া হয়নি। উচ্ছেদ শেষের আরও অন্ত:ত ১৫ দিন পর এসেছে মাত্র ২০ লাখ টাকা। উচ্ছেদ এবং রক্ষণাবেক্ষণ একসঙ্গে করতে হলে টাকার প্রয়োজন। কিন্তু বাজেটের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্ত পাচ্ছে না জেলা প্রশাসন।

তবে বাজেট নিয়ে কোনো সংকট নেই বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক।

উচ্ছেদ অভিযান, কর্ণফুলীর তীর

তিনি জানিয়েছেন, উচ্ছেদের পর রক্ষণাবেক্ষণই বড় সংকট। প্রথম পর্যায়ের উচ্ছেদের পর সদরঘাটের বিআইডব্লিউ ঘাট এলাকায় আবারও তিনটি অস্থায়ী ঘর তৈরি করেছিল দখলদারেরা। খবর পেয়ে জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট গিয়ে সেগুলো উচ্ছেদ করেন।

প্রথম পর্যায়ে উচ্ছেদ অভিযানের পর উদ্ধার করা ১০ একর ভূমি রক্ষণাবেক্ষণে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

২০১০ সালের ১৮ জুলাই পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস পিস ফর বাংলাদেশের এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট কর্ণফুলী নদী দখল, মাটি ভরাট ও নদীতে সব ধরনের স্থাপনা নির্মাণ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল। হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১৫ সালে আর এস অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীর দুইপাড়ে ২১৮১টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করেছিল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।

২০১৬ সালের ১৬ অগাস্ট হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ কর্ণফুলীর দুই তীরে গড়ে ওঠা স্থাপনা সরাতে ৯০ দিনের সময় বেঁধে দিয়েছিল। তবে উচ্ছেদ শুরু হয় প্রায় আড়াই বছর পর, যা আবারও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।

সারাবাংলা/আরডি/এনএইচ

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন