বিজ্ঞাপন

শেষ হয়েও হইলোনা শেষ

March 1, 2019 | 3:37 am

।। হাসনাত শাহীন ।।

বিজ্ঞাপন

বাঙালির প্রাণের মেলা ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’য় বিদায়ের ঘণ্টা বাজানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো বাংলা একাডেমি। বইপত্র, মালামালসহ প্রায় সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার চিন্তা-ভাবনাও করে রেখেছিলেন প্রকাশকরা। লেখক, প্রকাশক এবং সর্বোপরি বইপ্রেমী-পাঠকদের মাঝে নেমে এসেছিলো বিষাদের সুর। গ্রন্থমেলার মূল-মঞ্চে চলছিলো মেলাকে বিদায় জানানোর সকল আয়োজন, সেই আয়োজন শেষও হলো। কিন্তু এরই মাঝে সেই মঞ্চ থেকেই ঘোষণা আসলো ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এবারের গ্রন্থমেলার আরও দুইদিন সময় বাড়ানো হচ্ছে।’

বৃহস্পতিবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র নীতিমালা অনুসারে এবারের গ্রন্থমেলার আক্ষরিক অর্থের শেষদিনে লেখক, প্রকাশক ও পাঠকদের দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এই ঘোষণা দিলেন সমাপনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। এসময় উপস্থিত ছিলেন গ্রন্থমেলার আয়োজক বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, গ্রন্থমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ড. মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, সমাপনী অনুষ্ঠানের শুভেচ্ছা বক্তা ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী, ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৯’-এর সদস্য-সচিব ও এবারের গ্রন্থমেলার সমাপনী প্রতিবেদন উপস্থাপক ড. জালাল আহমেদ প্রমুখ।

ঘোষণাকালে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, আপনাদের সকলের জন্য সুসংবাদ। মেলার সময় বৃদ্ধির জন্য আপনাদের দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গ্রন্থমেলার সময় দুইদিন বাড়ানো হলো। অর্থাৎ ২ মার্চ শনিবার পর্যন্ত চলবে এবারের গ্রন্থমেলা।

বিজ্ঞাপন

সময় বাড়ানোর ঘোষণার পরপরই মেলার দুই প্রাঙ্গণেই নেমে আসে প্রাণের ছোঁয়া। যে ছোঁয়া জোয়ার বয়ে গেল শেষ দিন মনে করে বৃহস্পতিবার মেলার দুই প্রাঙ্গণে উপস্থিত হাজার হাজার প্রকৃত বই-প্রেমী, লেখক আর প্রকাশকদের মাঝে। উচ্ছ্বাস প্রকাশের মাঝেও তারা ভুললেন না প্রাণের-মেলা বইমেলা’র দুইদিন সময় বাড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাতেও।

মেলার এই সময় বৃদ্ধি নিয়ে মেলায় অংশ নেওয়া জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ সারাবাংলা’কে বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এবারের মেলার দুইদিন নষ্ট হয়েছে। পাঠকরা তাদের কাঙ্ক্ষিত বই কিনতে পারেনি, প্রকাশকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাপকভাবে। এসব কিছু বিবেচনা করে লেখক-প্রকাশকরা দাবি জানিয়েছিল এবারের মেলা দুইদিন বাড়ানোর। মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী হয়ে আমরা সেই দাবি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছে দেই। অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এবারের মেলার দুইদিন সময় বাড়ায় মেলার আয়োজক কর্তৃপক্ষ। আমরা (প্রকাশকরা) প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ।

তিনি বলেন, মেলা দুইদিন সময় বাড়ানোর ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের দিনগুলোতে যেসব পাঠক বই কিনতে পারেনি, ফিরে গেছে, তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত বই কিনতে পারবে। প্রকাশকরাও তাদের যে ক্ষতি হয়েছিলো তা অনেকটা পুষিয়ে নিতে পারবে।

বিজ্ঞাপন

মেলার সময়-বৃদ্ধির এই দিনে মেলার আয়োজক কর্তৃপক্ষ জানায়, আগামীকাল শুক্রবার ছুটির দিনে মেলার প্রবেশদ্বার খোলা হবে সকাল ১১টায়। আর মেলা চলবে যথারীতি রাত নয়টা পর্যন্ত। এর মধ্যে সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত থাকবে শিশু-প্রহর।

এদিকে, মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলার ২৮তম দিনের মেলা চলে বেলা আড়াইটা থেকে রাত রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত। এদিনের মেলায় নতুন বই এসেছে ১৫৩টি এবং এই পর্যন্ত (১-২৮) পর্যন্ত নতুন বই এসেছে ৪,৬৮৫টি।

এদিকে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হলো এবারের গ্রন্থমেলার আনুষ্ঠানিক সমাপনী অনুষ্ঠান। গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় অনুষ্ঠিত হয় এই সমাপনী অনুষ্ঠান। এর শুরুতেই শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৯’-এর সদস্য-সচিব ড. জালাল আহমেদ। প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বিশেষ অতিথির বক্তব্য প্রদান করেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ড. মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য প্রদান করেন নিরাপদ মিডিয়ার চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

শুভেচ্ছা বক্তব্যে হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, গ্রন্থমেলা উদ্বোধন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে সহায়তার জন্য দেশবাসীর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ২০১৯-এর গ্রন্থমেলা অতীতের যেকোনো বারের তুলায় ছিল বিস্তৃত, ব্যাপক ও বর্ণাঢ্য। প্রথমবারের মতো গ্রন্থমেলার আয়োজনে এবার যুক্ত ছিল- লেখক বলছি মঞ্চ, কবি-কণ্ঠে কবিতাপাঠ, বাচিক-শিল্পীদের পরিবেশনা এবং নান্দনিক সমাপনী আয়োজন। তবে মেলার শেষ মুহূর্তে আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রকাশকদের যে ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি করেছে সে জন্য আমরা সমবেদনা ও দুঃখ প্রকাশ করছি। এই দুর্যোগ আবারও প্রমাণ করেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজনের জন্য স্থায়ী মেলা মাঠ বরাদ্দের কোনো বিকল্প নেই যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধের সার্বিক ব্যবস্থা থাকবে।

বিজ্ঞাপন

প্রতিবেদন উপস্থাপন করে ড. জালাল আহমেদ বলেন, আজ ২৮শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলা একাডেমি আনুমানিক ২ কোটি ১৫ লাখ ৯১ হাজার টাকার বই বিক্রি করেছে। ২৮শে ফেব্রুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত স্টল মালিকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং আজকের সম্ভাব্য বিক্রি যুক্ত করলে বলা যায় যে, এবার বইমেলায় গতবারের বিক্রির তুলনায় ১০% বেশি বিক্রি হয়েছে (২০১৮’র গ্রন্থমেলায় বিক্রির পরিমাণ ছিল ৭০ কোটি ৫০)। মেলায় প্রকাশিত ৪,৬৮৫টি বইয়ের মধ্যে মানসম্পন্ন বইয়ের সংখ্যা ১১৫১টি।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে কে এম খালিদ বলেন, একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। এই মেলা সারাদেশের জ্ঞান জগতে যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে তা অবিস্মরণীয়। এটি শুধু বিকিকিনির মেলা নয় বরং একটি জাতীয় সাংস্কৃতিক উৎসবে রূপ নিয়েছে।

বিশেষ অতিথি আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, অমর একুশে গ্রন্থমেলা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এক বিশাল জ্ঞানোৎসব। এবারের মেলা দেশ-বিদেশের জ্ঞানপিপাসু মানুষের মনে যে সাড়া জাগিয়েছে তা প্রমাণ করে এদেশের মানুষ জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, একুশে গ্রন্থমেলায় মানুষের মাঝে বই নিয়ে যে আগ্রহ দেখা গেছে তাতে প্রমাণ হয় প্রযুক্তির ব্যাপক বিকাশেও মুদ্রিত বইয়ের গুরুত্ব কিছুমাত্র হ্রাস পায়নি।

কবি নির্মলেন্দু গুণকে কবি জসীমউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯ প্রদান :

অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যে কোনো শাখায় সার্বিক অবদানের জন্য কবি নির্মলেন্দু গুণ’কে ‘কবি জসীমউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯’ প্রদান করা হয়। পুরস্কারের অর্থমূল্য ২ লাখ টাকা।

গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার প্রদান :

২০১৮ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণ-মানসম্মত সর্বাধিক সংখ্যক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য কথাপ্রকাশ-কে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার-২০১৯ প্রদান করা হয়।

এছাড়া, ২০১৮ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে গুণমান ও শৈল্পিক বিচারে সেরা গ্রন্থ বিভাগে গোলাম মুরশিদের বিদ্রোহী রণক্লান্ত, নজরুল-জীবনী গ্রন্থের জন্য প্রথমা প্রকাশনকে, মইনুদ্দীন খালেদের মনোরথে শিল্পের পথে গ্রন্থের জন্য জার্নিম্যান বুক্সকে এবং মারুফুল ইসলামের মুঠোর ভেতর রোদ গ্রন্থের জন্য চন্দ্রাবতী একাডেমিকে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০১৯ প্রদান করা হয়।

২০১৮ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেডকে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার-২০১৯ এবং ২০১৯ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মধ্যমা (এক ইউনিট), বাতিঘর (বহু ইউনিট), পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.-(প্যাভেলিয়ন)-কে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০১৯ প্রদান করা হয়। পুরস্কারপ্রাপ্ত সকল প্রকাশককে ২৫,০০০.০০ টাকার চেক, সনদ ও ক্রেস্ট প্রদান করা হয়।

‘লেখক বলছি…’ মঞ্চের আয়োজন: মেলায় প্রথমবারের মতো সংযোজিত ‘লেখক বলছি…’ মঞ্চের অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন প্রকাশিত গ্রন্থ বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেন সলিমুল্লাহ খান, সাগুফতা শারমিন তানিয়া, সুমন রহমান, মিছিল খন্দকার ও নাহিদা আশরাফী।

গ্রন্থমেলার এ সমাপনী আয়োজন শেষ হবার পরেই গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে সংগীত পরিবেশন করেন-শিল্পী ফরিদা পারভীন, আকরামুল ইসলাম, মহিউজ্জামান চৌধুরী এবং ইয়াসমিন মুশতারী। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন- দেবেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় (তবলা), গাজী আবদুল হাকিম (বাঁশি), দৌলতুর রহমান, এস.এম. রেজা বাবু (বাংলা ঢোল) এবং শেখ জালালউদ্দিন দোতারা)।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে সমাপনী সাংস্কৃতিক আয়োজন :

মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৯-এর সমাপনী আয়োজনের অংশ হিসেবে আজ রাতে স্বাধীনতাস্তম্ভ সংলগ্ন মঞ্চে সাংস্কৃতিক আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে কবিতাপাঠ করবেন প্রখ্যাত কবি নির্মলেন্দু গুণ। সাংস্কৃতিক পর্বে রয়েছে শিল্পী লিলি ইসলামের পরিচালনায় ‘উত্তরায়ন’-এর পরিবেশনা। সবশেষে রয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৯-এর মূল প্রতিপাদ্য বিজয় : ১৯৫২ থেকে ১৯৭১, নবপর্যায়-কে ভিত্তি করে লেজার শো প্রদর্শন।

সারাবাংলা/এনএইচ

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন