বিজ্ঞাপন

আমি চিত্রাঙ্গদা, রাজেন্দ্রনন্দিনী, নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী

March 17, 2019 | 7:44 pm

।। আশীষ সেনগুপ্ত ।।

বিজ্ঞাপন

নৃত্যনাট্য মূলত গীতিনির্ভর নাট্যধর্মী নৃত্য। নানা কাহিনী অবলম্বনে এ নৃত্য নির্মিত হয়। নৃত্য-গীতসহ নাটকীয়তা আছে বলেই একে নৃত্যনাট্য হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আধুনিক সময়ের নৃত্যনাট্য বলতে যা বোঝায় তার স্রষ্টা একজনই— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তারই সৃষ্ট চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা, মায়ার খেলা, চণ্ডালিকা, শাপমোচন, ভানুসিংহের পদাবলী, তাসের দেশের মতো নৃত্যনাট্য এখনও বঙ্গসংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ।

সময়কাল ১৯৩৬। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করলেন ‘চিত্রাঙ্গদা’। মূল রচনাটি ছিল নাট্যকাব্য। কিন্তু পরে এই কাব্যনাট্য রূপ নেয় নৃত্যনাট্যে। আর উপাখ্যানের উৎস মহাভারত। যে গল্প রয়েছে মহাভারতের আদি পর্বের ‘অর্জুন বনবাস পর্বাধ্যায়’-এ। যদিও রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদায় সে কাহিনী অনেকটায় গৌণ। তিনি তার কাব্যনাট্যে প্রধান উপজীব্য করলেন নায়িকার হৃদয়দ্বন্দ্বকেই। ম্লান করে রাখলেন স্বয়ং অর্জুনকেও।

বিজ্ঞাপন

কবিগুরু লিখলেন ‘মণিপুররাজের ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে শিব বর দিয়েছিলেন যে, তার বংশে কেবল পুত্রই জন্মাবে। তৎসত্ত্বেও যখন রাজকুলে চিত্রাঙ্গদার জন্ম হলো, তখন রাজা তাকে পুত্ররূপেই পালন করলেন। রাজকন্যা অভ্যাস করলেন ধনুর্বিদ্যা; শিক্ষা করলেন যুদ্ধবিদ্যা, রাজদণ্ডনীতি। অর্জুন দ্বাদশবর্ষব্যাপী ব্রহ্মচর্যব্রত গ্রহণ করে ভ্রমণ করতে এসেছেন মণিপুরে। তখন এই নাটকের আখ্যান আরম্ভ।’

পুরুষবেশী চিত্রাঙ্গদা মৃগয়ায় গিয়ে সাক্ষাৎ পান ব্রহ্মচারী অর্জুনের। অর্জুনকে প্রেম নিবেদন করেন। কিন্তু কুশ্রী চিত্রাঙ্গদাকে প্রত্যাখ্যান করেন অর্জুন। তখন চিত্রাঙ্গদা মদনের তপস্যা করে রূপবতী হলেন এবং মিলিত হলেন অর্জুনের সঙ্গে। বছর ঘুরতে না ঘুরতে অর্জুনের রূপতৃষ্ণায় ক্লান্তি এলো। চিত্রাঙ্গদার পরিচয় পেয়ে তিনি তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করলেন। সুশ্রী চিত্রাঙ্গদাও তখন রূপের খোলস খসিয়ে ফেলে সত্যরূপে অর্জুনের কাছে ধরা দিলেন।

বিজ্ঞাপন

চিত্রাঙ্গদার মূল কাব্যনাট্যকে উপজীব্য করে বাংলাদেশের স্বনামধন্য সংগঠন সাধনা গবেষণা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’র নতুন প্রযোজনা ‘নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী’। বাইরের রূপ নয়, মানুষের আপন অন্তরের মাঝে লুকিয়ে থাকা যে ব্যক্তিত্ব আর সৌন্দর্যবোধ তার উপলব্ধি ও হৃদয়দ্বন্দ্বকে নিয়েই এই প্রযোজনা। এর কাব্যনাট্য ও নৃত্যভাবনা লুবনা মারিয়ামের। নৃত্য পরিচালনায় সুইটি দাশ চৌধুরী।

পুরো নৃত্যনাট্যে ঘটনার বুনন এবং চরিত্রগুলোর মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ নিয়ে কথা হয় সুইটি দাশ চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের ‘নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী’ মূলত চিত্রাঙ্গদা কাব্যনাট্য থেকে নেওয়া। চিত্রাঙ্গদা রবীন্দ্রনাথ প্রথমে কাব্যনাট্যে লিখেছিলেন, পরে একে সহজ করে নৃত্যনাট্যে রূপান্তরিত করেন। আমরা কাব্যনাট্যটাকেই নিয়েছি। কাব্যনাট্যে বেশিরভাগই চিত্রাঙ্গদা ও মদনের মধ্যে কথোপকথন। এখানে অর্জুনের চরিত্রটা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে চিত্রাঙ্গদা ও মদনকে। আমরা যেটা করেছি সেটা হলো— কাব্যনাট্যে চিত্রাঙ্গদা ও মদনের যে কাব্যিক উক্তিগুলো রয়েছে, সেগুলো থেকে কিছুটা নিয়েছি এবং তার সঙ্গে নৃত্যনাট্যের কিছু অংশ নিয়ে প্রযোজনাটা দাঁড় করিয়েছি।

এই প্রযোজনায় চিত্রাঙ্গদা অর্জুনের প্রেমে পাগল হয়ে নিজেকে কুরূপা থেকে সুরূপাতে, অর্থাৎ নিজেকে সুন্দর নারীতে রূপান্তরিত করে, যেন অর্জুন তাকে দেখে ব্রহ্মচর্য ত্যাগ করে তার প্রেমে মত্ত হয়ে যায়। কিন্তু একটা সময় চিত্রাঙ্গদা উপলব্ধি করে, বাইরের যে রূপ-সৌন্দর্যের সন্ধান সে করেছিল, সেটা প্রকৃতপক্ষে কিছুই না। ভেতরের সৌন্দর্য বা নিজের যে বোধ বা যে চরিত্র, সেটাই হচ্ছে মূল।

বিজ্ঞাপন

সুইটি দাশ চৌধুরী বলেন, একজন নারীর নিজের যে অহং বোধ, আমরা এই বিষয়টাকেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমরা নারীরা অনেক সময়ই বাহ্যিক যে রূপ, সেটিতেই মগ্ন হয়ে পড়ি। কিন্তু একজন নারী যে এক হাতে সবকিছু সামলাতে পারি, সেই ক্ষমতাটাকেই উপলব্ধি করানোর চেষ্টা করেছি। আমরা সামান্য নারী নই, আমরা চাইলে সবই করতে পারি। এই বিষয়গুলোই ‘নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী’তে দেখানোর চেষ্টা করেছি।

চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যকে প্রাধান্য না দিয়ে কাব্যনাট্যকেই কেন বেছে নিলেন— জানতে চাইলে সুইটি বলেন, এটার মূল স্ক্রিপ্টটা আমাকে দিয়েছিলেন লুবনা মারিয়াম। সেটা ছিল অনেক পুরনো। লুবনা আপা যখন শান্তিনিকেতনে পড়তেন, তখন স্ক্রিপ্টটা পেয়েছিলেন তিনি। এটা দিয়েই অনেকগুলো শো-ও করেছিলেন।স্ক্রিপ্টটা পড়ে আমার মনে হলো, ওই স্ক্রিপ্টের পর সময়ের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সমসাময়িক দিক মাথায় রেখে এমন একটি দীর্ঘ নৃত্যনাট্য বা কাব্যনাট্যকে কিভাবে মঞ্চায়ন করা যায়, সেই ভাবনা থেকেই স্ক্রিপ্টটাতে আমি কিছুটা পরিমার্জন করেছি।

সুইটি জানান, তখনকার সময়ে স্ক্রিপ্টটাকে উনারা সবাই বসে পাঠ করতেন, কেবল নাচের অংশগুলোতে নাচ করতেন। এমনকি অর্জুন বা মদনের অংশগুলোও পাঠ করেই উপস্থাপন করতেন। আমার কাছে মনে হলো, যদি থিয়েটারের মতো করে, বিশেষ করে নাচ ও থিয়েটার— দু’টোকেই একসঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারি। একটু নতুনভাবে যদি কিছু দেখানো যায়— সেই ভাবনা থেকেই এই পরিমার্জন।

সুইটি আরও বলেন, মঞ্চায়নে আমি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছি সূত্রধারীকে। নারীকে সবসময় তিনি বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে পুরুষের জন্য কেন তুমি নিজেকে পরিবর্তন করছ। তুমি তো চিত্রাঙ্গদা। তুমি সামান্যা নারী নও। তুমি তোমার সৌন্দর্য কেন একজন পুরুষের পায়ে নিবেদন করবে। প্রয়োজন নেই শুধুমাত্র একজন পুরুষের জন্য নিজেকে পরিবর্তন করা। এই বিষয়টাকেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

চিত্রাঙ্গদার এই মঞ্চায়নে থিয়েটার ও নাচ— দু’টোকেই এক করে পরিবেশন করা হয়েছে। ফলে এই মঞ্চায়নে গান ও সংগীত সরাসরি পরিবেশন করা হয়েছে। পাশাপাশি অভিনয়কেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এই নৃত্যনাট্যে।

‘নহি দেবী নহি সামান্যা নারী’তে নৃত্য পরিচালনার পাশাপাশি চিত্রাঙ্গদার কুরূপা ও সুরূপা— দু’টো চরিত্রেই অভিনয় করছেন সুইটি দাশ চৌধুরী। সঙ্গে সুত্রধারী হিসেবে আছেন নাজনীন চুমকি, অর্জুনের চরিত্রে অমিত চৌধুরী ও মদন চরিত্রে অর্থী আহমেদ। এছাড়াও রয়েছে সাধনা কল্পতরুর শিক্ষার্থীরা। সংগীত পরিচালনায় নির্ঝর চৌধুরী ও সিমু দে। যন্ত্রসংগীতে থাকছে সিলেটের কমলগঞ্জ থেকে আসা ব্রজেন কুমার সিংহ ও তার দলের সদস্যরা, যারা সরাসরি মনিপুরী বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নৃত্য পরিবেশনও করবে।

‘নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী’ মঞ্চস্থ হচ্ছে আগামী ১৯ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টায়, ছায়ানট মিলনায়তনে ৫০০ ও ২০০ টাকা দর্শনীর বিনিময়ে।

রবীন্দ্রনাথ একের পর এক সৃষ্টিতে নারী তথা বৃহৎ বিশ্বমানবেরই জয়গান গেয়ে গেছেন। ‘শ্যামা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’ ও ‘চণ্ডালিকা’ শীর্ষক তিনটি নৃত্যনাট্যে তিনি সাধন করেছেন নারীমুক্তির নতুন বিপ্লব। নাটক ও অন্যান্য রচনায় প্রতিষ্ঠা করেছেন নারীর মূল্য। সন্ধান করেছেন প্রেম ও কর্মশক্তির সমন্বয়ে নারীর ভেতর এক কল্যাণী রূপের। আর রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যে আমরা খুঁজে পাই প্রকৃতির সমান্তরালে নারী মুক্তির নব আবাহন। তাই তো চিত্রাঙ্গদায় তিনি গেয়েছেন—

আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী।
নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী।
পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে, সে নহি নহি,
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে, সে নহি নহি।
যদি পার্শ্বে রাখ মোরে, সঙ্কটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে সহায় হতে,
পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।
আজ শুধু করি নিবেদন—
আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী।।

 

সারাবাংলা/এএসজি/পিএ


আরও দেখুন :  ‘নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী’ [ফটো স্টোরি]


বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন