বিজ্ঞাপন

রম্যগল্প ‘বিজ্ঞাপিন’

December 4, 2017 | 8:27 am

অরুণ কুমার বিশ্বাস

বিজ্ঞাপন

শুরুতেই বলে নিই, আমরা সব বিপণনগুরু ফিলিপ কট্লার-এর যোগ্য শিষ্য। তাঁর সোজা কথা, ভাল কিছু করেছ কি, মেলে ধরো। ফুলে সুবাস থাকলে তার সৌরভ নিতে মানুষ ছুটে আসবেই। কটলারের সেই সূত্র মেনে আমরা সবাই এখন বড্ড বেশি ঢোল বাজাতে ব্যস্ত। কাজ কিছু করি বা না-করি, জানান দিতে কারো এতটুকু কার্পণ্য নেই। যেন বগল বাজানোতেই সর্বসুখ লুকিয়ে আছে।

আমার বন্ধু যোগেশ ইদানীং যোগ সাধনায় যোগ দিয়েছে। না না, কোয়ান্টাম-টোয়ান্টটাম নয়। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতেও চাই না, তাতে অনেকে আবার গোস্সা করবেন। চাই কি স্বহস্তে রোপিত একখানা চোখা বাঁশ আমার জায়গামতো ঠুসে দিতে পারেন। নইলে মানিসুট মামলা! সে লাখ টাকার ধাক্কা। যোগেশ যোগসাধনা করে শরীরের উন্নতি ঘটাতে চায়। সেই হাড়কেপ্পনের ঘি-খাওয়ার গপ্পের মতো, দুদিন যেতে না যেতেই যোগেশের বাইসেপ্স-ট্রাইসেপ্স সব ফুলে-ফেঁপে একাকার। তাই নিয়ে ফেসবুকে জম্পেশ একখানা ‘বিজ্ঞাপিন’ ছাড়লো আমাদের যোগেশ। বলে কিনা, সিনা ফোলাতে যোগব্যায়ামের বিকল্প নেই। মেয়েপক্ষ একবার দেখলে পাত্র হিসেবে তোমাকে ফেলে দিতে পারবে না। বিয়ের পাত্র হিসেবে তুমি একশতে একশ। জাস্ট লুফে নেবে। আর যদি বিয়োগব্যায়ামে ধরে, তবেই সেরেছে। দুদিনেই তুমি টিঙটিঙে পাটকাঠি!

তো সেই যোগেশভায়ার কঞ্চির মতো রোগা লিকলিকে চেহারা দেখে হাসবো কি কাঁদবো বুঝে উঠতে পারি না। তার এই শুকনো অপটু শরীরের যদি এই বিজ্ঞাপন হয়, তাহলে আর কানাছেলের নাম পদ্মলোচন বা মিসকিনের পোলার বাদশা নাম রাখলে তাকে মিছে দোষ দেয়া যায় না। পয়েন্ট ইজ দ্যাট, বিজ্ঞাপনের যুগে আমরা আচ্ছাসে ঢাকঢোল পিটিয়ে টেংরাকে আড়মাছ, জলঢোঁড়াকে গোখরো আর রঙচঙের জোরে নানিকে নাতনি বানিয়ে ছেড়ে দিচ্ছি। যা ব্যাটা, এবার ইচ্ছেমতো করে খা!
দোষ আসলে কারো না, যুগের। তুমি কিছু করলে অথচ তার যথোপযুক্ত নামগান হলো না, তাহলে মানুষ তোমাকে গোনায়ই ধরবে না। ‘আমি কী হনুরে’ টাইপ পাবলিকে ভরপুর এই জামানায় গলাবাজকে প-িত আর গুরুগম্ভীর প্রকৃত জ্ঞানীকে নির্বোধ ভাবা হয়। তুমি কিছু বলছো না মানে ধরে নেয় যে, তুমি আদতেই কিছু জানো না। বস্তুত, তোমার জ্ঞাপন করার কিছু নেই, তাই নিজেকে নিজে বিজ্ঞাপিত করছো না। উর্ণনাভ অর্থাৎ মাকড়সার জালে আটকে রাখছো। সৌজন্য ও ক্ষমাশীলতাকে দুর্বলতা আর চাপাবাজিকে স্মার্টনেস ধরে নিয়ে মুখ্যসুখ্যরা দিব্যি এখন করে খাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

সেদিন অফিসে বসে আছি, কিছুটা ক্লান্ত আর অবসন্ন। অগণন তেলবাজ আর টুপভূজঙ্গের ভিড়ে নিজেকে বড্ড ক্লিশে মানে ছিবড়ে মনে হচ্ছে। কী ছাই জীবন- এলি, খেলি আর গেলি! তাও আবার শুধু নিজেরটা না, পরেরটাও চুষে-চিবিয়ে খেয়ে তবে শান্তি। এমন স্বার্থপর জীবন চাই না টাইপ দার্শনিক ভাব নিয়ে বসে আছি। সহসা আমার সহকারী জানালো যে কমিশনার সাহেব এসেছেন। আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। বা ভদ্রভাষায় শশব্যস্ত (শশক বা খরগোশের মতো চঞ্চল) হয়ে প্রায় স্যালুট ঠুকতে যাচ্ছিলাম আর কি! ধরেই নিয়েছি যে পুলিশ কমিশনার বা আরো সম্ভ্রান্ত কেউ দয়া করে আমার দুয়ারে পদধুলি দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে যথাযথ আদবকেতা মেনে স্যালুট ঠোকা আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।

কিন্তু খানিকবাদে যিনি আমার কক্ষে আবির্ভূত হলেন তাকে দেখে, সত্যি বলতে, আমি কিঞ্চিত নিরাশই হলাম। তিনি উপর্যুক্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের কেউ নন, তিনি একজন ওয়ার্ড কমিশনার। দোষ আসলে যিনি এলেন তার নয়, দোষ তার চামচের। এমনভাবে সে আমার সহকারীকে তাদের আগমনধ্বনি জ্ঞাপন করেছেন যে আমি তড়াক করে লাফিয়ে না উঠে পারিনি। ফলে আমার দার্শনিক ভাব গেল ঘুচে। আমি বুঝলুম, কী ছাই ফিলসফি! সব ফিলসফির মূলে আছে বিজ্ঞাপিন অর্থাৎ মার্কেটিং বা পাবলিসিটি। যে এই কাজটি সবিশেষ যোগ্যতা ও সফলতার সাথে করতে পারে তাকে আটকায় সাধ্যি কার!

ইদানীং ফেসবুকের কল্যাণে বিজ্ঞাপনের কলাকৌশল সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানলাভের সুযোগ ঘটেছে। একদল আছে যারা কিনা নামের আগে ও পাছে নানারকম চটকদার টাইটেল-ফাইটেল লাগিয়ে নিজেকে রীতিমতো কেষ্টবিষ্টুর পর্যায়ে উন্নীত করে ফেলছে। সেই তরফে বন্ধুত্বের আবাহন পেলে পেটের ভিতর কেমন যেন গুড়গুড় করে ওঠে। তাতে কোষ্ঠকাঠিন্যের চেয়েও কষ্ট বেশি। মনে হয় এই বুঝি প্রকৃতির ডাক পেলুম, মিটিং-সিটিং সব ফেলে এক্ষুনি ছুটতে হবে। কেননা বউ আর প্রকৃতির ডাকের আছে বাকি সব অর্থহীন- নিছক মামুলি ব্যাপার।

বিজ্ঞাপন

বলা বাহুল্য, সাম্প্রতিককালে বিজ্ঞাপনের যত রকম তরিকা বা মার্গ বেরিয়েছে, তার মধ্যে ফেসবুক সবচে সস্তা ও ফলপ্রসূ উপায় বলে সর্বজনস্বীকৃত। কেউ কেউ আবার একে বর্জ্যাধার বা ডাস্টবিন বলেও বিষোদ্গার করে থাকেন। বোঝা যায়, এই শ্রেণির ব্যক্তিগণ অতিশয় প্রাচীনপন্থী ও শুচিবায়ুগ্রস্থ। অল্পতেই তাদের পিত্ত পড়ে, কারো ভালো তারা দেখতে পান না, বরং বিরক্ত হন। তবে কিছু কিছু ফেবু কিন্তু একে সোশ্যাল মিডিয়ার বদলে বিজ্ঞাপন পেজ হিসেবে ব্যবহার করছেন। সামান্য ব্যাপারে তাদের মাত্রাধিক উল্লম্ফন আর আদিখ্যেতা দেখে সত্যি বিবমিষার উদ্রেক হয়। তাদের বোঝা উচিত, একটি শুভ উদ্দেশ্য নিয়ে বেচারা মার্ক জুকারবার্গ অ্যাপটি বানিয়েছেন, এটা কারো টয়লেট বা ড্রয়িং-রুম নয় যে, যার যার মর্জিমতো যা নয় তাই আপলোড করে অকারণ পাবলিক-নুইসেন্স তৈরি করবেন।

এবার বিজ্ঞাপিন নিয়ে কিঞ্চিত বাতচিৎ করা যাক। নিজের ঢোল নিজে বাজাবেন, তাতে দোষের কিছু নেই। অন্যের হাতে দিলেই বরং অতি প্রিয় ঢোলখানা ফাটিয়ে ফেলার আশঙ্কা তৈরি হয়। কিন্তু সেই বিজ্ঞাপন যখন প্রচুর জনরোষের কারণ হয় তখন কিন্তু ‘সাধু সাবধান’ না বলে উপায় থাকে না। বানাতে চাইলেন মধু, হয়ে গেল বিষ! তখন আর বুকের সিনা ফুলিয়ে বলা যায় না, মধুরেণ সমাপয়েৎ। বিশেষ করে স্বীয় জিহ্বাখানা আর ফেসবুক অ্যাকাউন্টখানা সামলে সুমলে রাখার সময় বোধ হয় এসে গেছে। অনেকেই নিজেকে বা নিজের অর্জনকে জনারণ্যে ছড়িয়ে দেবার জন্য অহেতুক গলাবাজি পিকচারবাজি করছেন যা মোটেও কাম্য নয়। ওয়াশরুমে কে কত দামি টাইলস ব্যবহার করেছেন বা কার সুন্দরী শ্যালিকার হিলের মাপ কত, তাও যদি ফেসবুকের ওয়ালে সেঁটে দেন তাহলে বন্ধু হিসেবে বড্ড বিড়ম্বনায় পড়তে হয় বৈ কি।

এমনও দেখা যায়, দশ হাতে থুক্কু দশ আঙুলে এগারখানা আংটি পরিধান করে তার ছাপচিত্র তুলে তা দৃশ্যমান করেছেন ফেসবুক পাতায়। পশ্চাতে উদ্দেশ্য, তিনি কতো ধনবান তা প্রদর্শন করা। এহেন বালখিল্যতা দায়িত্বশীল আচরণের মাঝে পড়ে না, একে বিজ্ঞাপন না বলে বিজ্ঞাপিন বলা শ্রেয়। কেননা এর পেছনে যে স্থূল খোঁচা লুকিয়ে থাকে তা দিয়ে শুধু ঢোল নয় আরো বড় কোনোকিছুও ফাটিয়ে দেয়া যায়। যেমন প্রেস্টিজের টায়ার-টিউব সব পাঙ্কচার। তাই বলি কি, ফুলের কুঁড়ি ফুটে বেরুবার আগেই ঝরিয়ে না ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ। আপনার বাগানে সুগন্ধী ফুল ফুটলে মৌমাছি এমনি আসবে, তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বা নেমন্তন্নপত্র পাঠিয়ে বাগানে টেনে আনতে হবে না। তাই অযথা বাগাড়ম্বর নয়, যার যার অবস্থানে থেকে আসুন আমরা আচরণে ও আবরণে সৌজন্য বজায় রাখি। দায়িত্বশীল হই।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও কলামলেখক

বিজ্ঞাপন

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন