বিজ্ঞাপন

সড়কের ময়লা বনাম মনের ময়লা

March 22, 2019 | 9:19 am

রেজানুর রহমান

চারটি ছেঁড়া কাগজ সদৃশ্য বস্তু পরিষ্কার রাস্তার ওপর পড়ে আছে। ওটাকেই রাস্তার ময়লা আবর্জনা ভেবে ১১টি ঝাড়ু গর্জে ওঠে। ঝাড়ু হাতে গর্জে ওঠা মানুষগুলোর পরনে ভদ্র পোশাক। কোট-টাই পরা ভদ্রজন। কয়েকজন মুখ-নাক বন্ধ করা মাস্ক পরে আছেন। কারও কারও মাথা-মুখ বিশেষ বস্তু দিয়ে ঢাকা। বিপুল বিক্রমে রাস্তা পরিষ্কার করার কাজে নেমেছেন সবাই। ছবি দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সামনে থেকে কেউ হয়তো এই বিশেষ কর্মযজ্ঞের ছবি তুলছে। সে হয়তো সবার উদ্দেশে বলছে, “একটা ‘পোজ’ দ্যান প্লিজ।” রাস্তায় ঝাড়ু দিচ্ছেন; ফাইভ, ফোর, থ্রি, টু অ্যাকশন— তারপর ক্লিক… ক্লিক… নিমেষেই ছবিটি ঢুকে গেল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আহা! কী সুন্দর ছবি! চারটি ছেঁড়া কাগজ সদৃশ্য বস্তুকে রাস্তার ময়লা আবর্জনা ভেবে তা পরিষ্কার করার জন্য নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানীত কয়েকজন শিক্ষক ও বিশিষ্ট কর্মকর্তারা যেভাবে ভূমিকা রাখলেন, তা ইতিহাসে অমর ও অক্ষয় হয়ে থাকবে। ফেসবুকে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম এই ছবিটি দেখে আহমেদ হোসেন নামে একজন লিখেছেন ‘সীমাহীন ফাজলামো.. দিগম্বর করিয়া তাহাদেরকে বেত্রাঘাত অতীব জরুরি।’ সাইফুন নাহার লিখেছেন, ‘ছবিটি অনেকক্ষণ দেখলাম। অবশেষে মনে হলো— ঝাড়ুগুলি দিয়া নিজের কপালে মারি।’

বিজ্ঞাপন

এতক্ষণ একটি স্থিরচিত্রের কথা বলছিলাম। এবার একটি ভিডিও চিত্রের কথা বলি। ফেসবুকে হঠাৎ দেখি, ঢাকা সিটি করপোরেশনের একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ময়লা ফেলার ভ্যানে রাখা কিছু কাগজ ছিঁড়ে ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছেন। সে কাজটি আবার তিনি যথাযথভাবে করছে কি না, তা তদারকি করছেন সিটি করপোরেশনেরই দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক কর্মী।

ঘটনা কী? পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ তো রাস্তার ময়লা পরিষ্কার করা। অথচ তিনি প্রকাশ্য দিবালোকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে রাস্তায় ময়লা ফেলছেন কেন? পরে জানা গেল, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র আতিকুল ইসলাম নগর পরিষ্কার করার কাজ উদ্বোধন করবেন। সেজন্যই এই অভিনব ব্যবস্থা। ঘটনার পেছনের ঘটনা আরও কৌতুকপ্রদ। মাননীয় মেয়র এলাকায় আসবেন বলেই পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে নির্ধারিত এলাকাটি ঝাড়ু দিয়ে ঝকঝকে তকতকে করে ফেলেছিলেন। পরে তারা যখন বুঝতে পারেন মেয়র ময়লা পরিষ্কার করতে আসবেন, তখনই তারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। এখন ময়লা পাবে কোথায়?

এক পর্যায়ে করপোরেশনেরই এক কর্মকর্তার মাথায় আসে এই অভিনব আইডিয়া। আগে রাস্তায় ময়লা ফেলা হবে, তারপর সেই ময়লা অপসারণ করবেন মাননীয় মেয়র। বলা বাহুল্য, মেয়র মহোদয় রাস্তায় ফেলে রাখা কাগজের সেই ময়লাই অপসারণ করছেন— এই ছবিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ফলে মেয়রকে নিয়েও ব্যাঙ্গাত্মক কথাবার্তা বলছেন অনেকে। এখন প্রশ্ন হলো— বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান এই যে রাস্তায় ময়লা পরিষ্কারের অভিনব কর্মসূচি পালন করে, সামাজিক ক্ষেত্রে এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়ে কি?

বিজ্ঞাপন

আমার ধারণা, এ ধরনের কর্মকাণ্ড সামাজিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাবের চেয়ে নেতিবাচক প্রভাবই বেশি ফেলে। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ধরনের কর্মকাণ্ডে আন্তরিক অংশগ্রহণ থাকে না। একটা কিছু না করলে তো মান সম্মান থাকে না। অন্যেরা পথে ঝাড়ু দেওয়ার কর্মসূচি পালন করেছে। কাজেই আমরা বোধকরি পিছিয়ে পড়লাম। আর তাই একজনের দেখাদেখি অন্যজনও তৎপর হয় পথের ময়লা সাফ করার জন্য। কিন্তু তার আগে তো মনের ময়লা সাফ করা দরকার!

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই দেখলাম, নাটক-সিনেমার কয়েকজন জনপ্রিয় তারকাও রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার জন্য ক্যামেরায় ‘পোজ’ দিয়ে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের ছবি দেখে বোঝা যাচ্ছে, রাস্তায় ঝাড়ু দেওয়ার ব্যাপারটা বেশ কৌতুকপ্রদ বিষয়। সে কারণে কৌতুক করার ভঙ্গিতেই ঝাড়ু হাতে তারা ক্যামেরার সামনে ‘পোজ’ দিয়েছেন। তাদের ছবি দেখে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘এই ধরনের ফাইজলামির কোনো মানে হয় না।’

বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থা নিয়ে সত্যি সত্যি একধরনের ‘ফাইজলামি’ কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার দাবিতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা গত বছর যে যুগান্তকারী আন্দোলন শুরু করেছিল, তা দেখে অনেকেই আশায় বুক বেঁধেছিলেন এই ভেবে যে এবার নিশ্চয়ই কিছু একটা হবে। সড়কপথে একটা শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্তরিক এই আন্দোলনও বোধকরি ব্যর্থ হয়েছে। সড়কপথে শৃঙ্খলা তো ফেরেইনি, বরং গাড়িচালকসহ পরিবহন খাতে জড়িত ব্যক্তিরা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। সে কারণে আবারও সড়ক পথে বলি হয়েছেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী। সুপ্রভাত নামের একটি বাস তাকে প্রকাশ্যে রাস্তায় চাপা দিয়ে চলে যায়। ঘটনাস্থলেই আবরারের মৃত্যু হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আবরার নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। অথচ তাকেই কি না সড়কপথে বেপরোয়া বাস চাপা দিয়ে মেরে ফেলল!

বিজ্ঞাপন

আবরারের অকালমৃত্যুর ঘটনায় প্রতিবাদ ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আবার পথে নেমেছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আবরারের মৃত্যুর ঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার পাশাপাশি পরিবহন খাতের দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হওয়া সময়ের দাবি। কার্যত, এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। এমনই অস্থির সময়ে ঢাকা উত্তরের মেয়র ঘোষণা দিয়েছেন, যে সড়কে আবরার আহমেদ চৌধুরীকে ঘাতক বাস চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছে সেখানেই একটি ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করা হবে। এরই মধ্যে সেই ফুটওভারব্রিজের ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেছেন তিনি। ত্বরিত গতিতে শুরু হয়েছে এর নির্মাণ কাজও।

মেয়রের এই উদ্যোগকে কেন্দ্র করেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকেই মেয়রের ফুটওভারব্রিজ নিয়ে গৃহীত উদ্যোগকে হাস্য-কৌতুকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তারা বলছেন, ফুটওভারব্রিজ কখনোই সমস্যা সমাধানের মূল প্রক্রিয়া নয়। প্রতিদিন সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় অসংখ্য প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। সবক্ষেত্রেই কি ফুটওভারব্রিজ বানানো হবে? তাহলে তো একদিন সারাদেশ ওভারব্রিজে ভরে যাবে।

এদিকে, জানা গেছে রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে আবরারকে চাপা দেয়া সুপ্রভাত বাসের চালক সিরাজুল ইসলাম নাকি নিয়মিত গাজা সেবন করে। গাজা না খেলে সে নাকি গাড়ি চালাতে পারে না। মূলত গাজা খেয়ে সারারাত না ঘুমিয়ে গাড়ি চালানোর কারণেই সে এই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে পুলিশকে সে বলেছে, ‘শাহজাদপুর বাঁশতলায় একটি গাড়ি ক্রসিং করতে গিয়ে এক মেয়েকে ধাক্কা দেই। মেয়েটি গুরুতর জখম হয়। তখন মনের মধ্যে ভয় কাজ করতে থাকে। মাথা ঠিক ছিল না। কিভাবে বাঁচতে পারি, তার জন্য আরও দ্রুত গাড়ি চালাতে থাকি। আইকন টাওয়ারের সামনে জেব্রা ক্রসিংয়ে ভার্সিটির এক স্টুডেন্টের (আবরার) ওপর গাড়ি চালায়ে দেই। গাড়ির চাকা তার মাথার ওপর দিয়ে যাওয়ায় মাথা থেঁতলে যায়।’

প্রিয় পাঠক, ভেবে দেখুন কী বিভৎস ও নিষ্ঠুর বর্ণনা। এভাবে রাস্তায় পাখির মতো মানুষ মরবে আর আমরা একটি করে ফুটওভারব্রিজ বানাব? এভাবেই কি সড়কের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব?

বিজ্ঞাপন

রাস্তায় ময়লা ফেলে অথবা টিস্যু পেপার ফেলে রাস্তা পরিষ্কার করার মানসিকতা দূর করতে হবে। আগে প্রয়োজন মনের ময়লা দূর করা। ফুটওভারব্রিজের চেয়ে এই মুহূর্তে প্রয়োজন নীতি-নৈতিকতার ওভারব্রিজ। সড়ক পথের নৈরাজ্য নিয়ে এই যে এত আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, সংশ্লিষ্টরা কি কানে তুলো দিয়ে থাকেন? সড়ক পথে এত অনিয়ম-অনাচারেও তাদের বোধোদয় হচ্ছে না কেন?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই একটি ছবিতে দেখলাম, ঘাতক সুপ্রভাত বাসের নাম নাকি পরিবর্তন করে ‘সম্রাট’ রাখা হয়েছে। তার মানে কি সুপ্রভাত এখন ‘সম্রাট’ নামে সড়কে দাপট দেখাবে? সুপ্রভাত নামটি বেশ কোমল ছিল। অথচ এই বাসটিই অসহায় যাত্রীর মাথা থেঁতলে দিয়ে মেরে ফেলেছে। ‘সম্রাট’ নামের মধ্যে তো একটা বাহাদুরি ভাব আছে। সে কি আদৌ সড়কের কোনো আইন মানবে?

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো

সারাবাংলা/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন