বিজ্ঞাপন

আলোর মিছিলের ২৭ বছর

March 25, 2019 | 6:47 pm

ফজলুর রহমান

১৯৯৩ সালের ২৫শে মার্চের রাত। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে আলোক শিখা জ্বালিয়ে কয়েকজন মানুষ এগিয়ে গেলেন ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের বধ্যভূমির দিকে। সেখানে, পরম শ্রদ্ধায় সেই প্রজ্জ্বলিত আলোর শিখা রেখে স্মরণ করা হলো ১৯৭১ সালের শহীদদের। সেই আলোর মিছিলের নেতৃত্ব দিলেন গেরিলা যোদ্ধা শহীদ রুমীর মা জাহানারা ইমাম। তার সঙ্গে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সন্তান আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নতুন প্রজন্মের সন্তানরা। সেই থেকে প্রতিবছর শহীদ মিনার থেকে আলোর মিছিল বের হয়।

বিজ্ঞাপন

একটি মিছিল এগিয়ে যায়। মিছিলের সবার হাতে প্রজ্জ্বলিত মোমের শিখা। বসন্তের উথাল-পাথাল বাতাস সেই মোমশিখা নিভিয়ে দিতে চায়। এক হাতে মোমদণ্ড অন্য হাতের আঙুলগুলোকে ঢাল বানিয়ে সেই শিখাকে নিভতে না দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা; আর কণ্ঠে সেই অবিনাশি গান- ‘আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে/ এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে।’ আলোর এ মিছিল এগিয়ে চলে, এই শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের বধ্যভূমিতে।

মুক্তিযুদ্ধে ছেলেকে উৎসর্গ করা জননী জাহানারা ইমাম। স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তিনি রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন ১৯৯১ সালে। গঠন করেছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। আর ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের ‘কালরাত্রি’কে স্মরণ করতে ৯৩ সালে শুরু করেছিলেন ‘আলোর মিছিল’। জাহানারা ইমাম চলে গেছেন তার সময়ের প্রয়োজন মিটিয়ে। তার সেই আলোর মিছিল এখন বয়ে নিয়ে চলেছে নতুন প্রজন্ম।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নির্বাচারে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করে। সেই থেকে এই রাতটি ইতিহাসে ‘কালরাত্রি’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রথমবার খুব বেশি মানুষ জড়ো হননি, হতে পারেননি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। তখন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশে বৈরি রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজমান। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা সবখানে। বিএনপির নিকটমিত্র যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী। দলটির আমীর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ‘প্রধান যুদ্ধাপরাধী’ গোলাম আযমের মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়েছে ১৯৯২ সালের ২৬মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গঠিত গণআদালতে। সেই রায় কার্যকরের জন্য রাজপথে আন্দোলনে করছে নির্মূল কমিটি। আর সরকার তার মিত্রকে রক্ষায় মরিয়া। গণআদালতের রায় কার্যকর দূরে থাক; গণআদালতের উদ্যোক্তা জাহানারা ইমামসহ ২৪জন বিশিষ্ট নাগরিকের নামে দেশদ্রোহের মামলা দেয় খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার। সেই ‘দেশদ্রোহ’ অপবাদ নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে শহীদমাতা জাহানারা ইমামকে। তবে তিনি যে আলোর মিছিল শুরু করে গেছেন তা প্রতিবছর একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে এখন বিশালত্ব ধারণ করেছে।

বিজ্ঞাপন

৯৩ সালে জাহানারা ইমাম তার মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের নিয়ে, শত বৈরি পরিবেশে যে আলোর মিছিল শুরু করেছিলেন তা এখন এক চেতনার মিছিলে রূপ নিয়েছে। আজ, এই রাতে শহীদ মিনার এলাকায় গেলে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। শহীদ জননীর পথ ধরে কালরাত্রিকে স্মরণ করার আরো একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সরকারের তরফে। তাহলো একই সময়ে সারা দেশে এক মিনিটের জন্য আলো নিভিয়ে দেয়া। হতে পারে এটা কেবলি আনুষ্ঠানিকতা। সরকার বলছে, এটা কোনো বাধ্য-বাধকতার বিষয় নয়। তবে এ ঘোষণা আর উদ্যোগ-যা-ই বলা হোক না কেনো, এটা অন্য তাৎপর্য বহন করে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এই রাতে আমাদের ওপর যে বর্বর হামলা-হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তার প্রতি ধিক্কার জানাতে, ঘৃণা জানাতে দেরিতে হলেও এমন আয়োজন প্রয়োজন ছিল। এসব আয়োজনে বিশ্বকে জানিয়ে দিতে হবে পাকিস্তানী সেনাদের বর্বরতার কথা। বাংলাদেশের সৃষ্টির সময় পাকিস্তানের অপরাধের জন্য তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবিটি এভাবেই জোরালো হতে থাকবে। আর নয় মাসব্যাপি বাঙালিদের ওপর যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখনো আসেনি। বাংলাদেশের ‘গণহত্যা’র বিষয়টি এখনো উপেক্ষিত বিশ্বমহলে।

প্রতিবছর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ২৫শে মার্চের কালরাত্রি- স্মরণ করতে মিলিত হয় শহীদ মিনারে। সেখানে আলোচনা হয়। আলোচনায় অংশ নেন মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সদস্যরা। তারপর শহীদ সন্তানদের হাতে দেয়া হয় আলোর এক একটি মশাল। সেই মশালের আলো থেকে জ্বলে উঠে শত শত- মোমের শিখা। সেই প্রজ্জ্বলিত শিখার আলো মিছিল ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় জগন্নাথ হলের মাঠের কাছে। সেখানে গড়া হয়েছে ‘৭১-এর শহীদরে স্মৃতির মিনার। সেই মিনারে স্থাপন করা হয় শত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ সন্তান আর এ প্রজন্মের সন্তানদের হাতের মোমশিখাটি।

আজ, ২০১৯ সালের ২৫শে মার্চের রাতে শহীদ মিনার থেকে আলোর মিছিল বের হবে। শত শত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্য আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের মানুষ অংশ নেবে এই আলোর মিছিলে। নতুন প্রজন্ম নতুন করে পাঠ নেবে আমাদের ইতিহাস, আমাদের সাহসের প্রধানতম উৎস মুক্তিযুদ্ধ থেকে। আমার খুব মনে পড়ছে, এই মিছিলে একদা শামিল ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক, আবদুল জলিল, ব্যারিস্টার শওকত আলী, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, কবি শামসুর রাহমান, ভাষা সৈনিক গাজীউল হক, কাজী আরেফ আহমেদ, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। তারা আজ প্রয়াত। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বর্তমান সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী মিছিলে অংশ নিয়েছেন। তবে এই মিছিলটি বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধা আর শহীদ পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে।

বিজ্ঞাপন

ফজলুর রহমান : সাংবাদিক।

সারাবাংলা/পিএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন