বিজ্ঞাপন

৪৮ বছর ধরে স্বীকৃতির অপেক্ষায় রাণীনগরের ১০ বীরাঙ্গনা

March 26, 2019 | 7:48 am

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

নওগাঁ: দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামের ১০ বীরাঙ্গনা আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। স্বীকৃতি না পাওয়ায় বঞ্চিত হচ্ছেন সরকার ঘোষিত সকল সুযোগ-সুবিধা থেকেও। ১৯৭১ সালে দেশ-মাতৃকার টানে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাক হানাদারদের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছিলেন তারা। কিন্তু আজ ৪৮ বছর পরও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি তাদের।

বিজ্ঞাপন

স্বীকৃতি না পাওয়া এমন বীরাঙ্গনাদের মধ্যে কেউ কেউ ইতোমধ্যে মারা গেছেন। যারা বেঁচে আছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন রেনু বালা, মায়া সূত্রধর, রাশমুনি সূত্রধর, কালীদাসী পাল, সুষমা পাল, সন্ধ্যা পাল, ক্ষান্ত বালা পাল। তাদের সকলেরই বসবাস রাণীনগরের আতাইকুলা পাল পাড়া গ্রামে। এছাড়া ইতোমধ্যে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিয়েছেন বাণী পাল ও কান্তা পাল।

একাত্তরের সেই দুর্বিসহ যন্ত্রণার স্মৃতি আর সামাজিক বঞ্চনার পাশাপাশি দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটন ও অসুস্থতার মধ্যেই চলছে জীবিতদের জীবন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সরকার প্রতিবছর বীরাঙ্গনা নারীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও সেই তালিকায় রাণীনগরের ১০ বীরাঙ্গনার নাম তালিকাভুক্ত না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।

সন্ধ্যা পাল

রাণীনগর উপজেলা সদর থেকে ৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে নওগাঁর ছোট যমুনা নদীর তীরে আতাইকুলা পালপাড়া গ্রাম। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল সেখানে পাক হানাদার বাহিনীর স্থানীয় দোসর রাজাকার আলবদরদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় প্রকাশ্য দিবালোকে সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নির্যাতন চালায়। এই সময় তারা হত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট চালায়। সংখ্যালঘু পরিবারের কিশোর, যুবক ও বিভিন্ন বয়সী নারীদেরকে ধরে ওই গ্রামের সুরেশ্বর পালের বাড়ির বারান্দায় একত্রিত করে। তারপর ব্রাশ ফায়ার করে ৫২ জন মুক্তিকামী জনতাকে নির্বিচারে হত্যা করে।

বিজ্ঞাপন

৫২জনকে হত্যা করে উল্টো আমার উপরও  নির্যাতন চালায়

পাক-বাহিনীর নির্যাতনের স্বীকার কালীদাসী পাল (৭৮) জানান, ওই দিন সকালে যখন আমাদের গ্রামে পাঞ্জাবীরা (পাক সেনা) আসে তখন আমরা স্বামীসহ বাড়ির দরজা লাগিয়ে আত্মগোপনের চেষ্টা করি। কিন্তু স্থানীয় রাজাকাদের সহযোগিতায় তারা দরজা ভেঙ্গে আমার স্বামীকে টেনে হিঁচড়ে রাইফেল দিয়ে মারতে মারতে যোগেন্দ্রনাথের বারান্দায় নিয়ে যায়। স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইলে আমার কথা না শুনে তারা চোখের সামনে আমার স্বামীসহ ৫২জনকে হত্যা করে। আমার উপরও  নির্যাতন চালায়।

কালীদাসী পাল

প্রত্যক্ষ দর্শী সুষমা পাল বলেন, ওই দিন সকাল নয়টার দিকে পাঞ্জাবীরা আমার বাড়িতে কাজ করা অবস্থায় স্বামীকে সুরেশ্বর পালের বাড়িতে ধরে নিয়ে লাইন করে রাখে। আমি ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে পাশের বাড়ির মাটির ডাবরের ভিতর আশ্রয় নেই। বাচ্চার কান্না পাঞ্জাবীরা শুনতে পেয়ে আমাকে সেখান থেকে বের করে আনে। তারপর রাজাকারদের সহযোগীতায় পাক-বাহিনীরা আমার ওপর নির্যাতন চালায়।

লজ্জা ঘৃণায় আমার দিদি বিয়ে না করেই মারা গেলেন

প্রয়াত বাণী পালের ছোট ভাই জয়ন্ত পাল জানান, একাত্তরের ২৫ এপ্রিল সকাল নয়টার দিকে নদী পার হয়ে স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় পাক বাহিনী আমাদের পাড়ায় ঢুকে লুটপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ শুরু করে। বাণী পালের চোখের সামনে তার বাবা শ্রীমন্ত পালকে ধরে মারপিট শুরু করে। সাথে সাথে বীরের মতো সেই সময়ের কিশোরী বাণী পাল পাঞ্জাবীদের রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে পাশের একটি কূপে ফেলে দিয়ে হাতাহাতি শুরু করলে পাক-হায়েনারা তার বাবাকে গুলি চালায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। গুরুতর আহত অবস্থায় ভাগ্যক্রমে তিনি বাঁচলেও বাণী পাল হানাদারদের নির্মম নিষ্ঠুর নির্যাতন থেকে রেহায় পায়নি।

বিজ্ঞাপন

জয়ন্ত বলেন, লজ্জা ঘৃণায় আমার দিদি বিয়ে না করেই মারা গেলেন।

মায়া সূত্রধর

এ দফতর সে দফতর ঘুরেও কোনো সুরাহা হলো না

আতাইকুলা গ্রামের শহীদ পরিবারের সদস্য গৌতম পাল জানান, স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশক সময় অতিবাহিত হলেও মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথা এই গ্রামের শহীদ ও বীরাঙ্গনার পরিবারের সদস্যরা রাষ্ট্রীয় কোনো সুযোগ সুবিধা পায়নি। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তাদের নামের স্থান হয়নি। বড় পরিতাপের বিষয় যে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকার পরও এ দফতর সে দফতর ঘুরেও আমাদের কোনো সুরাহা হলো না।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার অ্যাড. ইসমাইল হোসেন বলেন, এই গ্রামের বীরাঙ্গনা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আবেদন করার প্রেক্ষিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রধান করে একটি তদন্ত দল সরেজমিনে তদন্ত করেছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল মামুন বলেন, এই গ্রামের বীরাঙ্গনাদের দ্রুত রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদানের জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করবো। আমাদের তদন্ত প্রতিবেদন মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল বরাবর পাঠিয়েছি। আশা রাখি সরকার বিষয়টি সুদৃষ্টি সহকারে দেখবেন।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/আরএ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন