বিজ্ঞাপন

যেভাবে ক্র্যাকপ্লাটুন নামটি তাদের হলো

March 27, 2019 | 5:57 pm

হাসান আজাদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ‘লুক হায়দার, এদের বললাম দূরে, ঢাকা থেকে দূরে গ্রেনেড মারার জন্য, এরা তো হোটেল কন্টিনেন্টালে ফুটায়ে দিয়েছে। দে অল ক্র্যাক। দেখছো কী কাজ করেছে ওঁরা? দে অল আর ক্র্যাক। ব্রেভো, ব্রেভো।’

বিজ্ঞাপন

কথাগুলো ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমন্বয়ক, প্রশিক্ষক সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের। তিনি এসব কথা  বলছিলেন আরেক সমন্বয়ক ও প্রশিক্ষক মেজর হায়দারের উদ্দেশে। তবে যাদের নিয়ে তার এই উক্তি—তারা ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সাহসী যোদ্ধা। যারা রাজধানী ঢাকায় গেরিলা আক্রমনের দায়িত্বে ছিলেন। যাদের সাহসিকতায় সম্ভব হয়েছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ও হানাদার বাহিনীর ভিত নাড়িয়ে দেওয়া।

সেসব সাহসিকতার গল্প শোনাতেই সারাবাংলা.নেট ও জিটিভি’র উদ্যোগে বিশেষ টক শো ‘আগুন দিনের কথা’য় অংশ নিয়েছিলেন সেই সময়ে তিন বীর যোদ্ধা—মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, গোলাম দস্তগীর গাজী ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু।

খালেদ মোশাররফের সেই উক্তির কথা স্মরণ করে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বললেন, ‘ওই থেকেই তাদের প্লাটুনের নামটা হয়ে গেলো ক্র্যাকপ্লাটুন।’

বিজ্ঞাপন

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করছিলেন সারাবাংলা ও জিটিভি’র এডিটর ইন চিফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা। তার প্রশ্ন ছিল, ‘ক্র্যাকপ্লাটুন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে ঢাকা শহরে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করতো। যার মধ্য দিয়ে এই যোদ্ধারা কিংবন্তিতে পরিণত হয়েছেন। আমি মোফাজ্জল হোসেন মায়ার কাছে জানতে চাইবো, এই ক্র্যাকপ্লাটুনের ক্র্যাক নামটাই কেন হলো বা ক্র্যাকপ্লাটুন গঠনের পটভূমিটা কী?

উত্তরে আগুন দিনের স্মৃতির পাতা মেলে ধরলেন এই মুক্তিযোদ্ধা। জানালেন তার বিশদ কাহিনী।

ক্র্যাকপ্লাটুন নামটি যেভাবে এলো তার বর্ণনা দেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বীরবিক্রম

প্রস্তুতি পর্ব

মায়া বলেন, ‘ক্র্যাকপ্লাটুনের ইতিহাসটা অত্যন্ত গৌরবের ইতিহাস। আমরা যখন প্রথম ঢাকা শহরে অপারেশনে আসি, সেটা ছিল জুন মাস। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল ও প্রিন্স করিম সাদ উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি দল তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তানে আসবে। সেই খবরটা আমরা যখন আগরতলায় ট্রেনিং নিচ্ছিলাম, তখনই তাদের কাছে ছিল। খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হায়দারদের কাছে ছিল। আমরা যখন ট্রেনিং নিচ্ছি, ঠিক সেই মুহূর্তে একটি খবর এলো, সুবেদার ইদ্রিস বললেন, তোমরা একটু বসো ক্যাপ্টেন হায়দার (তখনও তিনি মেজর হননি) ও মেজর খালেদ মোশারফ আসবেন। তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চান। তারা এলেন। এসে সুন্দর একটা বক্তব্য দিলেন। দেশ সর্ম্পকে ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে। তারপর বললেন, ঢাকায় একটা অপারেশনে যেতে হবে। এই অপারেশনটায় যারা যেতে চাও, ধরে নিতে হবে কেউ ফিরে আসতে পারবে না। যারা এই ধরনের সাহস নিযে যেতে চাও, তারা হাত তোলো।’

বিজ্ঞাপন

প্রস্তুতি নেওয়ার পটভূমির বর্ণনা দিতে গিয়ে মায়া বলেন, ‘তখন পর্যন্ত আমাদের মেলাগড়ে ৮টি প্লাটুন হয়েছে। আমার প্লাটুনটা ছিল তিন নম্বর। তখন আমরা হাত তুললাম বেশ কয়েকজন। ছয় সাতশ লোক আমরা ট্রেনিং নিচ্ছি। ৬০ থেকে ৭০ জন হাত তুলেছিল। তখন খালেদ মোশারফ বললেন, তোমরা ৬০/৭০ যারা আছ, তারা সন্ধ্যার পর আমার টেন্টে (তাঁবু) দেখা করো। বাকিসব যার যার ট্রেন্টে চলে যাও। তো আমরা সময়মতো গেলাম। দেখা গেলো আমরা যারা ইন্টারভিউতে গেলাম, তারমধ্যে বেশ কিছু বাদ পড়ে গেলো। বেছে আমাদের প্রথমে হাবিবুল আলম, আমি, গাজী, মানুসহ ১৩ জন চলে আসলাম ঢাকায়। ঢাকায় এসে দিলু রোডে হাবিুবল আলমের (পরে বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত) বাসায় উঠলাম। চারজন করে করে উঠলাম। পরদিন স্টেডিয়ামের পেছনে আল ইসলাম নামে একটি হোটেল ছিল, ঢাকাইয়া এক ভদ্রলোকের, সেখানে সকাল সাড়ে ১০টায় একত্রিত হলোম। সেখানে অপারেশনটা ঠিক করলাম। জানা ছিল প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসে ইন্টারকন্টিন্টোল হোটেলে উঠবে।’

মায়া আরও বলেন, ‘তখন ঢাকায় একটিই ফাইভ স্টার হোটেল ছিল। এখানেই পাকিস্তানি জেনারেলরা, ওয়ার্ল্ডব্যাংকের প্রতিনিধিরা অবস্থান করবেন। উদ্দেশ্য ছিল, তাদের দেখাতে হবে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান মানে ঢাকাসহ সারাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। সারা বাংলাদেশে যুদ্ধের কোনো অবস্থা নেই। সব শান্ত। এখানে কোনোরকম যুদ্ধ হচ্ছে না। কিছু মিসক্রিয়েন্ট আছে, আওয়ামীপন্থী। এরা দেশ থেকে চলে গেছে। দেশে শান্তি বিরাজ করছে। এইটা প্রমাণ করার জন্যই এই টিমটা আসছে। আর আমাদের কাজ হলো, এদের বুঝিয়ে দেওয়া যে, ঢাকা শহরসহ সারাদেশে গেরিলা যুদ্ধ হচ্ছে। এখানে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে না। এটা প্রমাণ করা। এটা করার জন্যই আমাদের পাঠানো।’

হোটেল ইন্টারকন্টিন্টালে গ্রেনেড হামলা

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড ছোড়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে মায়া বলেন, ‘আমরা আসলাম। প্রথমদিন রেকিতে গেলাম আমরা। ওইদিন আমরা ডেটটা (তারিখ) ঠিক করলাম। ৭ জুন আমরা অপারেশন করবো। ওরা থাকবে তিনদিন। সাত আট নয়। সাত তারিখ আমরা ফেল করলাম, পারলাম না গাড়ি জোগাড় করতে। আট তারিখ আমরা গাড়ি একটা হাইজ্যাক করলাম গুলশান এলাকা থেকে। প্রথমে আমি, আলম, জিয়া আর সামাদ ভাই এই চারজন গাড়ি হাইজ্যাক করে আসি। তখন বাংলাদেশ বেতারের চিফ ক্যামেরাম্যান ছিলেন বাদল ভাই। মুনির চৌধুরীর শ্যালক। উনি আমাদের গাড়ি হাইজ্যাক করতে অত্যন্ত সহযোগিতা করেন। টিভির একটি গাড়ি নিয়ে একটি গাড়ির সঙ্গে চেঞ্জ করে ধরি আমরা। পরে গাড়িটি হাইজ্যাক করে সেটি নিয়ে ইন্টার-কন্টিনেন্টালের সামনে দাঁড় করালাম। পরিকল্পনামাফিক আমরা চারটা গ্রেনেড ছুড়লাম। আলম দুইটা, আমি দুইটা। তখন হোটেল ইন্টার-কন্টিনেন্টালের সামনে বড় বড় কড়ই গাছ ছিল। আমরাও হোটেলের সামনে গিয়ে পৌঁছেছি, ওরাও ঢাকা শহর ঘুরে হোটেলে ফিরেছে। পর্যটনের ২৬ সিটের একটি এসি বাসে করে ঢাকা শহর ঘুরে দেখে ওরা। গাড়ি থেকে নামলো। ক্যামেরা ইত্যাদি তাদের কাঁধে। নেমে লবিতে দাঁড়িয়ে আছে। হোটেলে প্রবেশের গেটটা ক্লক ওয়াইজ ঘুরে দু’জন দু’জন করে ঢুকতে হয়। আমরা যখন গ্রেনেড চারটি থ্রো করি, সব ক’টিই গিয়ে ওদের পায়ের কাছে পড়ে। এরমধ্যে দুই তিনজন সাংবাদিক হয়তো বুঝতে পারে, এখানে বোমা বা কিছু ফেলা হয়েছে। ওরা একসঙ্গে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। ওদের কেউ একদিক দিয়ে ঢুকতে চাইছে, কেউ অন্যদিক দিয়ে ঢুকতে চাইছে। ফলে কেউই ঢুকতে পারছে না। দরজা ধাক্কাচ্ছে কিন্তু আটকে গেছে সব। আমরা চারটা গ্রেনেড মেরেই গাড়ি নিয়ে বিদায়। এরপর কাকরাইল মসজিদের কাছে যেতে না যেতেই ধাম ধাম করে চারটা গ্রেনেড ব্লাস্ট হওয়ার শব্দ পাই। ব্লাস্ট হওয়ার পর তো চিৎকার শুরু হয়ে গেছে। কয়েকজন মারা গেছে।’

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড হামলার পরবর্তী মুহূর্তে বর্ণনা দিতে গিয়ে মায়া বলেন, ‘আমরা চলে গেলাম ওখান থেকে গোলাম আজমের বাড়িতে। ওখানে গিয়া ছুড়লাম দুইটা গ্রেনেড। ওখান থেকে গেলাম দৈনিক বাংলা (তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান) মোড়ে, ওখানে গিয়ে আরও দুটি গ্রেনেড ছুড়লাম। এরপর পুরানা পল্টনে মসজিদের সামনে বটগাছওয়ালা একটা বাড়ির (বাড়িটা এখনো আছে) সামনে গাড়িটা ফেলে রেখে আমি আর আলম চলে যাই। আলমের বাড়িতে গিয়ে আমরা টিভি দেখছি। এরমধ্যে আলমের বাবা দৌড়ে এলেন, আর বলতে থাকলেন, আলম দেখো, দেখো, কারা যেন ইন্টার-কন্টিনেন্টালে বোমা মেরেছে। সেখানে নাকি এত লোক মারা গেছে। বিবিসিতে বলতেছে, ভয়েস অব আমেরিকা বলতেছে। ইন্ডিয়া থেকে নিউজ করতেছে।’

বিজ্ঞাপন

যেভাবে ক্র্যাকপ্লাটুন নাম হলো

ক্র্যাকপ্লাটুন নামকরণের প্রসঙ্গে মায়া বলেন, ‘‘এবার ক্র্যাক প্লাটুনের কথাটা বলছি। আমাদের খালেদ মোশারফ বলেছিলেন, ঢাকা থেকে দূরে মানে যাত্রাবাড়ী, ডেমরার আশেপাশে থেকে তোমরা এই গ্রেনেডগুলো ফুটাবা। ঢাকা শহরে  আওয়াজ যেন ওদের কানে যায়। আমরা কিন্তু সেটা না করে, ওদের কেন্দ্রেই আঘাত করলাম। ভাবলাম, এলামই যখন ওদের কেন্দ্রে হিট করবো। এর আগে কিন্তু একটা খবর হয়ে গেছে যে, ঢাকায় এ রকম একটা দুর্ধর্ষ অপারেশন হয়েছে, এরা এরা করেছে। এরপর আমরা যখন খালেদ মোশারফের সঙ্গে দেখা করতে যাই, তাঁবুতে তখন হায়দার ভাই, খালেদ মোশারফ ও ক্যাপ্টেন মতিন ছিলেন। তারা বসে ছিলেন। আমরা তাঁবুতে ঢুকেছি। ঢোকার পরেই প্রথমেই পিনগুলো আমরা জমা দিলাম। ৮/১০টা গ্রেনেড যা মেরেছি, সেগুলোর পিন জমা দিলাম। খালেদ ভাই পিনগুলো হাতে নিয়ে বললেন, ‘লুক হায়দার, এদের বললাম দূরে, ঢাকা থেকে দূরে গ্রেনেড মারার জন্য, এরা তো হোটেল কন্টিনেন্টালে ফুটায়ে দিয়েছে। দে অল আর ক্র্যাক। দেখছো কী কাজ করেছে ওঁরা। দে অল ক্র্যাক। ব্রেভো, ব্রেভো।’ ওই থেকেই ক্র্যাকপ্লাটুন নামটা হলো।’’

ক্র্যাকপ্লাটুনের আরেক অপারেশনের কথা যোগ করেন গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক

যুদ্ধকালে এই ক্র্যাকপ্লাটুনের আরেক অপারেশনের কথা যোগ করলেন গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক। তিনি বলেন, ‘আমি তো মায়ার সঙ্গে গেছি, একসঙ্গেই ঢাকায় আসি আমরা। ইন্টারকন্টিন্টোল অপারেশনে আমি ছিলাম না। আমরা সেদিন চুপচাপ বসে খবর পেলাম যে, অপারেশন হয়ে গেছে। তার দুদিন পর গিয়ে আমরা ওয়াপদা ভবনে অ্যাটাক করলাম। তখন ফরেনার অনেক কনসালট্যান্ট ছিল ওয়াপদা ভবনে। তাদের জানান দেওয়া। ফরেনাররাই বলবে, এখানে বোমা ফুটছে। আমরা অপারেশন করে শেষ। এটা গেলো আমাদের প্রথম কাহিনী। এই ক্র্যাকের পরের কাহিনী হলো অনেকগুলো অপারেশন আমরা করেছিলাম। অন্তত ৫টি পাওয়ার স্টেশনে আমরা অ্যাটাক করেছিলাম। আসল কথা কী, বঙ্গবন্ধু যে দেশপ্রেম আমাদের মধ্যে তৈরি করে দিয়েছিলেন, তখন জীবনের যে একটা ভ্যালু আছে, এটা বুঝতাম না। আমরা মনে করতাম, দেশপ্রেমটাই হচ্ছে রিয়েল ভ্যালু। বঙ্গবন্ধুর ডাকে যেহেতু আমরা যুদ্ধ করতে গেছি, তখন নিজের জীবনকে আর এত মূল্যায়ন করিনি।’

বায়তুল মোকাররম এলাকায় হামলা

বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে, এটাই মূল স্পৃহা ছিল উল্লেখ করে গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, ‘এত টহলের মধ্যেও আমরা ঠিক করলাম, কিছু করতে হবে। একদিন সিভিল ড্রেসে রেকি করলাম এলাকাটা। তখন জিন্না এভিনিউ বলতো। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ বলতো না। পুরো জাঁকজমক অবস্থা। পয়সা তো ওদের হাতে, অবাঙালিদের হাতে। গেনিস নামে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। কী যে ব্যবসাবাণিজ্য, হৈ হুল্লোড়। কী আনন্দ ওদের মধ্যে! তখন মায়া বললো, গাজী এটাকেই ধরতে হবে আগে। চলো তো। আমরা একটা মোটরসাইকেল জোগাড় করলাম। আমার কাছে রাখলাম স্টেনগান। মায়া দুই পকেটে ফসফরাস বোম এবং গ্রেনেড হাতে রাখলো। ফসফরাস দ্রুত আগুন লাগায়। তো আমরা রেকি-টেকি করে দেখলাম, মাগরিবের আজান দেওয়ার পূর্ব মুর্হূতটা সবচেয়ে সেফ। আজান দেওয়ার পর সন্ধ্যা হলে আর্মিরা রাস্তায় টহল বাড়িয়ে দেয়। দিনের বেলায় টহলটা কম। আমরা এই সময়টা বেছে নিলাম।’

গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, ‘আমরা মোটরসাইকেল নিয়ে বায়তুল মোকারম ঘুরে গিয়ে অপারেশনের জায়গার দিকে যাচ্ছি। মানু মোটরসাইকেল চালায়। মাঝখানে মায়া  ও পেছনে আমি স্টেনগান খুলে বডির সঙ্গে লাগিয়ে রওনা দিলাম। সঙ্গে মাস্ক নিয়েছিলাম। যেন কেউ চিনতে না পারে। অপারেশনস্থলে গিয়েই যখন মোটরসাইকেল থামবে, তখন মাস্ক পরে নেব। মাস্ক পরে নিয়ে অপারেশন আরম্ভ করবো। ৫/১০ সেকেন্ডের মধ্যে এই এই কাজটা করতে হবে। এটাই হলো আমাদের পরিকল্পনা। ঠিক গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পটাপট মাস্ক পরে নিলাম। আর মানু মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়াতেই আমি স্টেনগানটা দিয়ে ভেতরে গিয়ে ফায়ার করতে শুরু করলাম। গেটের কাছ থেকে। তারপর দেখি মায়া পেছন থেকে ফসফরাস গ্রেনেড ছুড়ছে। আমি দেখলাম, চকচক করে আগুন লাগলো। ঝলসে যাওয়ার মতো আগুন। আমি আগুনের মধ্যেও ফায়ার করছি। ফায়ার করতে করতে মায়া বললো চল চল শেষ। তো আমরা ফিরতে শুরু করলাম। এদিকে বায়তুল মোকারমে শার্টার পড়ার আওয়াজ, ধুমধাম শার্টার পড়ার আওয়াজ হচ্ছে। এরপর আমরা ভোগ ফ্যাশনের দিকে গেলাম। তখন ভোগ ফ্যাশনের শার্টারটা অর্ধেকের বেশি নেমে গেছে। মায়া শার্টারের তলা দিয়েই ফসফরাস গ্রেনেড ছুড়ে দিল। ওটাতেও আগুন ধরে গেলো। পরে আমরা সেগুনবাগিচা গিয়ে যে যার মতো চলে গেলাম। মানুকে বললাম তুই, তোর মত যা। আমি নেমে গেলাম এক জায়গায়, মায়া নেমে গেলো এক জায়গায়।’

এমনই ছিল ক্র্যাকপ্লাটুনের অপারেশন, যোগ করেন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু

‘এমনই ছিল ক্র্যাকপ্লাটুনের অপারেশন’, যোগ করেন আরেক আলোচক সাহসী মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। তিনি বলেন, ‘মায়া, গাজীরা জুন মাস থেকে ধারাবাহিকভাবে অপারেশনগুলো একেবারে আগস্ট মাসের শেষ পর্যন্ত চালিয়ে গেলো। আগস্টের শেষে একটা বির্পযয় ঘটে। সেই বির্পযয়ে আমাদের অনেক মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাৎ বরণ করেন কিংবা মিসিং হন। এখন পর্যন্ত আমরা জানি না। সেই বির্পযয়ের পরে যখন মেলাগড়ে খুব দ্রুত পৌঁছাই, আমার এখনো মনে আছে, খালেদ মোশারফ রাতের বেলা আমাকে ও মানিককে (শহীদ মানিক বীর প্রতীক) ডাকলেন। আমাদের আন্ডারে দুইটা প্লাটুন ছিল। তো আমরা পাহাড়ের ওপরে উঠলাম। দেখি হায়দার ভাই বসা, খালেদ মোশারফ ও শাহাদাত চৌধুরী বসা। শহীদুল হক খান বাদলও ছিলেন। বললেন যে, ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের বির্পযয় হয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কিছু মুক্তিযোদ্ধা ধরে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। তারপরের দিন আসার আগে মায়ার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তখন মায়ারা পৌঁছে গেছে মেলাগড়ে।’

কাকরাইল এলাকা ও মালিবাগ অপারেশন

বাচ্চু আরও বলেন, ‘তখন খালেদ মোশাররফ বললেন, তোমরা ঢাকায় যাবে দ্রুত এবং তোমাদের হাতে ১৫ দিন সময়। ১৫দিনের মধ্যে অপারেশন শুরু করতেই হবে। কারণ, এই সেটব্যাকে জনগণের মনোবল ভেঙে যেতে পারে। ওরা তো নিউজ করেছে। একটা বিষয় কী, সীমান্তের ওই পারে আর এই পারে আকাশ-পাতাল তফাৎ। এখানে ভযাবহ। আমাদের বলা হয়েছিল, তোমরা চলে যাবে সাভারের দিকে। সেখানে এয়ারফোর্সের বজলু বলে একজন রয়েছেন, (তিনি এখনো বেঁচে আছেন। ৮৪ বছর বয়স। সেদিনও দেখা হলো) তার নেতৃত্বে ওখানে একটা লড়াই হয়ে গেলো। কিন্তু পরবর্তীপর্যায়ে আমরা দেরি করলাম না, আমরা সাত কী আট দিনের মাথায় কাকরাইল মোড়ে প্রথম, ৩০ আগস্টের পরে ৮ দিনের মাথায় আবার অ্যাটাক শুরু করলাম। মুক্তিযোদ্ধারা যে সক্রিয় আছে, আমাদের অবদমিত করতে পারেনি, জনগণকে সেটা জানান দেওয়া, একইসঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে জানান দেওয়াই উদ্দেশ্য। কাকরাইলে এখনো যে পেট্রোল পাম্পটা আছে, ওটাকেই প্রথম অপারেশন হিসেবে নিলাম। ঠিক মায়াদের তিনমাস পর আমাদের অপারেশন শুরু হলো। এরমধ্যে আজিজরা করেছে। বাকিরা ঢুকেছে, রাজারা ঢুকেছে। অনেকেই ঢুকেছে। যে যার মতো অপারেশন করছিলো। তবে একটা পরিকল্পনা ছিল।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু মায়াদের দলটা শুরু থেকে আসছে, সে কারণে এর বিশাল একটা অপারেশনের ইতিহাস আছে। ঢাকা শহরে। মেজর অপারেশনগুলো তারাই করেছ।’

এই মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব  আরও বলেন, ‘আমরা এলাম সেপ্টেম্বরে। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরের ১৫দিন। কিন্তু তখন একটু স্ট্রাটেজি বদলেছে। যেমন মায়ারাও যেটা বলছে, সেটা খুবই সত্যি যে, গ্রাম এলাকায় আস্তানা করে সেখান থেকে উঠে এসে অ্যাটাকটা করা, আমাদেরও তাই। চারিদিক থেকে তাই করেছে। আমরাও সাভার ও ধামরাইতে অবস্থান করেছি।’

বাচ্চু বলেন, ‘খালেদ মোশারফ বা বা হায়দার ভাইয়ের যে প্ল্যানিংটা ছিল ঢাকাকে এনসার্কেল করা, ঢাকার ভেতরে আক্রমণ করা এবং যতজন পারা যায় বেঁচে থাকা। আমার একটা কথা মনে আছে, রাতের বেলা খালেদ মোশারফ ভাই যখন লাস্ট ব্রিফিংটা দিচ্ছেন, তখন কিন্তু একটা কথা বলেছিলেন, তোমাদের কিন্তু বেঁচে থাকতে হবে। তোমরা হিট করবে, পালিয়ে যাবে, বেঁচে থাকতে হবে। কারণ বেঁচে থাকাটা জরুরি। যুদ্ধটা চালু রাখতে হবে। উনি এটাও জানতেন ঢাকা শহরে গিয়ে যুদ্ধ করাটা কত কঠিন। তারপরও আমরা মালিবাগের কাছে রেলওয়েটা উড়িয়ে দেই। আমাদের বলা হয়েছিল কমিউনিকেশনগুলো ডেস্ট্রয় করতে হবে। তো আমি মানিকসহ প্ল্যান করে সে কাজটাই করি। ওইটা আমার আনন্দের একটা অপারেশন বলে মনে হয়। রেললাইনের দুই পাশে তখন অনেক বস্তি। বস্তির লোকজন সারাক্ষণ হাঁটাচলা করে। আর কালর্ভাটও ওখানেই। আমরা একটা সাহস করলাম। দুই তিনদিন রেকি করলাম। তারপর বললাম, আমরা অপারেশনটা করবো। খেয়াল করলাম ট্রেনগুলো অনিয়মিতভাবে আসা-যাওয়া করে। তখন আমরা এক্সপ্লোসিভ দিয়ে কালভার্টটাকে উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যখন এক্সপ্লোসিভ বসাচ্ছি, তখন আশপাশে লোকজন টের পায়। তারা বলে মুক্তি আসছে, মুক্তি। আমরা জনগণের মধ্যে আনন্দ, তাদের উৎসাহ দেখতে পেলাম। তারা কোনো বাধা দিলো না, সিনিয়ররা বললো, তোমরা করো করো। আমরা এক্সপ্লোসিভ নিয়ে এক মিনিট বা আধা মিনিটের একটা ফিউজ দিয়ে সরে পড়লাম। এরপর কালভার্টটি উড়িয়ে দিয়ে চলে আসলাম। এগুলো করে আমি যখন রাতের বেলায় মালিবাগে একটা বাসায় গেলাম, নাজমী সাহেবের বাসায়। নাজমি সাহেব তখন একটা কথা বললেন, যা করেছ ভালো হয়েছে। আমরা অন্তত আশ্বস্ত হয়েছি যে, মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধটা চালিয়ে যাচ্ছে।’

সারবাংলা/এইচএ/এমএম/এমএনএইচ

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন