বিজ্ঞাপন

এফআর টাওয়ারে আগুন: হতাহতের সংখ্যা বাড়ে ৬ কারণে

March 29, 2019 | 10:23 pm

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: রাজধানীর বনানীর বহুতল ভবন এফআর টাওয়ারের আগুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৫ জনের মৃত্যু, আর আহত হয়েছেন ৭৩ জন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে মূলত ছয়টি কারণে। কারণগুলো হলো—ভবনের নিজস্ব আগুন নির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা, জরুরি প্রয়োজনে দ্রুত নির্গমণের প্রয়োজনীয় সিঁড়ি না থাকা, ভবনের চারদিকে খালি জায়গা না থাকা, বিল্ডিং কোড না মানা, অটোমেটিক ইলেকট্রিক লকযুক্ত দরজা এবং ভবনের ভেতরে ফিনাইল বোর্ড দিয়ে করা ডেকোরেশন ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশন কর্মকর্তা এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভবনে অগ্নি নিরাপত্তার জন্য ন্যূনতম কোনো সিস্টেম ছিল না। যে লিফট রয়েছে সেটিও ছোট, সিঁড়ি রয়েছে দুই ফুট আর চার ফুটের মাত্র দুটি। আপদকালে বের হওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এক ভবনের সঙ্গে আরেক ভবন লাগানো অবস্থায় রয়েছে। ফলে বাকি ভবনগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা

প্রতক্ষ্যদর্শীরা বলছেন, ভবনে আগুন লাগার পর সঙ্গে সঙ্গেই তা ছড়িয়ে পড়েনি। দীর্ঘক্ষণ ধরে আগুন জ্বলতে জ্বলতে তা বড় হয়ে দাঁড়ায়। যদি ভবনের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকতো, তা হলে প্রথমেই আগুন নিভিয়ে ফেলা যেতো।

ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (ঢাকা মেট্টো) দেবাশীষ বর্ধন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আট বছর আগে এই ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় অগ্নি নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সুপারিশ অনুযায়ী কোনো পরিবর্তন আসেনি। এখানে সামান্য এস্টিংগুইসার পর্যন্ত ছিল না। যেখানে প্রতি ফ্লোরে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকা দরকার। তার কিছুই এখানে ছিল না।’

বিজ্ঞাপন

দ্রুত নির্গমণের প্রয়োজনীয় সিঁড়ি না থাকা

নিয়ম না মেনে গড়ে ওঠা এই ভবনে ছিল না কোনো জরুরি প্রয়োজনে নেমে যাওয়ার কোনো সিঁড়ি। ফলে আগুন ছড়িয়ে পড়লে ধোঁয়ায় দ্রুতই চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায়। এজন্য মূল সিঁড়িতেও অনেক মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারও বলছেন, এই ধরনের ভবনে সাধারণত জরুরি বের হওয়ার জন্য নির্গমনের পথ রাখতে হয়। এই ভবনে সেসব কিছুই ছিল না।

বিল্ডিং কোড না মানা

রাজউক সূত্রে জানা যায়, বনানীর এফআর টাওয়ার ১৫ তলার অনুমতি পেয়েছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে ১৫ তলার ওপর একে একে আরও সাত তলা করা হয়। এর মালিক ইঞ্জিনিয়ার ফারুক হোসেন কীভাবে এই ভবনে নকশাবহির্ভূত আরও সাত তলা করলেন, তা কেউই জানেন না।

বিজ্ঞাপন

ভবনের মালিক ইঞ্জিনিয়ার ফারুক হোসেনও নিয়ম না মানার বিষয়ে কোনো উত্তর দিতে পারেননি। অন্যদের ওপর দোষ চাপিয়ে তিনি বলেন, ‘কাশেম গ্রুপ জোর করে ২০, ২১ ও ২২ তলা বানিয়েছে। এখানে ভবন মালিক ও ভবন পরিচালনা মালিকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক না থাকার কারণে কারও খবর কেউ নেয় না। কারও কথা কেউ শোনেও না।’

ভবনের চারপাশে খালি জায়গা না থাকা

ভবনের কোনো পাশেই পর্যাপ্ত খালি জায়গা রাখা হয়নি। নিয়ম না মেনে গড়ে ওঠার ফলে চারপাশই ছিল বদ্ধ। ফলে অগ্নিনির্বাপণের ক্ষেত্রেও বাধার মুখে পড়েন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। আটকেপড়াদের নামিয়ে আনার ক্ষেত্রেও তাই বারবার বাধার সম্মুখীন হন তারা।

ফিনাইল বোর্ড দিয়ে করা ডেকোরেশন

ভবনের ভেতরে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলছেন, ফিনাইল বোর্ড দিয়ে ভেতরে ডেকোরেশন করা ছিল। যে কারণে আগুন ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। এছাড়া, অনেক ইলেক্ট্রনিকস যন্ত্রপাতি ছিল বিশেষ করে কম্পিউটার, এসি ও ইলেক্ট্রিক ক্যাবল। ফ্লোরে থাকা কার্পেটও আগুনের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, ‘ভবনের ভেতরে ফিনাইল বোর্ড দিয়ে ডেকোরেশন করা ছিল। এই বোর্ডের কারণেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এতে আগুনের মাত্রা বেড়েছে। ফিনাইল বোর্ডসহ প্লাস্টিকের যেসব আইটেম ছিল সেগুলোও ওয়ান কাইন্ড অব ফুয়েলের মতো। এগুলোতে আগুন লাগলে দ্রুত ছড়িয়ে যায় এবং এখানেও তাই হয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

অটোমেটিক ইলেকট্রিক লকযুক্ত দরজা

ভবনের অনেকগুলো অফিসেই ছিল অটোমেটিক ইলেকট্রিক লকযুক্ত দরজা। যার ফলে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর সেগুলো স্বংয়ক্রিয়ভাবেই বন্ধ হয়ে যায়। আর দরজা ভাঙার মতো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও ভেতরে ছিল না। যে কারণে ভেতরে আটকা পড়েন অনেকে।

বনানী কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের বাসিন্দা হাজী লোকমান গাজী বলেন, ‘এফআর টাওয়ার বরাবর দুই দিকে অন্তত ১৫/২০টি ভবন আছে যেগুলোর একটিরও অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। এর আগেও এখানে একবার আগুন লেগেছিল, তখন বেশ কয়েকজনের প্রাণহানি হয়েছিল। ওই সময়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এবারও হয়তো তাইই হবে।’

আগুনের ঘটনা তদন্তে ৪ কমিটি

বনানীর কামাল আতাতুর্ক সড়কের এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার পক্ষ থেকে চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলো বলছে, এসব তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়া গেলে আগুন লাগার কারণ ও ভবনের নির্মাণ সম্পর্কিত ত্রুটি-বিচ্যুতি বা অনিয়মের তথ্য উঠে আসবে।

এফআর টাওয়ারে আগুনের সূত্রপাত কীভাবে এবং কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স।

সংস্থাটির মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেন সারাবাংলাকে জানান, ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পরে কীভাবে আগুনের সূত্রপাত, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

আরও পড়ুন: এফআর টাওয়ার মালিকের সঙ্গে ‘যোগাযোগ করতে পারছে না’ পুলিশ

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এফআর টাওয়ারের আগুনের ঘটনা তদন্তে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. তরুণ কান্তি শিকদারকে আহ্বায়ক করে গঠিত তদন্ত কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন—ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের যুগ্মসচিব পর্যায়ের প্রতিনিধি, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পর্যায়ের ঢাকা প্রতিনিধি, গুলশান জোনের উপপুলিশ কমিশনার এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান ভুঁইয়া।

অন্যদিকে, এ ঘটনা তদন্তে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের নির্দেশে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. ইয়াকুব আলী পাটওয়ারীকে আহ্বায়ক ও যুগ্মসচিব মো. ফাহিমুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে গঠিত কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন— স্থাপত্য অধিদফতরের প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাসীর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সদস্য (পরিকল্পনা) আবু সাঈদ চৌধুরী, গণপূর্ত অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মো. মইনুল ইসলাম এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম।

এছাড়া বনানীর এই অগ্নিকাণ্ড তদন্তে আট সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বনানীতেই এক ব্রিফিংয়ে দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান জানান, মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ফজলুর রহমানকে প্রধান করে কমিটি করা হয়েছে।

কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের আরও একজন অতিরিক্ত সচিব, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, ঢাকা জেলা প্রশাসন, বুয়েট ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে একজন করে সদস্য রাখা হয়েছে। ভবন নির্মাণে কোনো ধরনের কোনো ত্রুটি থাকলে তা জড়িতদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী।

উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) দুপুর পৌনে একটায় আগুনের সূত্রপাত ঘটে এফআর টাওয়ারে। যা নিয়ন্ত্রণে আনতে কমবেশি ৬ ঘণ্টা সময় লাগে।  ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের গুলশান জোনের দেওয়া তথ্য  অনুযায়ী, এই ঘটনায় মারা গেছেন ২৫ জন এবং আহত হয়েছেন ৭৩ জন।

সারাবাংলা/ইউজে/এমও/এমএনএইচ/

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন