বিজ্ঞাপন

২ এপ্রিল: ভুলে যাওয়া জিঞ্জিরা জেনোসাইড!

April 2, 2019 | 11:35 pm

রহমান রা’আদ

ভোর হচ্ছে। ২ এপ্রিল, ১৯৭১।

বিজ্ঞাপন

চারপাশে প্রভাতের কোমল আলো ফুটে উঠছে ধীরে ধীরে। উদ্ভ্রান্তের মত ছুটছেন রায়হান চৌধুরী। এক হাতে স্ত্রী রাফিয়া, অন্য হাতে মেয়ে নাফিজার হাত শক্ত করে ধরে আছেন। আশপাশে শুধু মানুষ আর মানুষ, ছুটছে সবাই… হঠাৎ বুড়িগঙ্গা নদীর ওই পাড়ে তীব্র আলোকরশ্মি, আলোকিত হয়ে গেল চারপাশ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুরু গুলি। ঠা ঠা ঠা… আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে মর্টারের গোলা পড়তে লাগল একের পর এক। আশপাশে সবাই পালাচ্ছে। ছোট্ট নাফিজা হঠাৎ আবিষ্কার করে— তার আব্বুর হাতটা সে খুঁজে পাচ্ছে না। কখন যেন আব্বু-আম্মুকে হারিয়ে ফেলেছে সে। তার অসহায় কান্না ঢাকা পড়ে গেল মরণাপন্ন মানুষের তীব্র আর্তচিৎকারে…

ঠিক সেই মুহূর্তে মিটফোর্ড হাসপাতালের (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) ছাদে দাঁড়িয়ে সভ্যতার জঘন্যতম পৈশাচিকতা দেখতে দেখতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার রশিদের মুখে আত্মতৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল— ঢাকা থেকে ২৫ তারিখের পর যে বাঙালিগুলোও পালিয়েছিল, সবগুলোকে আজকে এই জিঞ্জিরায় খতম করে দেওয়া যাচ্ছে! এমনিতেই বুড়িগঙ্গার তীরে এই জিঞ্জিরা, কালিন্দী আর শুভ্যাডা এলাকায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস বেশি; তার ওপর প্রায় এক লাখ মানুষ পালিয়ে এসেছে ঢাকা থেকে। আজকে এইগুলারে এইখানেই পাকিস্তানের নামে পুইতা ফেলা হবে। মনে মনে ভাবে ব্রিগেডিয়ার রশিদ ভাবে, ‘শুক্রবারের এই পবিত্র দিনটিতে এই পাকিস্তানের শত্রু ইন্ডিয়ার দালালগুলারে ঝাড়েবংশে শেষ করতেছি, জেনারেল টিক্কা খান আমার ওপর খুশি না হইয়া এইবার যাইব কই!’

বেলা বাড়তে বাড়তে পাকিস্তানি সেনারা ঢুকতে থাকে গ্রামগুলোতে। একের পর এক বাড়িতে ঢুকেই ব্রাশফায়ার। মায়ের কোল থেকে বাচ্চাকে কেড়ে নিয়ে বুটের নিচে পিষতে থাকল কয়েকজন, নারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকল লোলুপ হিংস্রতায়। বাড়িগুলো ততক্ষণে পুড়ছে আগুনে। রাস্তা, পুকুর পাড়, ক্ষেত, বাগান— যাকে যেখানে পেল, সেখানেই গুলি করে মেরে ফেলতে থাকল। মেয়েদের অনেককে তুলে নিয়ে গেল উচ্চপদস্থ অফিসারের জন্য ‘তোফা’ হিসেবে।

বিজ্ঞাপন

মান্দাইল গ্রামে ৬০ জনকে এক লাইনে দাড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করার পর বেয়নেট দিয়ে গলা আর পেট চিরে দেওয়া হলো। যেন নিশ্চিত হয় সবার মৃত্যু। কালিন্দ গ্রামের এক বাড়িতে ১১ জন হিন্দু নারীকে পাশাপাশি ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়লো, ধর্ষণ শেষে বেয়োনেট দিয়ে মোরব্বার মত খোঁচাল কিছুক্ষণ। তারপর রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলো। চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সবখানে।

ওদিকে বুড়িগঙ্গার তীরে তখনো হত্যার মহোৎসব চলছেই। বাচ্চারা যেমন খেলার ছলে টিপে টিপে পিঁপড়া মারে, ঠিক তেমনি পাকিস্তানিরা যাকে ইচ্ছা গুলি করছে, যাকে ইচ্ছা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারছে। মাথার ওপর হেলিকপ্টারের রোটোর ব্লেডের কট কট শব্দ, অবিরাম গুলিবর্ষণ হচ্ছে সেখান থেকেও। মাঝে মাঝেই ফ্লেইম থ্রোয়ার থেকে তীব্র আগুনের হলকা এসে নীচে বিস্তৃত প্রান্তরে প্রাণ হাতে ছুটতে থাকা অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে পুড়িয়ে দিচ্ছে, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকা মানুষ পুড়তে পুড়তেই ছুটছে, একসময় ছুটতে ছুটতে নিস্তেজ হয়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। কখন যেন কান্না থেমে গেছে নাফিজার, দাঁড়িয়ে আছে স্তব্ধ হয়ে। দেখছে রক্তের হোলি খেলা। চোখে অবাক অবিশ্বাস। দুঃস্বপ্নও কি এতটা ভয়াবহ হয়, হতে পারে!

বিজ্ঞাপন

আনাস রহমান নামে একজন তার জবানিতে সেদিনের ইতিহাস বর্ণনা করেন এভাবে—

‘২৫ মার্চ ঢাকায় মিলিটারি আক্রমণের পর আমার বাবা আমাদের সবাইকে নিয়ে মিরপুর থেকে কেরানীগঞ্জ বামনসুর চলে যান। তখন আমার বয়স ছিল আট, বড় খালার বয়স ছিল পাঁচ, মেঝ খালার তিন বা সাড়ে তিন, আর ছোট খালা মাত্র হয়েছে। বামনসুরে শুনলাম, এখানেও মিলিটারিরা আসবে। আমরা তখন নানাবাড়ি ভাওয়ালে চলে গেলাম। কিছুদিন পর শুনলাম, সেখানেও আসবে মিলিটারিরা। আগের রাতে সারারাত আতঙ্কে ছিলাম। ভোরের দিকে আমার মামা, চাচা, যাকে যে পেল হাত ধরে চলে গেল। ছোট দুই খালাকে নিয়ে যান আব্বা।  আমি ছোট মামাসহ আরও কিছু আত্মীয়-স্বজন মিলে রওনা দেই। পায়ে হেঁটে পেরিয়ে যাই কলাতিয়া থেকে আরও ভেতরের একটি গ্রামে। আম্মার অনেক জ্বর ছিল ওই সময়। আব্বা ভেবেছিলেন ভোর হলে ছোট চাচা বাকিদের নিয়ে সরে আসবে। কিন্তু আম্মার শরীর অনেক খারাপ থাকায় তাকে, ছোট খালাকে, আমার ফুপু আর নানীকে রেখে চাচা চলে যান। এরই মধ্যে মিলিটারিরা এসে যাকে পাচ্ছিল, লাইন করে দাঁড় করিয়ে মেরে ফেলছিল। ওই গ্রাম থেকে অনেকে যুদ্ধে গিয়েছিল— এ তথ্য তাদের কাছে ছিল। তাই তাদের আক্রোশও বেশি ছিল।’

‘এদিকে আমার নানাবাড়িতে এসে মিলিটারিরা সামনের কিছু ঘর খালি দেখে পরিত্যক্ত বাড়ি মনে করে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করছিল। আমার ফুপু-নানী আমাদের বলেছিলেন, মিলিটারিরা পাউডার ছিটাচ্ছে, কিন্তু ভয়ে বের হতে পারছি না। কারণ বের হলেই তো মেরে ফেলবে। তারা আগুন জ্বালানোর আগে আরেকবার ঢুকে যতটা পারলো লুট করে আগুন ধরিয়ে দিলো। এদিকে মা ডেকে বলছে, এত গরম কেন লাগছে? আমাকে বাইরে নিয়ে যাও। মিলিটারিরা তখনো ছিল। আমাদের বাড়িটা চারদিকে টিন, ওপরে কাঠ, তার ওপর আবার আমরা লাকড়ি আর কেরোসিন রাখতাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আগুনের মাত্রা বাড়লে মিলিটারিরা চলে যায় কেউ নেই ভেবে। এই সুযোগে আমার ফুপু, নানী-মা আর ছোট খালাকে নিয়ে পাশের চাচাদের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেন। ওই ঘরের জানালা দরজা পুড়লেও ভেতরে কিছু হয়নি। আর কিছুক্ষণ থাকলে তারা সবাই কয়লা হয়ে যেতেন। এদিকে ছোট চাচাকে দেখে আমরা কান্নাকাটি জুড়ে দেই। ভেবেছিলাম মা মারা গিয়েছেন, সেইসঙ্গে আমার ছোট বোন। রাতের দিকে বাবা আবার গ্রামে যান, গিয়ে তাদের পেয়ে নিয়ে আসেন।’

সেদিনের সেই নির্বিচার গণহত্যার স্বীকারোক্তি এক পাকিস্তানি দিয়েছিলে এভাবে—

বিজ্ঞাপন

“…we were told to kill hindus and kafirs (non-believers in God). One day in June, we cordoned a village and were ordered to kill the kafirs in that area. We found all the women reciting from the Holy Quran and the men holding special congregational prayers seeking God’s mercy. But they were unlucky. Our commanding officer ordered us not to waste any time”( confession of a Pakistani Soilder)।

জিঞ্জিরা গণহত্যার পরদিন, ৩ এপ্রিল পাকিস্তানি প্রচারযন্ত্র জিঞ্জিরার গণহত্যাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এবং দেশের অন্যান্য মানুষ ও বহির্বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার জন্য হত্যার সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে মিথ্যা খবর প্রচার করে। ৩ এপ্রিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সমর্থিত পত্রিকা মর্নিং নিউজের একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল এরকম—

‘Action against miscreants at Jinjira’; অর্থাৎ ‘জিঞ্জিরায় দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ’।

আর তৎকালীন পিটিবি (পাকিস্তান টেলিভিশন) ওই দিন (২ এপ্রিল) রাতে খবর প্রচার করে—

‘বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় আশ্রয় গ্রহণকারী বিচ্ছিন্নতাবাদী দুষ্কৃতিকারীদের কঠোর হাতে নির্মূল করা হয়েছে।’

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইয়েও সেদিনের সেই গণহত্যার বিবরণ পাওয়া যায়। তাতে লেখা—

২৫ মার্চের কালরাতের সেই গণহত্যার পর সবচেয়ে বড় এই ম্যাসাকার হয়েছিল ঠিক তার পরের শুক্রবার, ২ এপ্রিল, প্রকাশ্য দিবালোকে। অথচ এদিন নির্বিচারে নিহত হওয়া হাজার হাজার মানুষ যেন স্রেফ বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে। তাদের নিয়ে তেমন কেউ লেখেনি, প্রত্যক্ষদর্শীদের ভেতর কেবল কবি নির্মলেন্দু গুণ একটা বই লিখে সেদিনের বীভৎস স্মৃতি সংরক্ষণ করে রাখতে সচেষ্ট হয়েছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। ওই বই যেন সেদিনের নির্বিচার গণহত্যার অন্যতম প্রামাণ্য দলিল হয়ে আছে।

তাছাড়া যেন পুরো পৃথিবীই ভুলে গেছে জিঞ্জিরা গণহত্যার রক্তাক্ত ইতিহাস। আজ বুড়িগঙ্গার ওপারে জিঞ্জিরায় গিয়ে গণহত্যার ছোট্ট একটা স্মৃতিস্তম্ভ ছাড়া তেমন আর কোনো স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে না। একাত্তরের ২ এপ্রিল এখানে কী ঘটেছিল, সে  সম্পর্কে তেমন কারও আগ্রহও নেই, সেদিনের ইতিহাস বলার মতো তেমন কাউকে আর খুঁজেও পাওয়া যায় না। জিঞ্জিরা গণহত্যা তাই একাত্তরের আরেক ‘ফরগটেন জেনোসাইড’ হয়েই হারিয়ে যেতে থাকে, চুপচাপ… নিঃশব্দে!

তথ্যসূত্র প্রয়োজনীয় দলিল:

  • আত্মকথা ১৯৭১, নির্মলেন্দু গুণ, বাংলা প্রকাশ, ২০০৮
  • স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, অষ্টম খণ্ড (পৃ. ৩৭৬-৩৭৮)
  • দৈনিক বাংলা, ১৩ নভেম্বর ১৯৭২
  • একাত্তরের দিনগুলি, জাহানারা ইমাম, সন্ধানী প্রকাশনী, ২০০৫ (পৃ. ৫৬)

সারাবাংলা/টিআর

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন