বিজ্ঞাপন

‘চোখ বন্ধ করলে এখনো আগুন দেখতে পাই’

April 5, 2019 | 10:27 pm

জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ‘আমরা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে যখন ফায়ার ফাইটারদের কাছে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছিলাম, তখন তাদের ক্রেনটি ১২ তলা পর্যন্ত ওঠার মতো সক্ষম ছিল না। তারা বললেন, ক্রেন ওপরে যাবে না। তখন আমরা বাঁচার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।  চারিদিকে আগুন আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ছিলাম। চোখ বন্ধ করলে এখন আগুন দেখতে পাই, গন্ধ পাই।’ গত ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লাগার ঘটনায় বেঁচে যাওয়া তানজীম স্বর্ণা এভাবে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেন।

বিজ্ঞাপন

গত ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লাগলে সেজুঁতি স্বর্ণা নামের আইডি থেকে ফেসবুকে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়।  এতে দেখা যায়, ধোঁয়ায় ঢাকা একটি কক্ষ থেকে উদ্ধারকর্মীদের উদ্দেশে স্বর্ণা বলছেন,  ‘আমাদের  সিঁড়ি পাঠানোর  ব্যবস্থা  করুন। সিঁড়ি না পাঠালে আমরা ধোঁয়ায় মারা যাবো।’  সেজুতি স্বর্ণা তার ফেসবুক নাম হলেও আসল নাম নাঈমা তানজীম স্বর্ণা।

বৃহস্পতিবার (৪ মার্চ) স্বর্ণার রাজাবাজারের বাসায় গিয়ে কথা হয় সারাবাংলার এ প্রতিবেদকের সঙ্গে।  ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে স্বর্ণা বলেন, ‘ক্রেন  থেকে নিচে নামানোর পরই প্রথম বরকে দেখলাম, ওকে দেখার পর মনে হয়েছে আমি বেঁচে আছি।  এরপর তো সব লাশ নামিয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

কখন আপনাকে নামানো হলো—এমন প্রশ্নের জবাবে স্বর্ণা বলেন, ‘সেটা বলতে পারবো না।  তবে, যখন কুর্মিটোলায় গেলাম, তখন পাঁচটার মতো বাজে।  এরপর ইউনাইটেড হাসপাতলে নিয়ে যাওয়া হয় আমাদের, কিন্তু এখনো সব ঠিক হয়নি। রাতে ঘুম হয় না, চোখ বন্ধ করলে আগুন দেখি, আগুনের গন্ধটা পাই।  আর আমার আরেকটা বিষয় ছিল,  আমি প্রেগনেন্ট।  তাই ইচ্ছে করলেও অনেক ওষুধ আমাকে দিতে পারছিলেন না চিকিৎসকরা। আমার ঘুম দরকার, কিন্তু ঘুমের ওষুধও চিকিৎসকরা দিতে পারছিলেন না প্রেগনেন্সির কারণে।’

এক প্রশ্নের জবাবে স্বর্ণা বলেন, ‘আমরাই সবার পরে জেনেছি।  আমাদের নিচের অনেক ফ্লোর থেকেও ছাদ দিয়ে চলে গেছে। কিন্তু আমরা কেন জানলাম না, এটাই বুঝতে পারছি না।  আমাদের অফিসের ফ্রন্ট ডেস্ক, গার্ড—সবাই কখন বের হয়ে গেছে, সেটাও  জানি না। ’ তিনি বলেন, ‘যখন জানতে পারলাম, তখন না নিচে যেতে পারছি, না ছাদে যেতে পারছি।  এত ধোঁয়া, কালো কুণ্ডলির মতো ধোঁয়া।’

এক সময় পুরুষ কলিগরা সবাই মিলে গ্লাস ভাঙার চেষ্টা করলেন জানিয়ে স্বর্ণা বলেন, ‘এর আগে ক্রেন দিয়ে পানি দিচ্ছিল, ওই সময় আমাদের স্যাররা তাদের বলছিলেন, ক্রেনটাকে ওপরে পাঠান।  আমরা ২০ থেকে ২৫ জনের মতো এখানে আছি, কিন্তু তারা বললেন, আগে আগুন নেভাতে হবে, কারণ আগুন ছড়িয়ে যাচ্ছে। খুব সম্ভবত ওই ক্রেনটা ১২ তলা পর্যন্ত যায় না।  তখন আমরা আশা ছেড়ে দিয়েছি। ভেতরে এত হিট, এত ধোঁয়া, ধোঁয়াটা চক্রাকারে ঘুরছিল।  আমাদের মনে হলো, কারও কোনো শক্তি নেই।  নিথর হয়ে ফ্লোরে বসে রয়েছি।  ফায়ার থেকে দেওয়া পানি এসে পড়ছিল ফ্লোরে।  সেই পানি ফ্লোর থেকে নিয়ে খেলাম। এত জ্বালাপোড়া করছিল গলা, ভেতরটা।’

বিজ্ঞাপন

মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা স্বর্ণা বলেন, ‘তারপর আশা ছেড়ে দিলাম। আর বাঁচা হবে না।  অনেক সময় পর কোথা থেকে একটা ক্রেন এলো, খুব সম্ভবত ওপর থেকে লোক নামাচ্ছিল। আর এত হিট হয়ে গেছিল, ফায়ার সার্ভিসের ক্রেন যে একবার ওপর থেকে লোক নামিয়ে আবার আমাদের কাছে আসবে, সেটাও আশা করতে পারছিলাম না।’ তিনি বলেন, ‘ফায়ারের লোকের প্রথমে বললেন, আগে মেয়েদের নিয়ে যেতে চান তারা।  আমি কেবল আমাদের এজিএম ভবতোষ সরকার স্যারকে বললাম, স্যার আমার আর দম নাই, আমি আর থাকবো না।  তিনি মাটিতে বসা ছিলেন, আমার এ কথা শুনে তিনি জানালার কাছে দাঁড় করালেন, মাথার পেছন থেকে দুই হাত দিয়ে চাপা দিয়ে সামনের দিকে মুখ ঠেলে দিলেন, যেন বাইরের বাতাস থেকে নিঃশ্বাস নিতে পারি।  যখন ক্রেন আর জানালার মাঝের জায়গাটুকু দেখলাম, তখন মাথা ঘুরছিল। এত ওপরে আমরা! আমি তো পড়ে যাবো নিচে, তখন ক্রেনে থাকা দুজন ফায়ার ফাইটার বললেন, কোনও দিকে তাকানোর দরকার নেই, চোখ বন্ধ করে হাত দিন, আমরা টেনে নিচ্ছি।  যখন নিচে নামিয়ে আনা হলো, তখন বুঝলাম বেঁচে আছি।’

আগুন লাগার পর কাকে ফোন করেছিলেন—এমন প্রশ্নে স্বর্ণা বলেন, বর রাকিব কামালকে কে জানিয়েছি। কিন্তু আমার মায়ের সঙ্গে বেশি কথা হচ্ছিল। সে খুব অসুস্থ। যখন শেষ বুঝতে পারলাম বের হতে পারবো না, যখন ক্রেন থেকে বলা হলো, তারা উপরে উঠতে পারবে না, তখন শেষ ফোন করি মাকে, ‘বিদায় নেবার জন্য’।

উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) দুপুরে আগুন লাগে এফ আর টাওয়ারে। এ ঘটনায় ২৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এতে আহত হয়েছে অন্তত ৭৩ জন।

সারাবাংলা/জেএ/এমএনএইচ

বিজ্ঞাপন

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন