বিজ্ঞাপন

পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক উত্থান-পতনে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা

April 9, 2019 | 9:49 pm

গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: পুঁজিবাজারে অস্বাভাকি উত্থান-পতন হচ্ছে। তাতে বাজার ‘নিয়ন্ত্রক’ এক শ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীরা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। গত আড়াই মাস ধরে পুঁজিবাজারে দরপতনের কারণে প্রতিনিয়ত পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন শত শত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। অনেকে পুঁজি হারিয়ে বাজারবিমুখ হয়ে পড়ছেন। বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, বাজারকে কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রণ করে মুনাফা লুটে নেওয়ার ঘটনা ঘটলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা অনেকটাই নীরব ভূমিকা পালন করছে।

বিজ্ঞাপন

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারে গত কয়েক বছর ধরে ভালো কোম্পানির শেয়ারের সরবরাহ না থাকা, ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা এবং সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি থাকায় বাজারে দরপতন হচ্ছে। এছাড়াও অনেক বিনিয়োগকারী প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনতে বাজার থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। আবার ভালো কোম্পানির শেয়ার বাজারে না আসায় নতুন বিনিয়োগকারীরা বাজারে আসছেন না। ফলে বাজারে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে, এক শ্রেণির বড় বিনিয়োগকারী পরিকল্পিতভাবে কোনো কোনো শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে বাজার থেকে মুনাফা তুলে নিচ্ছে। ফলে পুঁজিবাজারে এক ধরনের আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে বাজরে দরপতন হচ্ছে।

সর্বশেষ চার মাসের বাজার বিশ্লেষণের তথ্যে দেখা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক উত্থান শুরু হয় এবং জানুয়ারির চতুর্থ সপ্তাহ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। এ সময়ে ২৫ কার্যদিবসে ডিএসইর দৈনিক গড় লেনদেন হঠাৎ করেই ৪০০ কোটি টাকা থেকে হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়। একই সময়ে সূচক বেড়ে যায় ৭০০ পয়েন্টের বেশি।

তবে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে আবারও পুঁজিবাজার নিম্নমুখী হতে শুরু করে। সর্বশেষ ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ৪৯ কার্যদিবসে ডিএসই’র প্রধান সূচক হারিয়েছে ৬৩১ পয়েন্ট। একই সময়ে লেনদেন আবারও সাড়ে তিনশ থেকে ৪০০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। বাজারের এই আচরণকে অস্বাভাবিক মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা ও দেশের অর্থনীতির প্রভাবের পাশাপাশি কিছুটা কারসাজিও থাকতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, সম্প্রতি পুঁজিবাজারের দরপতনের বস্তুনিষ্ট কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থার প্রভাব, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রভাব কমে যাওয়া এবং ব্যাংকিং খাতের ঘোষিত লভ্যাংশের পরিমাণ সন্তোষজনক না হওয়া অন্যতম।

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আরও বলেন, সার্বিকভাবে দেশের ম্যাক্রো-ইকোনমির অবস্থা খুব একটা সন্তোষজনক নয়। এছাড়াও অনুসন্ধান করে দেখা উচিত, বাজারে কোনো ধরনের কারসাজি রয়েছে কি না।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আবু আহমদ সারাবাংলাকে বলেন, গত সাত-আট বছরে ভালো কোনো কোম্পানি বাজারে আনতে পারেনি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। ফলে যেসব কোম্পানি আইপিও‘র মাধ্যমে বাজারে আসছে, প্রিমিয়ামে টাকা নিয়েছে, সেসব কোম্পানির শেয়ারের মূল্য তিন ভাগের এক ভাগ হয়ে গেছে। এছাড়াও অনেক কোম্পানি পুঁজিবাজারে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করছে, আবার অনেক কোম্পানি অযথা বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিচ্ছে। এসব কারণে বাজারে দুর্বল শেয়ারের সরবরাহ বাড়ছে। এসব শেয়ার কিনে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

অধ্যাপক আবু আহমদ বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি থাকায় মানুষ শেয়ারবাজার বিমুখ হয়ে পড়ছেন। অনেক টাকা তুলে সঞ্চয়পত্র কিনছেন। ফলে তারল্য প্রবাহ না থাকায় বাজারে দরপতন হচ্ছে।

অন্যদিকে পুঁজিবাজারের দরপতন প্রসঙ্গে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি’র নির্বাহী পরিচালক মো. সাইফুল রহমান সারাবাংলাকে বলেন, পুঁজিবাজারে শেয়ারের দাম উত্থান-পতন দেখা বিএসইসি’র কাজ নয়। বাজারে কোনো কারসাজি হচ্ছে কি না, তা আমরা নিয়মিত তদারকি করছি। কোনো অনিয়ম পেলে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।

সূচকের অস্বাভাবিক উত্থান: ২০১৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ছিল ৫ হাজার ২১৮ পয়েন্ট। পরদিন ১৮ ডিসেম্বর থেকে পুঁজিবাজার ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করে। টানা উত্থানের ফলে চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি ডিএসই’র প্রধান সূচক ৫ হাজার ৯৫০ পয়েন্টে উন্নীত হয়। এই সময়ে ডিএসই’র প্রধান সূচক বেড়েছে ৭৩২ পয়েন্ট।

এই ২৫ কার্যদিবসের মধ্যে ১৮ দিনই পুঁজিবাজারে সূচকের উত্থান হয়েছে। বিপরীতে মাত্র সাত দিন সূচক ছিল নিম্নমুখী। এছাড়াও গত ১৮ ডিসেম্বর ডিএসই’র বাজার মূলধন ছিল ৩ লাখ ৭৮ হাজার ১৬ কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা। টানা উত্থানের কারণে গত ২৫ জানুয়ারি তা ৪ লাখ ১৯ হাজার ৯৮৮ কোটি ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকায় উন্নীত হয়। ফলে এক মাসের ব্যবধানে ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়ে যায় ৪১ হাজার ৯৭১ কোটি ৯২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা।

বিজ্ঞাপন

সূচকের অস্বাভাবিক পতন: গত ২৪ জানুয়ারি ডিএসই’র প্রধান সূচক ছিল ৫ হাজার ৯৫০ পয়েন্টে। ওই দিনের পর থেকে পুঁজিবাজার নিম্নমুখী হতে শুরু করে। অব্যাহত দরপতনে ৯ এপ্রিল মঙ্গলবার লেনদেন শেষে ডিএসইর প্রধান সূচক ৫ হাজার ৩৭২ পয়েন্টে নেমে আসে। এই সময়ে ডিএসইর প্রধান সূচক হারিয়েছে ৬৩১ পয়েন্ট। একই সময়ে অব্যাহত দরপতনের কারণে ডিএসইর বাজার মূলধন হারিয়েছে ২২ হাজার ৬৫৮ কোটি ৭০ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। সেই সঙ্গে গত দুই মাসে লেনদেন কমে অর্ধেকে নেমেছে। গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে ডিএসইতে দৈনিক গড়ে ৮০০ থেকে ১ হাজার কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা হতো। বর্তমানে তা কমতে কমতে সাড়ে তিনশ কোটি থেকে চারশ কোটি টাকার ঘরে নেমেছে।

সারাবাংলা/জিএস/টিআর

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন