বিজ্ঞাপন

গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না

April 16, 2019 | 4:22 pm

কবির য়াহমদ

‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’- সাদামাটা স্লোগান। সাদামাটা এক বক্তব্য তবু এর প্রতিক্রিয়া ভিন্ন, নানামুখী। পক্ষ-বিপক্ষসহ যতপক্ষই আছেন, তাদের নানা বক্তব্যে উঠে আসছে নানা যুক্তি-পালটা যুক্তি। কথার ব্যবচ্ছেদে একপক্ষ আরেকপক্ষকে ঘায়েলে ব্যস্ত। এরই মাঝে আবার ঢুকে পড়েছে ধর্মের ব্যাখ্যা, চলে এসেছে কথিত পর্দার কথাও। এই যুদ্ধ চলছে অনলাইনে; অথচ গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নারী নিপীড়ক দলের বেশিরভাগই নারী নিপীড়ন করে থাকেন ভিড়ে কিংবা গণপরিবহনে। অনলাইনের এই বিভক্তি প্রমাণ করছে নিপীড়ক দলের সদস্যরা কেবল ভিড় কিংবা গণপরিবহনকেই নিপীড়নের ক্ষেত্র হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বিষয়টিকে তারা অনলাইনেও ছড়িয়ে দিয়েছেন। অনলাইনে গা ঘেঁষে দাঁড়ানো প্রায়োগিকভাবে করা যায় না ঠিক, তবে ওখানে একে জায়েজিকরণ সম্ভব, সেটাই করছেন তারা সোৎসাহে।

বিজ্ঞাপন

গা ঘেঁষে না দাঁড়ানোর বিরোধিতাকারীরা কেবলই টি-সার্টের বক্তব্যের প্রতিবাদেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেনি, তারা আদতে ক্ষেপে গেছে। কেন ক্ষেপে গেলো তারা, এ নিয়ে বিস্তর গবেষণার দরকার নাই; এটা মূলত সমাজের মধ্যকার একটা শ্রেণির নৈতিক অবক্ষয়ের স্মারক। তারা সেই শ্রেণিভুক্ত যারা ধর্ষণের জন্যে ধর্ষিতাকে দায়ী করে থাকেন, তারা সে শ্রেণিভুক্ত যারা ধর্ষিতার পোশাকের দোহাই দিয়ে ধর্ষকের পক্ষ নেন। এই প্রবণতা একদিনের নয়, এটা চলে আসছে ধারাবাহিকভাবে। ফলে নিত্যকার নারী নিপীড়ন কিংবা ধর্ষণের বিরুদ্ধে আমাদের পুরো সমাজ এক কাতারে দাঁড়াতে পারে না। নারী নিপীড়ক ও ধর্ষকের পক্ষে সমাজের একটা শ্রেণি ঠিকই দাঁড়িয়ে যায়, তারা পোশাক আর ধর্মের নাম নিয়ে নানা (কু) যুক্তি উপস্থাপন করে প্রকৃতপক্ষে ধর্ষকদের পক্ষ নেয়।

মানুষের এই অসামাজিক চিন্তাধারা ঝেঁকে বসেছে সমাজের সব স্তরে। এটা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে আমাদের। ফলে জাতীয় ও বৈশ্বিক নারী ক্ষমতায়ন ও সমতা বিধানের যে স্লোগান, যে বক্তব্য, যে আন্দোলন তার দ্বারা আমরা প্রভাবিত হচ্ছি কমই। নারী অন্দরমহলে মানানসই এমন বিশ্বাসধারী লোকের সংখ্যা বাড়ছে। এই মানসিকতার লোকগুলো কেবল প্রান্তিক পর্যায়ের ‘চাষাভুষা শ্রেণির’ নয়, এরা সমাজের সব স্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণ দরকার, বলছি। বলছি শিক্ষার কথা; কিন্তু কত লোক এর দ্বারা পরিবর্তন হবে এ নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ নারী শব্দের, নারী চরিত্রের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয় ধর্মকে। ধর্ষণের শিকার নারীর পোশাক ঠিক ছিল না, নারী কেন দিনে-দুপুরে, রাত-বিরাতে বেরুবে; এমনও এক প্রচারণা আছে সমাজে। এই প্রচারণায় ঢাল হিসেবে দাঁড় করানো হয় ধর্মকে। ফলে একটি শ্রেণির মানুষ আগপাছ না ভেবে সরাসরি নারীর ক্ষমতায়ন ও অবস্থানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

সমাজের একটা শ্রেণির লোক নারীকে ‘অপবিত্র’ বলে মনে করে। এজন্য মাঝে-মাঝে কোথাও সাইনবোর্ড সাঁটাতেও দেখা যায় ‘ঈদগাহের পবিত্রতা রক্ষা করুন, মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ’। চোখে পড়া এমনই এক নজির আছে সিলেটে। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ‘শাহী ঈদগাহ ময়দান’-এ গত বছর ঈদগাহের অভ্যন্তরে নারীদের প্রবেশ নিষেধ লিখে এমন একাধিক সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছিল। ওই ঘটনা স্থানীয় গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হলে সেই সাইনবোর্ড সরানো হয়। যারা ওই ঘটনা ঘটিয়েছিল তারা শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়েছিল সাইনবোর্ড সরাতে, কিন্তু সাইনবোর্ডে উল্লেখ বিশ্বাস থেকে কি সরেছিল? মনে তো হয় না!

নারীকে নিয়ে সবচেয়ে অপমানজনক শব্দ-বাক্য উচ্চারিত হয় ওয়াজ মাহফিলগুলোয়। ইসলামের নামে নারীদের অমন অবমাননা খোদ ধর্মগ্রন্থে রয়েছে কি না, এনিয়ে সন্দেহ আছে। যেসব হুজুর-মাওলানা-মুফতি-ওয়াজি নারীদের এমন ন্যক্কারজনক ভাষায় সম্বোধন করেন, কটু কথা বলেন, সেই তারাই আবার একই কিংবা পৃথক বৈঠকে দাবি করেন নারীদের সবচেয়ে বেশি মর্যাদা দিয়েছে ইসলাম ধর্মই। তাদের এই দ্বৈতরূপের কারণে প্রকৃত সত্য কী, এ নিয়ে কেউ না ভাবলেও তাদের সেই হিংসা-বিদ্বেষ ও বৈরী মনোভাব ছড়িয়ে যায় ঠিকই। ফলে নারীর অধিকার, নারীর চলাফেরা ও নারীর ক্ষমতায়নকে ধর্মের বিরোধিতা বলে বিশ্বাস করার লোকের সংখ্যাও অগণন।

একটা সময়ে নারীদের নিয়ে অবমাননাকর কথাগুলো সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত-নেতা দেলাওয়ার হুসেইন সাঈদীর কণ্ঠে। ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে সারাদেশে পরিচিতি পাওয়া এই মানবতাবিরোধী অপরাধী তার ওয়াজে নারীকে নোংরা ভাষায় বর্ণনা করতেন। গত কয়েক বছর ধরে সাঈদী একাত্তরে তার কৃত অপরাধের জন্যে শাস্তি ভোগ করছেন। এই সময়ে তার নতুন কোনো বক্তব্য না এলেও আগের ওয়াজগুলোর ভিডিও এখনও পাওয়া যায়। স্মার্টফোনের সুবাদে জামায়াতের নেতাকর্মী ছাড়াও সাঈদীর এই ওয়াজের ভোক্তা অনেকেই রয়েছে। সেখান থেকে ঘৃণা ও বিদ্বেষের যে বিষবাষ্প ছড়িয়েছে-ছড়াচ্ছে, তার প্রভাব সমাজের বড় একটি শ্রেণির মধ্যে বিদ্যমান।

বিজ্ঞাপন

গ্রাম শেকড় আমার, গ্রামের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ। খেয়াল করে দেখেছি, প্রায়োগিকভাবে ধর্মকর্মে নিরুৎসাহিত জনের স্মার্টফোনে রয়েছে সাঈদী কিংবা অন্য কারও ওয়াজের ক্লিপস। সময়ে-সময়ে সেটা তারা শোনেও। এমনও দেখেছি একদিকে মসজিদে আজান হচ্ছে, অন্যদিকে সংশ্লিষ্টজন মোবাইলে ওয়াজ শুনছে। আজান মানে নামাজের জন্যে আহ্বান- কিন্তু ওদের কাছে নামাজের ওই আহ্বানের চাইতেও গুরুত্বের সেই সব ওয়াজ। ওইসব ক্লিপসে যেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীদের অবমাননা করা হয়, নানা নোংরা বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয় সেগুলো একশ্রেণির লোক প্রবলভাবে গ্রহণ করছে। সাধারণীকরণ সূত্রে বলছি না সব কথাই বাজে কথা; ওখানে ভালো কথাও থাকে কারও বক্তব্যে তবে সেগুলোর শ্রোতা আর অনুসরণকারীই বা ক’জন কে জানে!

সাম্প্রতিক সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওয়াজ মাহফিল নিয়ে ভাবছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ। দীর্ঘদিন ধরে ওয়াজের বিভিন্ন বক্তা নারীদের অবমাননাসহ দেশবিরোধী বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালিয়ে আসছেন। তাদের ধারাবাহিক সেইসব অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে কার্যকরী। তবে এরআগে থেকে কিছু বক্তা তাদের বক্তব্যে সামাজিক বিশৃঙ্খলার যে বীজ বপন করেছেন, তার খেসারত দিয়ে যাচ্ছে সমাজ, দেশ। টি-সার্টে নারী-নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে বক্তব্য এবং এর প্রতিক্রিয়ায় ধর্মীয় আবেশ জড়িয়ে একশ্রেণির লোক যে বিরোধিতা-নোংরামি আর প্রতিবাদ করে যাচ্ছে, সেটি ওইসব ওয়াজেরই রেশ বললে কি অত্যুক্তি হবে?

‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’, এই বক্তব্যের সমর্থন-বিরোধিতা প্রসঙ্গে ওয়াজ-নসিহত, ধর্মীয় ব্যাখ্যা, নৈতিকতার অবক্ষয়সহ নানা কথা এখানে নিয়ে আসাকে ধান বানতে শিবের গীত ভাবার সুযোগ নাই। কারণ নারী অন্দরমহলে মানানসই, নারী কেন টি-সার্ট পরবে, নারী কেন বাইরে বেরুবে, নারীর ভিড় ঠেলে চলার কী দরকার, নারী কেন গণপরিবহনে উঠবে, নারী পর্দা করবে-হিজাব পরবে, হিজাব-বোরখা পরলে কেউ গা ঘেঁষে দাঁড়ায় না, হিজাব-বোরখা পরলে গাড়িতে পুরুষ নারীকে সিট ছেড়ে দেবে, খেয়াল করলে দেখা যাবে এসব উচ্চারণকারীর শেকড় ওখানেই প্রোথিত।

চিন্তার দীনতা ও সামাজিক অবক্ষয়সৃষ্ট এই ধারার চিন্তাভাবনা একটা সময়ে চুপিচুপি ঢুকেছে সমাজে; সেই চোরাস্রোত এখন জোয়ারসম হয়ে প্রবল ধাক্কায় ভেঙে দিতে চলেছে সামাজিকতা, দৃশ্যমান করছে নারী-পুরুষ ভেদ। যেখানে প্রান্তিক পর্যায়ের অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী নারীকে পুরুষের অধীনস্থ ভাবতো, এখন তাদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে কথিত শিক্ষিত সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ। কলেজ-ভার্সিটিপড়ুয়া অনেকেই এখন মনে করে নারীর ওপর চলমান ধারাবাহিক নিপীড়নের একটা বড় কারণ নারী এবং নারীর পোশাক আর লাইফস্টাইল। তাই ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ বাক্যটি আজ প্রবল প্রতিবাদ আর বিরোধিতার মুখে পড়েছে তাদের দ্বারাও যারা নিজেদের শিক্ষিত দাবি করে এবং অনলাইনে নিজেদের উপস্থাপন করতে সক্ষম।

বিজ্ঞাপন

ভিড় কিংবা গণপরিবহনে গায়ে গা লেগে যেতে পারে, এ নিয়ে কারও কিংবা কোনো নারীর আপত্তি থাকে না, থাকার কথাও নয়। তবে আপত্তি থাকে সেই স্পর্শের যেখানে নিপীড়ন-বাসনা বর্তমান। এ নিয়ে নানা সময়ে নানা আলোচনা হয়েছে নানা মহলে, কিন্তু অবস্থার উত্তরণ হয়নি। এসব আলোচনায় সচেতনতামূলক বিভিন্ন বার্তা দেওয়া হয়, হবেও; এবং এটাই স্বাভাবিক। এই বার্তায় ধারাবাহিকতা সম্প্রতি আলোচিত টি-সার্ট যেখানে গোটা অক্ষরে লিখা ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’। হ্যাঁ, এখানে টি-সার্টটাই পণ্য, বাণিজ্যিক উপাদান; তবে সেটা সমাজ পরিবর্তনের বার্তাবাহী। টি-সার্টের এই বক্তব্য আদতে তাদের উদ্দেশে যারা যৌন হয়রানির উদ্দেশ্যে ভিড় কিংবা গণপরিবহনে নারীদের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। এখানে বক্তব্য পরিষ্কার, উদ্দেশ্যেও। যারা যৌন হয়রানির উদ্দেশ্যে নারীদের গা ঘেঁষে দাঁড়ায় না তাদের এনিয়ে গোসসা হওয়ার কথা ছিল না, তারা গোসসাও হয়নি। ক্ষুব্ধ হয়েছে তারা, যারা সত্যিকার অর্থেই উদ্দেশ্যমূলক স্পর্শকারী এবং তাদের সমর্থক। এই দুই শ্রেণির একটা শ্রেণি ইতোমধ্যেই গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে, অন্য শ্রেণি হয়তো আছে সুযোগের অপেক্ষায়; অন্য একটা শ্রেণি ঝোপ বুঝে কোপ মারার মতো ধর্মবাণিজ্যে!

দুর্ভাগ্য আমাদের ধর্ষণসহ সবধরনের নারী নিপীড়নেও একদল লোক ব্যস্ত থাকে জায়েজিকরণে, তারা নানাবিধ কুযুক্তি হাজির করে ওসবে। এমন অবস্থায় নারীর গা ঘেঁষে না দাঁড়ানোর চলমান আলোচনায় নারীকে প্রতিপক্ষ ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়ার লোকের অভাব থাকার কথা নয়, নেইও। তারা সম্মিলিত-সংগঠিত; তবু তাদের বর্জন করা উচিত সামাজিকভাবে এবং অনলাইনে বন্ধুসঙ্গ ত্যাগের মাধ্যমে। এতে যদি বোধোদয় হয় তাদের, তবে এই এক অর্জন; আর না হলেও অর্জন আমাদের অন্তত প্রতিবাদটুকু করতে পারছি বলে।

লেখক:  সাংবাদিক

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন