বিজ্ঞাপন

দুই শিক্ষকের অগ্রায়ন ও একটি অনবদ্য কবিতা পাঠ

April 21, 2019 | 2:52 pm

মাহমুদ মেনন, নির্বাহী সম্পাদক

শুভ্রতা ছড়ানো আলোময় এক মঞ্চ। পেছনে মিষ্টি লাল-সবুজাভ ব্যাকড্রপে গাঢ় সবুজ রঙে বড় হরফে লেখা ‘অগ্রায়ন’।  তার নিচে জীবনানন্দ থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে- নক্ষত্রের আলো পড়ে ঝরে যেইখানে, পৃথিবীর কানে শস্য গায় গান। সামনে বড় বড় সাদা সূর্যমুখী, ডালিয়ারা ঝুলছে। ফিনফিনে সাদা কাপড়গুলো দুই দিক থেকে ঝুলে ঝুলে দুলছে। পরিমিত প্রক্ষেপিত আলোয় গোটা মঞ্চ আলোকিত। তার মধ্যখানে তিনটি সোফা পাতা। দুইদিকের দুটি সোফায় বসে আছেন দু’জন।

বিজ্ঞাপন

অগ্রায়ন’র মঞ্চ

একজন চিরচেনা সাদামাটা পোশাকে। প্যান্ট-শার্ট। শার্টটা ইন করা, ওটুকুই যা ঠাঁট। শশ্রুমণ্ডিত মুখ, সেই একই মোটা কাচের চশমা। মুচকি হাসি মাখা সৌম্য মুখখানি আলোতে আরও উজ্জ্বল। আর সব আলোকে ছাড়িয়ে তার চশমার পেছনে যে ভুরু, ভুরুর পেছনে যে কপাল সে কপালে আলোর বিচ্ছুরণ।

অপর পাশের সোফায় ফুলেল শাড়িতে সম্রাজ্ঞীর সাজ। সেই একই মা-সুলভ মায়া আর কাঠিন্যের মিশ্রণ আছে বটে, তবে তার মধ্য দিয়েও খুশিময়তার অনিন্দ্য প্রকাশ। চশমার ভেতর দিয়ে চোখের উজ্জ্বলতায় মুগ্ধতার দৃষ্টি। মঞ্চের পাশে থেকে ব্যবস্থা নেওয়া যে স্ট্যান্ডফ্যানের হাওয়া সে তার শীতল করার কাজের পাশাপাশি চুলগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে বার বার। তাতে যে সুন্দরের সৃষ্টি হয়েছে তাতে মুগ্ধ মঞ্চের সামনে বসে থাকা কয়েক শ’ দর্শক। পাশে থেকে একজনতো বলেই ফেললেন- ম্যাডামকে কি যে সুন্দর দেখাচ্ছে আজ!

ইনি অধ্যাপক ড. আখতার সুলতানা। আর আগের জন অধ্যাপক ড. আহাদুজ্জামান মো. আলী। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দুই শিক্ষক। তাদের ‘অগ্রায়ন’ চলছে এই মঞ্চে।

বিজ্ঞাপন

সে কথায় পরে আসি। মঞ্চে মাঝের সোফাটিতে যিনি বসে আছেন তার কথা একটু বলে নেওয়া যাক। টাটকা সুবুজ শাড়িতে তাকেও বেশ লাগছিলো। প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় দুই শিক্ষকের ‘অগ্রায়ন’র এই আয়োজন করতে পেরে তার যে গর্বভরা মুখ, সে মুখে হাসি মেখে বসে আছেন সভাপ্রধান হয়ে। তিনি অধ্যাপক কাবেরী গায়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান।

বিভাগেরই অনুষ্ঠান এটি। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির সহজ স্বাভাবিক নিয়মে বিভাগের দুই শিক্ষকের অবসর হয়েছে। কিন্তু যাদের চর্চা বিদ্যায়, কর্মও যার বিদ্যার্জন আর বিদ্যাদান তাদের কি কখনো অবসর হয়? দোলনায় যার শুরু তার শেষতো কবর অবধি গিয়েই। সুতরাং অবসর বলে কিছু নয়, এ এক অগ্রায়ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে তারা আরও বৃহত্তর পরিমণ্ডলে বিচরণ করবেন তাদের অর্জিত বিদ্যা বিলানোর কাজে। আর সে কারণেই এই ‘অগ্রায়ন’। উদ্বোধনী বক্তৃতায় ঠিক এমনটাই বলছিলেন কাবেরী গায়েন।

তবে তার আগে ডালা ভরা ফুল এলো, উত্তরীয় পরানো হলো দুই অগ্রায়িত শিক্ষককে। এটা ওটা উপহার তুলে দেওয়া হলো।

বিজ্ঞাপন

সামনে দর্শক সারিতে ততক্ষণে এসে বসে গেছেন বিভাগ থেকে আরও আগে অগ্রায়িত চার শিক্ষক- অধ্যাপক সাখওয়াত আলী খান, অধ্যাপক গোলাম রহমান, অধ্যাপক শামসুল মজিদ হারুন, অধ্যাপক কাজী আবদুল মান্নান। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ সামাদ, সামাজিক অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিমও এসেছিলেন। আর বিভাগের শিক্ষকরা, শিক্ষার্থীরা তো ছিলেনই। এছাড়াও দল বেঁধে এসেছেন বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা।

মরাল যেমন জলে কাটে গতিময় সাঁতার… অনুষ্ঠানটিও যেনো তেমনই এগিয়ে চলছে। সঞ্চালনায় অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। বিভাগের জনপ্রিয় তরুণ শিক্ষকদের একজন। সঞ্চালনায় তার নাম আছে বটে, কিন্তু সেতো টক-শো কিংবা এটা ওটায়। দুই অগ্রজের অগ্রায়ণইতো শুধু নয়, দুই শিক্ষকেরও অগ্রায়ণ, দুই বিদ্যানের অগ্রায়ণ সুতরাং গোটা পরিবেশে একটা একাডেমিক ভাব যেমন ছিলো তেমনি ছিলো আনন্দময়তাও। রোয়ায়েত ফেরদৌস তার চেনা ভঙ্গিতে সুন্দর হাসি ছড়িয়ে একটি পর্বের সাথে অন্য পর্বে, একজনের কথা থেকে অন্যজনের কথায় যেতে যে সংযোগ ঘটিয়ে দিচ্ছিলেন তা যেনো তেমনটিই হওয়ার কথা ছিলো। ছোট ছোট লিংকগুলোও ছিলো রেফারেন্সে ভরা, জ্ঞানের প্রকাশ। এভাবেই অনুষ্ঠান এগিয়ে চলছে। এগিয়ে চলছে তবে তা পেছনের কথা স্মরণ করতে করতে। বিভাগের প্রাক্তণ শিক্ষার্থীরা, অধ্যাপক আহাদুজ্জামানের ভাষায় যারা অগ্রায়িত আরুণি, তারাই মূলতঃ স্মৃতির ভাণ্ডার খুলে বলছিলেন কথা। প্রায় সকলেই রোবায়েত ফেরদৌসের বাতলে দেওয়া উল্টো পিরামিড ঢঙে। ইন্ট্রো আর নেক বলবেন। সময় স্বল্পতায় মেজর ডিটেইলস, মাইনর ডিটেইলসে যাওয়া যাবে না। সে ভাবে করতে করতেও বেলা গড়িয়ে আড়াইটা বেজে গেলো। স্মৃতির ডালি থেকে শিক্ষার্থীরা যেমন বললেন, দুই অগ্রায়িত শিক্ষকের যারা শিক্ষক ছিলেন তারাও বললেন কথা। তারাও শোনালেন এই দুই শিক্ষক যখন শিক্ষার্থী ছিলেন সেই দিনগুলোর গল্প। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, ডিন তারাও বললেন কথা।

সবশেষে এলো অগ্রায়িত দুই শিক্ষকের কথা বলার পালা। অধ্যাপক আখতার সুলতানাই বললেন প্রথম। তিনি শোনালেন তার শিক্ষক জীবনের ৩২টি বছরের অর্জনগুলোর কথা। সবচেয়ে সেরা অর্জন হিসেবে তিনি দেখেন- শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাকেই। তবে সম্মান অর্জন করতে হয়, এ কথা উল্লেখ করে তিনি বললেন, শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠদানই নয়, তাদের আরো অনেক সমস্যা থাকে সেগুলো বুঝে, উপলব্দি করে তবেই তাদের প্রয়োজনে হাত বাড়িয়ে দিতে হয় একজন শিক্ষককে। তিনি শিক্ষকতা জীবনে সেটা করার চেষ্টা করেছেন। ‘হয়তো সেটা পেরেছি বলেই আজকে তিন দশক আগেও যাদের পড়িয়েছি, তারাও এখানে উপস্থিত হয়েছে। এর চেয়ে বড় সম্পর্ক এর চেয়ে বড় শ্রদ্ধাবোধ আর কী হতে পারে,’ বলেন অধ্যাপক আখতার সুলতানা। বিভাগের সাথে তার অটুট বন্ধন, এ বন্ধন কখনোই ছিন্ন হবার নয়। তিনি থাকবেন সবার সাথে বিভাগের সাথে। জীবনের শেষক্ষণ পর্যন্ত।

আর অধ্যাপক আহাদুজ্জামান মো. আলী যখন কথা বলতে শুরু করলেন, গোটা মিলনায়তনে তখন পিনপতন নিরবতা। সম্বোধন পর্বেই তিনি বললেন সবার কথা। তার নিজের শিক্ষকদের যারা উপস্থিত ছিলেন, সহকর্মী শিক্ষক যারা বিভাগে এখন শিক্ষাদান করছেন, বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী, যাদের তিনি অগ্রায়িত আরুণি বলে উল্লেখ করলেন, আর যারা বিভাগের কর্মকর্তা, কর্মচারী, যারা এই অনুষ্ঠানের জন্য কাজ করছেন, যারা আলো এনেছেন, যারা সাজসজ্জ্বা করেছেন তাদের কারো কথাই বাদ থাকলো না সে সম্বোধনে। এরপর বললেন, শিক্ষার কথা, সাংবাদিকতার কথা। আর তারও পরে বললেন তার নিজের শিক্ষকদের কথা। আহাদুজ্জামান মো. আলী স্মরণ করলেন সেই সব শিক্ষকের কথা যারা আজ প্রয়াত হয়েছেন, যারা আজ বেঁচে আছেন কিন্তু অগ্রায়িত হয়েছেন তারও আগে। তারা কিভাবে তার ভেতরে, তার মতো অন্য শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়েছেন শিক্ষার আলো। কেউ ইতিহাসে উদ্ধুদ্ধ করেছেন, কেউ সাহিত্য পাঠে, আর কেউ বিজ্ঞানমনষ্কতায়। সেসব কথা বলতে তার মুখে উচ্চারিত হলো অসংখ্য বইয়ের রেফারেন্স, অনেক উক্তি, অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ।

পূর্ণাঙ্গ বক্তৃতা শুনুন এখানে:

বিজ্ঞাপন

সব মিলিয়ে প্রায় ৪৫ মিনিট কথা বললেন। যা তার নিজের জ্ঞানের পরিধি যেমন উন্মোচন করলো, তেমনি সকলের সামনে একটি ধারণা স্পষ্ট করলো- শিক্ষকতো এমনই হন, এমনই হবেন। তবে এত কিছুর পরেও আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলীর কণ্ঠে বিনয়, ‘আমি শিখছি। আমি আজও শিখছি। আমি আরও শিখবো।’ আমি কখনোই শিক্ষকসুলভ ছিলাম না। কখনো হতেও চাইনি, বললেন তিনি। সবশেষে তিনি পকেট থেকে বের করে আনলেন, ঠিক আগের রাতে লেখা তার আনকোরা এক কবিতা- ‘যাওয়ার সময়’।

‘ক্লাস রুমটা একটু দেখেই যাই
রুম নম্বর ১০৮৮
অনেক স্মৃতি মিশে আছে
হোক না তার অনেক কিছু বাসি’…

সামাজিক মাধ্যমে অধ্যাপক আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী’র সে কবিতা পাঠের ভিডিও শেয়ার করে তার এক শিক্ষার্থী লিখেছেন- স্যারের হৃদয় নিংড়ানো এই শব্দগুলো চেখে জল এনে দিলো। থাকুক না টাইমলাইনে জমা!

গত প্রায় চব্বিশ ঘণ্টায় শত শত শিক্ষার্থীর টাইম লাইনে দুই শিক্ষকের অগ্রায়ণের চিত্র উঠে এসেছে। ফলে সব কিছু এখন অনেকের জানা। আর সেও এক ভালোবাসার প্রকাশ।

কিন্তু মঞ্চে ভালোবাসার প্রকাশ তখনও শেষ হয়নি। অধ্যাপক আহাদুজ্জামানের কথা শেষ হলে সকলে মধ্যাহ্নভোজে গেলেন ঠিকই কিন্তু একটু পরেই মিলনায়তনে ফিরলেন। সেখানে তখন শ্রদ্ধা-সম্মান-ভালোবাসা ও বিনোদনের আরও আয়োজন। গানে-নৃত্যে-বাদ্য ঝংকারে ভরিয়ে তোলা হলো অগ্রায়নের ক্ষণ। এর মধ্য দিয়ে শেষ হলো অনুষ্ঠান। তবে শেষের আগেই, সভাপ্রধান তথা বিভাগীয় প্রধান কাবেরী গায়েন তার ধন্যবাদের পালা শেষ করেন। ধন্যবাদতো দিতেই হবে, কারণ অনুষ্ঠানে যারা ছিলেন, তাদের অনেকেরই মুখে ছিলো একটি কথা- এমনটি আর দেখিনি। যাদের পরিকল্পনায়, পরিশ্রমে আর সর্বোপরি যারা অর্থ সরবরাহ করেছেন তাদের ধন্যবাদ দিতেই হয়।

গোটা অনুষ্ঠানের কথা বললেও অগ্রায়ন নিয়ে কথা বলা শেষ হবে না। যদি না, এ উপলক্ষে প্রকাশিত যোগাযোগ জার্নালটির কথা না বলা হয়। অনুষ্ঠানের শুরুর দিকেই যার মোড়ক উন্মোচনও করা হয়। এই প্রকাশনারও নাম দেওয়া হয়েছে- ‘অগ্রায়ন’। সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক কাবেরী গায়েন ও অধ্যাপক ফাহমিদুল হক। এই প্রকাশনাটি যারা হাতে পেয়েছেন, অর্থাৎ ১০০ টাকা মুল্যে কিনে নিয়েছেন- তারাও প্রায় সকলেই মত দিয়েছেন- অসাধারণ এক প্রকাশনা, যা সাংবাদিকতা বিভাগের সুনামকেই আরও বাড়িয়ে দেবে। এতে স্থান পেয়েছে দুই অগ্রায়িত শিক্ষকের দুটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। আর সাথে সুপাঠ্য ডজন দুয়েক নিবন্ধ। অ্যাকাডেমিক, সেমি-অ্যাকাডেমিক সেসব রচনার মধ্য দিয়েও স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই অগ্রায়ন।

** দুই শিক্ষকের অগ্রায়ন, ঢাবি সাংবাদিকতা বিভাগের মিলনমেলা

** ঢাবি সাংবাদিকতার দুই শিক্ষকের জন্য ‘অগ্রায়ন’

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন