বিজ্ঞাপন

মা যখন কর্মজীবী

May 12, 2019 | 9:08 am

সিরাজুম মুনিরা, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর

ঢাকা: একজন কর্মজীবী মা-আমি। দুই বছর তিন মাস বয়সী সন্তানকে বাসায় তার নানা-নানুর জিম্মায় রেখে রোজ অফিসে আসি ।

বিজ্ঞাপন

আমার অন্য কর্মজীবী বন্ধু বা সহকর্মীরা বলেন, আমি না কি ভীষণ ভাগ্যবান। কারণ বাচ্চাকে গৃহসহকারীর কাছে বা ডে কেয়ারে রাখতে হচ্ছে না। নিশ্চিন্তে অফিস করতে পারছি।

নিশ্চিন্তে!

এটা একটা জটিল শব্দ মনে হয় আমার কাছে। আপনি যেটাকে নিশ্চিন্ত পরিস্থিতি বলছেন সেটা আমার কাছে তেমন নাও হতে পারে। কিংবা আপাতদৃষ্টিতে আমাকে নিশ্চিন্ত মনে হলেও ভেতরে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে  সেইটা একমাত্র আমিই বলতে পারি।

বিজ্ঞাপন

আমার মা-বাবা দুজনেরই বয়স হয়েছে। তারা হাড়ক্ষয়, ডায়াবেটিক, উচ্চ রক্তচাপ, আথ্রাইটিসসহ নানান শারিরীক জটিলতায় ভুগছেন। তারপরেও আর কোনো উপায় না থাকায় তারা আমার চঞ্চল বাচ্চাকে দেখাশোনা করেন। যারা সন্তানপালনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছেন তারা মাত্রই জানেন, এটি কতটা হ্যাপার কাজ।

একটা শিশুর গোসল, খাওয়া, ঘুম, তাকে পরিস্কার করা এগুলো নিঃসন্দেহে ভীষণ কষ্টের কাজ। সেই কাজগুলোই আমার বাবা-মা করে যান শুধু আমাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে চাকরি করতে দেবেন বলে।

তাই আপাতদৃষ্টিতে আমি নিশ্চিন্ত।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু আসলেই কী তাই? আমি বাবা-মায়ের বড় সন্তান। তাদের প্রতি আমার কিছু দায়িত্ব আছে। অথচ তাদের সেবা তো করতে পারছিই না, উল্টো তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছি নিজের সন্তানকে বড় করার ভার। তারা অসুস্থ, ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না, রাতে ঘুম হয় না। অথচ সেই শরীর নিয়েই সারাটাদিন আমার ছেলের পেছনে ছোটেন। ওর দুষ্টুমির সঙ্গে পেরে ওঠেন না। গোটা বাড়ি হেঁটে ভাত খাওয়ান, ডায়াপার পরিস্কার করে দেন, গোসলের সময় ছোটাছুটি করতে থাকা বাচ্চাটাকে ধরে বেঁধে শরীর ডলে ডলে পরিস্কার করিয়ে দেন। সর্দি-কাশিতে রীতিমতো যুদ্ধ করে ওষুধ খাওয়ান।

আমার ছেলে উজান আর তার নানা-নানু

আমি নিজের অক্ষমতায় কেবল হাত কামড়াই আর ‘নিশ্চিন্তে’ অফিস করি। মা অসুস্থ হলেও সহজে ছুটি নিই না, ভাবি বাবা তো আছেন, দুজনে সামলে নেবেন। আমি বরং ছুটিটা বাঁচিয়ে রাখি ছেলে অসুস্থ হলে তখন নেওয়া যাবে ভেবে। মাঝে মাঝে নিজেকে স্বার্থপর মনে হয়। কিন্তু ওই যে, একে কর্মজীবী, তায় আবার মা। তাই শ্যাম রাখি না কুল রাখি সেটা ভাবতে ভাবতেই দিন কাটিয়ে দিচ্ছি। অফিসে এসেও বার বার ফোন করি, ঘুম থেকে উঠলো কি না, ঠিকমতো খেল কি না, পানির পটটা হাতের কাছে আছে কি না ইত্যাদি ইত্যাদি।

পুরো বিষয়টা যে আমার ভেতর কী পরিমাণ অপরাধবোধের জন্ম দেয় সেইটা সম্ভবত কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব না। নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে রীতিমতো ক্লান্ত আমি।

শুধু আমি না কর্মজীবী বেশিরভাগ মা-ই এমন কোনো না কোনো অপরাধবোধে ভোগেন। কেউ হয়ত বাচ্চাকে সময়ের অভাবে শক্ত খাবার খাওয়ানোর অভ্যাস করতে পারছেন না, কেউ পটি ট্রেনিং দিতে পারছেন না, কেউ হয়ত ঘুমের রুটিন ঠিক করতে পারছেন না আবার কেউ হয়তো যথাযথ পুষ্টি নিশ্চিত করতে পারছেন না।

বিজ্ঞাপন

‘২টা বাজলেই আমরা মাথা ঘুরতে শুরু করে’

কর্মজীবী মায়ের মনস্তাত্ত্বিক চাপ নিয়ে কথা হয় একটি বেসরকারি টেলিভিশনের প্রতিবেদক শারমিন নিরার সঙ্গে। তিনি জানান, সম্প্রতি তার স্বামীর ঢাকার বাইরে পোস্টিং হয়েছে। ফলে নিজের অফিস, সন্তানকে ডে কেয়ারে আনা নেওয়া, বাড়ির কাজ সবকিছু তাকে একহাতে সামলাতে হচ্ছে।

নিরার একমাত্র সন্তান অনবদ্য অতল সাধারণত ডে কেয়ারে থাকে। রমজান উপলক্ষে সন্ধ্যা ৬টার বলে বিকেল ৪টায় ডে কেয়ার ছুটি হয়ে যায়। এখন সকালে তাকে ডে কেয়ারে নামিয়ে অফিসে যান নিরা। যেহেতু তিনি প্রতিবেদক তাই তাকে অ্যাসাইনমেন্টে বের হতে হয়। এরপর সেই অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে অফিসে ফিরে প্রতিবেদন তৈরি করে তারপর ছুটি মেলে। ওদিকে সমান তালে চলে ঘড়ি দেখা।

নিরা বলেন, ‘২টা বাজলেই আমরা মাথা ঘুরতে শুরু করে। কখন কাজ শেষ করবো, কখন অফিস থেকে বের হবো আর কখন জ্যাম পেরিয়ে ডে-কেয়ারে পৌঁছে অতলকে পিক করবো।’

মা শারমিন নিরার সঙ্গে অতল

এই মানসিক চাপ কাজের ওপর প্রভাব ফেলছে কি না জানতে চাইলে এই সংবাদকর্মী বলেন, কিছুটা তো পড়েই। তিনি নিজেই বুঝতে পারেন যে শুধু ডে কেয়ারে সময়মতো পৌঁছতে অনেক দ্রুত ছুটতে হয় তাকে। অনেক দ্রুত কাজ সেরে ফেলতে হয়। কিন্তু শত কষ্ট হলেও ছুটে চলেন তিনি। কারণ তিনি জানেন, দিনশেষে ক্যারিয়ারটা তার, তাকেই এটার পেছনে শ্রম দিতে হবে। আবার সন্তান যেহেতু তার প্রথম প্রায়োরিটি তাই দুদিকেই সামাল দিতে হবে। এই কষ্টের শেষ একদিন হবে সেই আশা নিয়েই আপাতত পথ চলছেন নিরা।

কথার ফাঁকে অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর আর চিফ রিপোর্টারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুললেন না নিরা। কারণ এরা যদি সহযোগিতা না করতেন, সুবিধামতো সময় অ্যাসাইনমেন্ট না ফেলতেন তাহলে পথচলা অনেক বেশি কঠিন হয়ে যেত।

‘মাঝে মাঝে ভাবি চাকরি ছেড়ে দেবো’

ব্যাংক কর্মকর্তা ফৌজিয়া আকতার খানের একমাত্র সন্তান আনায়াহ পৃথিবীতে এসেছিল প্রি-ম্যাচিওর শিশু হিসেবে। ফলে তার একটু বেশি যত্ন-আত্তি দরকার ছিল। মেয়ের বয়স এখন পাঁচ। এখনো ফৌজিয়া অপরাধবোধে ভোগেন যে, মেয়েটাকে ঠিকমতো যত্ন নিতে পারেননি। আরেকটু বেশি সময় দিতে পারেননি।

ফৌজিয়া জানান, ছোটবেলা থেকেই তার মেয়ে নানী-খালা বা দাদা-দাদুর কাছে থেকেছে। এটা ঠিক যে কখনোই পুরোপুরি গৃহসহকারী বা ডে কেয়ারের ওপর নির্ভর করতে হয়নি। কিন্তু এটাও ঠিক যে কখন কে এসে থাকবেন সেই হিসাবও করতে হয়েছে।

ফৌজিয়া ও তার মেয়ে আনায়াহ

বিশেষ করে অনেক সময় দেখা যায় কোনো একটা দরকারে ফৌজিয়ার মা বা শ্বাশুড়ি দুজনকেই গ্রামের বাড়িতে যেতে হবে। সেই সময়টা সবচেয়ে কঠিন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তখন যে কী অসহায় লাগে। এমনও হয়েছে আমি আনায়াহকে নিয়েই অফিস করেছি। সবসময় তো ছুটিও নেওয়া যায় না। কখনও ও অসুস্থ হয়ে গেলে আমি আর ওর বাবা পালা করে ছুটি নিয়ে বাসায় থেকেছি। কখনও বা কোনো আত্মীয়ের বাসায় রেখে এসেছি। কিন্তু সেটা করেও শান্তি পাই না, কাজে মন বসে না। কারণ আমার তো মেয়ে শিশু, সেও বড় হচ্ছে। অপরিচিত পরিবেশে ওকে এক ঘণ্টার জন্য রেখেও শান্তি পাই না। মাঝে মাঝে ভাবি চাকরি ছেড়ে দেবো। কিন্তু সেটাও বা কতটুকু যৌক্তিক?’

আবার এই যে তার প্রয়োজনে মা-বাবা কিংবা শ্বশুর-শাশুড়িকে বাধ্য হয়ে ঢাকায় থাকতে হচ্ছে এই বিষয়টাও ভীষণ পোড়ায় ফৌজিয়াকে। তিনি বলেন, ‘সবারই তো নিজের বাড়িতে থাকতে ভালো লাগে। গ্রামের বাড়িগুলো খোলামেলা হয়, অনেকের সাথে দেখা হয়। কিন্তু আমার জন্য তাদের এই শহরে বন্দি থাকতে হচ্ছে। এটা ভাবলে খুব অপরাধী লাগে।’

যেটুকু সময় মেয়ের কাছে থাকেন সেটুকু সময় তার সব আবদার পূরণের চেষ্টা করেন জানিয়ে ফৌজিয়া বলেন, ‘এই যেমন সকালে তার আপেল জ্যুস খেতে মন চাইলো। দিলাম করে। দুই এক চুমুক পান করে রেখে দিল। তবু করে দিতে পারলাম, এটাই শান্তি। ওকে তো প্রি-ম্যাচিউর হিসেবে আরেকটু যত্ন করার দরকার ছিল। চাকরির জন্য সেইটা তো করতে পারিনি। তাই খুব খারাপ লাগে। বুকের মধ্যে একটা ভার চেপে থাকে।’

‘মা, তোমাকে ছাড়া থাকতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে’

লাবণী গুহ রায় চাকরি করেন একটি বেসরকারি টেলিভিশনে। স্বামী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। একমাত্র মেয়ে নন্দিনী থাকে নানা-নানীর কাছে রংপুরে। স্বামী-স্ত্রী যে যখন ছুটি পান ছুটে যান রংপুরে। তবে গণমাধ্যমে তেমন ছুটি মেলে না, তাই মেয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার সময়ের দূরত্ব বেড়ে যায় লাবণীর। তবু যখনই সুযোগ পান মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে যান, ওকে একটু ‘কোয়ালিটি টাইম’ দেওয়ার চেষ্টা করেন বলে জানান তিনি।

কেন মেয়েকে অন্য শহরে রাখতে হয়েছে? জানতে চাইলে গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেন এই সংবাদকর্মী। তিনি বলেন, নন্দিনীর জন্মের প্রথম চারবছর সে তাদের সঙ্গে ঢাকাতেই ছিল। বাসায় ওকে দেখাশোনা করতেন ওর ঠাকুরমা মানে দাদু। একদিন এক দুর্ঘটনায় আহত হন তিনি। চলাফেরার সুবিধার জন্য গ্রামে চলে যান তিনি। মূলত এরপরেই বিপদ শুরু হয় লাবণীর পরিবারে। মেয়ের দেখাশোনার জন্য গৃহসহকারী রাখা হয়েছিল। কিন্তু প্রতিদিনিই ঘটছিলো কোনো না কোনো দুর্ঘটনা।

লাবণী বলেন, ‘একদিন অফিস থেকে ফিরে বাসার কেয়ারটেকারের কাছে জানতে পারি ফ্ল্যাটের ভেতর আটকা পড়েছিল নন্দিনী। পরে কেয়ারটেকার মিস্ত্রি ডাকিয়ে ছিটকিনি কেটে মেয়েকে উদ্ধার করেছে। আরেকদিন বাড়ি ফিরে দেখি চোখ আর মুখের একপাশ ফুলে কালশিটে পড়ে আছে। অন্ধকারে খেলতে গিয়ে টুলে বাড়ি লেগে এই দশা হয়েছে। এদিকে মেয়ের পেট খারাপ লেগেই থাকে, অথচ আমি নিজে হাতে খাবার রান্না করে রেখে আসি। একদিন সময়ের আগেই বাড়ি ফিরে দেখি মেয়েকে খাওয়াচ্ছে গৃহ সহকারী। মেয়ের মুখের থেকে যে খাবার পড়ে যাচ্ছে সেটাও মাটি থেকে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। এসব দেখে আর ঠিক থাকতে পারিনি।’

নন্দিনী, তার দিদু আর মা লাবণী

ঢাকায় থাকলে নন্দিনীর যথাযথ যত্ন হচ্ছিলো না, কারণ লাবণী বা তার স্বামী দুজনেই দিনের বড় একটা অংশ বাড়ির বাইরে থাকেন। আবার চাকরিও ছাড়তে পারবেন না তিনি, তাই দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নন্দিনীকে পাঠিয়ে দেন লাবণীর বাবার বাড়ি রংপুরে। সেখানে লাবণীর মা-বাবা আর ছোটবোন মিলে তাকে বড় করছেন।

মেয়ে রংপুরে পাঠিয়ে প্রথম প্রথম ভীষণ কষ্টে দিন পার করেছেন বলে জানান লাবণী। বললেন, ‘কোনো সামাজিকতা করতাম না, পূজায় যেতাম না, টিপ পরতাম না, সাজগোজ করতাম না, কোথাও গেলে কুঁকড়ে থাকতাম, অস্বস্তি লাগতো। আমরা দুজনেই মন খারাপ করে থাকতাম। আমার স্বামী কিছুটা কঠিন আবরণে জড়িয়ে রাখতেন নিজেকে, কিন্তু আমি রোজ রাতে চোখের পানিতে বালিশ ভেজাতাম।’

মেয়েকে দেখতে রংপুর গেলে সে দূরে দূরে থাকতো, মায়ের কাছে আসতে চাইতো না, অচেনা মানুষের মতো আচরণ করতো জানিয়ে লাবণী বলেন, ‘এখন সেসব দিন পার হয়েছে। এখন সে স্কুলে যায়, স্কুল থেকে ফিরে কোচিং, গানের ক্লাস, বাসার টিচার সব মিলিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। সারাদিনে হয়ত একবার ভিডিও কলে কথা বলার সুযোগ মেলে। দাদু-দিদু আর মণি মার সঙ্গে সে খুব ভালো আছে। এখন তো মণি মা, মানে ওর খালার একটা ছেলে হয়েছে। সেই ছোট ভাইটাকে নিয়েও সে খুব ব্যস্ত থাকে। ফলে আমাদের মিস করার সময় নেই ওর। এখন ও বলে, মা, তোমাকে ছাড়া থাকতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।’

লাবণী বলেন, ‘এখন আগের চেয়ে দুশ্চিন্তমুক্ত আছি এটা ঠিক। কিন্তু মায়ের মনের কষ্ট তো আর কাউকে বোঝাতে পারবো না। সেই কষ্টটা তো শুধুই আমার।’

এভাবেই দেশের অসংখ্য কর্মজীবী মা বুকে পাথর বেঁধে প্রতিদিন সকালে কাজে ছুটে যান। মাথার ভেতর সন্তানের জন্য চিন্তা রেখে সবার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন। শুধু সন্তানকে একটু ভালো ভবিষ্যৎ দেবেন বলে নিজেদের বর্তমানটুকুও বিসর্জন দেন তারা।

সারাবাংলা/এসএমএন

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন