বিজ্ঞাপন

হাতে আসেনি নামের তালিকা, ধান যেন কৃষকের গলার কাঁটা

May 17, 2019 | 8:01 am

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও কৃষকের ঘরে উঠেছে বোরো মৌসুমের শতকরা প্রায় ৬৫ ভাগ ধান। তবে অধিকাংশ জেলায় কৃষকের নামের তালিকা প্রণয়ন কার্যক্রম শেষ করতে পারেনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। ফলে দেশের কোথাও সরকারিভাবে এখনও বোরো মৌসুমের ধান কেনা শুরু হয়নি।

বিজ্ঞাপন

এ নিয়ে কৃষকদের মধ্যে শঙ্কা দেখা দিলেও খাদ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধান এবং চাল কেনা সম্ভব হবে।

ধানের রাজ্যে দামের নৈরাজ্য

খাদ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, চলতি বেরো মৌসুমে ১০ লাখ টন সেদ্ধ চাল, দেড় লাখ টন আতপ চাল ও দেড় লাখ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ২৫ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এই কার্যক্রম চলবে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত।

এবার কেজি প্রতি সেদ্ধ চালের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৬ টাকা। ধানের দাম কেজি প্রতি ২৬ টাকা ধরা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মণ ধান কেনা হবে ১ হাজার ৪০ টাকা দরে।

বিজ্ঞাপন

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কৃষকরা ধান শুকিয়ে বিক্রি উপযোগী করতে করতেই প্রকৃত কৃষকের নামের তালিকা প্রস্তুত হয়ে যাবে।

এবার নওগাঁয় সেদ্ধ চাল কেনা হবে ৬৭ হাজার ৪৮০ টন, আতপ চাল ৪ হাজার ৬১৬ টন এবং ধান ৫ হাজার ৬৩২ টন। জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক জিএম ফারুক হোসেন পাটোয়ারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা চাল কিনতে শুরু করেছি। তবে ধান কেনার প্রক্রিয়া চলছে। আশা করছি, আগামী দুই তিন দিনের মধ্যে ধান কেনা শুরু হবে। কৃষকের নামের তালিকা হাতে না আসায় এই বিলম্ব হয়েছে।’

দিনাজপুরে জমি ভরা ধান, তবু ক্ষতি ৪০০ কোটি টাকা

নাটোরে চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ হাজার ২০৬ টন। আর সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ২ হাজার ১১৫ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলার এক প্রশ্নের জবাবে নাটোর জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি যে ধান কেনা হবে, সেই অর্থ তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেবো আমরা। নামের তালিকা হাতে না আসায় কিছুটা দেরি হচ্ছে। তবে আমাদের সময় আছে। কারণ কৃষকের ঘরে থাকা ধান এখনো কাঁচা, সেগুলো শুকাতেও সময় লাগবে।’

কিশোরগঞ্জ জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ তানভীর হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই জেলা থেকে এ বছর ৪ হাজার ৮৯১ টন ধান সংগ্রহ করা হবে। কৃষকের ঘরের ধান এখনো শুকায়নি, তাই সংগ্রহ শুরু হয়নি। আগে হাওরের জেলাগুলো থেকে সংগ্রহ করা হবে, পরে অন্য জেলাগুলো থেকে।’

একই চিত্র দেখা গেছে সুনামগঞ্জ, টাঙ্গাইলসহ আরও অনেক জেলায়। এদিকে গত মৌসুমের চাল এখনো গুদামে থেকে যাওয়ায় আগ্রহ হারিয়েছেন মিল মালিকরা।

রাবি

ধানের দাম বাড়ানোর দাবিতে মানববন্ধন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, খাদ্যশস্যের সরকারি গুদামগুলোতে বর্তমানে ১২.৩৯ লাখ মেট্রিক টন ফসল মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে ১০.৩৬ লাখ মেট্রিক টন চাল এবং ২.০৩ লাখ মেট্রিক টন গম। মাসিক চাহিদা ও বিতরণ পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই মুহূর্তে খাদ্য শস্যের কোনো ঘাটতি নেই। ঘাটতি হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, চলতি বছর দেশে ৩ কোটি ৮০ লাখ টন চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে বোরো মৌসুমে ২ কোটি টন, আমন মৌসুমে দেড় কোটি টন ও আউশ মৌসুমে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টন চাল উৎপাদন হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সারাদেশে প্রতি বছর সাড়ে ৩ কোটি টন চালের চাহিদা রয়েছে। সেই হিসাবে এ বছর ৩০ লাখ টনের বেশি চাল উদ্বৃত্ত (সারপ্লাস) থাকার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

সরকারের সঙ্গে চুক্তি হলেও চাল সংগ্রহে আগ্রহ পাচ্ছেন না মিল মালিকরা। নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোদ বরণ সাহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে সরকারিভাবে এখনো ধান-চাল কেনা শুরু হয়নি। আমরাও ধান-চাল কিনছি না। আউশ মৌসুমের ধান-চাল গুদামে রয়ে গেছে। একদিকে যেমন গুদামে জায়গা নেই, অন্যদিকে আমাদের বিনিয়োগের অর্থ এখানো উঠে আসেনি।’

একই কথা বললেন কুষ্টিয়ার ভাণ্ডারী রাইসমিলের স্বত্বাধিকারী মাসুদ রানা। বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি কাওসার আলম খান জানান, দেশে বর্তমানে ধান-চালের চাহিদা খুবই কম। রমজানে প্রতি বছরই চালের চাহিদা কম থাকে। ধানের দাম কম থাকার পেছনে এটিও একটি কারণ।

ধানের দাম বাড়ানোর দাবিতে কৃষকরাও বিক্ষোভ করেন রাজধানীতে

এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আরিফুর রহমান অপু সারাবাংলাকে বলেন, সব জায়গায় আমরা এখনো বোরো মৌসুমের ধান-চাল কেনা শুরু করতে পারিনি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর প্রকৃত কৃষকদের নামের তালিকা করে। তারপর সেটা যাচাই-বাছাই করা হয়। সেই তালিকা এখনো আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়নি। তালিকা হাতে এলে আমরা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা শুরু করবো। প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ করতে কিছুটা সময় লেগে যায়। আমাদের লক্ষ্য থাকে প্রকৃত কৃষক যেন উপকৃত হন।

তিনি আরও বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কৃষক ধান শুকিয়ে আনতে পারে না। এটা একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। গত বছর দেড় লাখ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু আমরা সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম মাত্র ৩০ হাজার টন।

এ বিষয়ে কথা বলতে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারকে একাধিকবার কল করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক সারাবাংলাকে বলেন, সরকারিভাবে ধান-চাল কেনা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। কিন্তু এ বছর ১২ লাখ টনের বেশি চাল কেনা যাবে না। কারণ গুদামে জায়গা নেই। তাই এবার আমরা কিছু চাল রফতানির উদ্যোগ নেবো।

রাস্তায় ধান ছিটিয়ে কৃষকের প্রতিবাদ

এর আগেও  দেশ থেকে চাল রফতানি হয়েছে। তবে ২০১৭ সালে হাওরে আকস্মিক বন্যা হওয়ায় ফের চাল আমদানি করতে হয়। গত দুই বছরে দেশে ৬০ লাখ টনের মতো চালের আমদানি হয়েছে।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. এম আসাদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, এই পরিস্থিতি আমরা আগেও দেখেছি। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ধান কেনার ক্ষেত্রে সরকারের উচিত দূরদর্শী পরিকল্পনা হাতে নেওয়া। কৃষকদের কথা বিবেচনায় রেখে পুরো ধান তাদের কাছ থেকে কেনা দরকার। ধান মজুদ রাখার জন্য প্রতি জেলা-উপজেলায় শস্য গুদাম বাড়ানো দরকার। তাহলে কৃষকরা ধান-চাল মজুদ রেখে পরে বিক্রি করতে পারবে এবং সঠিক দাম পাবে।

সারাবাংলা/ইএইচটি/এটি

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন