বিজ্ঞাপন

বাজেটে ‘চাহিদা নেই’ কৃষি মন্ত্রণালয়ের!

June 2, 2019 | 7:59 am

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: প্রতিবছরই বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দের পরিমাণ থাকছে প্রায় অপরিবর্তিত। গত ৭ বছর ধরে চাহিদার ১৫ হাজার কোটি টাকার বৃত্ত ভাঙ্গতে পারেনি কৃষি মন্ত্রণালয়। শুধু তাই নয়, বাজেটে বরাদ্দের পুরোটা ব্যবহারই করতে পারে না তারা। গত কয়েক বছর ধরে তাই কৃষিতে দেওয়া ভতুর্কির ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৩ হাজার কোটি টাকাই ফেরত যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতার কারণেই তৈরি হচ্ছে না নতুন অর্থের চাহিদা। ফলে, বাজেটে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের কৃষি, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষক। কৃষিতে ভর্তুকি ও বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকেই মত তাদের।

বিজ্ঞাপন

বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে কৃষি খাতে বরাদ্দ ছিল ১৪ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে (২০১৮-১৯) এই বরাদ্দের পরিমাণ ১৩ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। আর আগামী অর্থবছরে (২০১৯-২০) খাতটিতে বরাদ্দের পরিমাণ হতে পারে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা। এমনকি মন্ত্রণালয়ের ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রাক্কলিত বাজেটও ১৫ হাজার কোটি টাকার নিচে। সময়কালে ব্যবধানে বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়লে বা কমলেও শতাংশিক হিসেবে বরাদ্দের পরিমাণ গড়ে কমেছেই। তবে মন্ত্রণালয় বলছে, যতোটুকু চাহিদা প্রয়োজন তারা ঠিক ততোটাই পাচ্ছে।

এদিকে, আগামী অর্থবছরে (২০১৯-২০) বাজেটে কৃষি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ৫শ কোটি টাকা বাড়তে পারে বলে জানা গেছে। আর চলতি অর্থবছরের (২০১৮-১৯) শেষ পর্যন্ত ভর্তুকির ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৭ হাজার কোটি টাকা খরচ হতে পারে। ভর্তুকির পুরো অর্থ খরচ করতে না পারায় দীর্ঘদিন ধরেই সমালোচনা রয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের। চলতি বোরো মৌসুমে কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় বিষয়টি আবারও সামনে আসে। কোনো কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে আগামী বাজেটে কৃষিতে ২৬ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেওয়ার দাবি উঠেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুধু সার ও সেচে নয় ভর্তুকির অর্থ সরাসরি কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেওয়া যেতে পারে। তবে, ভর্তুকি বাড়ানোর পক্ষে কোনো মত নেই কৃষি মন্ত্রণালয়ের। বরং ভর্তুকির অব্যবহৃত অর্থ যান্ত্রিকীরণের কাজে ব্যবহারের লক্ষ্য তাদের।

মন্তব্য জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক সারাবাংলাকে বলেন, সারের দাম তো এমনিতেই কম। তাই ভর্তুকির অব্যবহৃত থাকা অর্থ আমরা যান্ত্রিকীকরণের কাজে ব্যবহার করবো। এজন্য আমরা প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নিচ্ছি। নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। অনেক চিন্তা ভাবনা চলছে। আপাতত চলতি অর্থবছরের ভর্তুকির অর্থ যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পসহ অন্য একটি প্রকল্পে খরচ করা হবে।

বিজ্ঞাপন

চাহিদার দিক থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার বৃত্ত ভাঙ্গতে না পারার বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব নাসিরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের যেটুকু প্রয়োজন, যতোটুকো দরকার, আমরা সেটুকুই পাচ্ছি। অর্থাৎ বরাদ্দকৃত অর্থের চেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে না।

ভর্তুকি বাড়ানোর বিষয়ে অনেকের দাবি রয়েছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সচিব বলেন, ভর্তুকি দেওয়া হয় সারে। এটা তো সম্পূর্ণ ফ্রি দিতে পারবো না। যদি সম্পূর্ণ ফ্রি দিতে চাই তাহলেও হয়তো সর্বোচ্চ ৮ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। এখন যে দামে সার বিক্রি হয় অর্থাৎ এর চেয়ে বেশি ভর্তুকি দেওয়া হলে দেশ থেকে সার পাচার হয়ে যাবে। নগদ সহায়তা দেওয়া যেতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশে কৃষককে নগদ সহায়তা দেওয়ার মতো ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। আর প্রণোদনা আরও বাড়ানো যায় কিনা জানতে চাইলে নাসিরুজ্জামান বলেন, আমরা ১২০ কোটি টাকার প্রণোদনা দিচ্ছি। কিন্তু প্রণোদনা মানেই আরও ফলন। উৎপাদন এখন এমনিতেই বেশি। বীজসহ বিভিন্ন উপকরণে আমরা প্রণোদনা দিচ্ছি। ফলে, নতুন করে বাড়তি প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়েও মত নেই সচিবের।

বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে কৃষি খাতে বরাদ্দ ছিল ১৪ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ। পরের কয়েকটি অর্থবছরে শতাংশের হিসেবেও বরাদ্দ কমেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ ধরা হয় ১৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। শতাংশের হিসাবে এ বরাদ্দের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। তথ্য ঘেঁটে জানা গেছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে কৃষিতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল মোট বাজেটের ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ ও ২০১১-১২ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। এদিকে, কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে কৃষিখাতে বরাদ্দের পরিমাণ ১০ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১০ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বরাদ্দের পরিমাণ ১৪ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। এছাড়া, অর্থবছরের শেষ দিকে ৩৫০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ পাওয়ার কথা রয়েছে। আর আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৪ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়ার প্রত্যাশা করছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

বিজ্ঞাপন

কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৯১৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে মন্ত্রণালয় প্রাক্কলিত বাজেটের হিসাব ধরেছে ১৪ হাজার ৩৩১ কোটি ২১ লাখ টাকা ও ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রাক্কলিত বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৭৬১ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

এদিকে, গত কয়েক বছর ধরেই কৃষি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ৯ হাজার কোটি টাকা। এই ভর্তুকির অর্থ শুধুমাত্র সার ও সেচের ক্ষেত্রে দেওয়া হয়। ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ভর্তুকির ৬ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে পারেনি। চলতি অর্থবছরেও ভর্তুকিতে ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। এবারও মাত্র ৬ হাজার কোটি টাকা খরচ হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ কমিয়ে ভর্তুকি ধরা হয় ৮ হাজার কোটি টাকা। এ বিষয়ে কৃষি সচিব নাসিরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, সংশোধিত বাজেটে ভর্তুকির পরিমাণ ৮ হাজার টাকা করা হয়েছে। আমরা ধারণা করছি শেষ পর্যন্ত ৭ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। আগামী অর্থবছরেও ভতুর্কি বাড়ানো হবে না বলেই ধারণা তার।

ভর্তুকি বাড়িয়ে ওই টাকা সরাসরি কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. বারকাত সারাবাংলাকে বলেন, কৃষককে যদি ভর্তুকি কার্ড দেওয়া হয়, কৃষকের ১০ টাকার অ্যাকাউন্ট আছে, ২ কোটি কৃষকের একটি কার্ড থাকতেই পারে। সেই কার্ডের মাধ্যমে তাদের ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে। তাকে যদি ভর্তুকির টাকা দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে সার পাচারের প্রশ্ন আসে কিভাবে। কৃষক যদি ভর্তুকি না পায়, তাহলে পাবে কে? আর শুধু সারে কেন, কৃষকের অ্যাকাউন্টেও তো সরাসরি ভর্তুকির টাকা দেওয়া যায়। এই মুহূর্তে বোরো, সেটার জন্যই কৃষককে ভর্তুকি দেন। খাতটিতে ভর্তুকি এবং বাজেট বরাদ্দ আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলেও মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

মন্তব্য জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিদ হামিদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, কৃষিতে আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন। মাত্র ১৫ হাজার কোটি টাকা কেন, এরচেয়ে বেশি বরাদ্দ থাকা দরকার। গবেষণা ও নতুন কর্মী নিয়োগসহ বিভিন্ন খাতে খরচ বাড়ানোর পক্ষে মত তার। ভর্তুকির বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, খরচ না হওয়া ভর্তুকির ব্যবহার নিয়ে বর্তমানে ভাবা হচ্ছে। আমরা চাই যে টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সেই টাকাই সঠিকভাবে ব্যবহার হোক। আগামী বছরও যেন ভর্তুকির পুরো টাকা সঠিকভাবে ব্যয় হয় সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের চাহিদা না বাড়ার কারণ প্রসঙ্গে হামিদুর বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ এখনও আধুনিক হতে পারেনি। ঠিক সময়ে যেমন বরাদ্দ পাওয়া যায়না তেমনি বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়েও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকে। প্রকল্প বাস্তায়নের দুর্বলতার কারণেই মন্ত্রণালয়ের চাহিদা বাড়ছে না বলে মনে করেন এই কৃষিবিদ।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/ইএইচটি/জেএএম/টিএস

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন