বিজ্ঞাপন

দাদি, আঙুল হারানো রাকীব ও তিন হাজার টাকা

June 8, 2019 | 8:02 am

জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: রাকীবের জন্মের ৪ বছর পর মারা যায় মা, ৬ বছর পর বাবা চলে গেছে চট্টগ্রাম। সেই থেকে রাকীব থাকে দাদির কাছে। রাকীবের দাদি ও দাদির রাকীব, এছাড়া কেউই আর নেই তাদের। আর সম্বল কিশোরগঞ্জের এক প্রত্যন্ত গ্রামে থাকা একটি ঘর। কোনোরকমে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে দুইবেলা খাবার জুটতো তাদের। তাই এক পরিচিতের আশ্বাসে রাকীবকে নিয়ে দাদি চলে আসে গাজীপুরে।

বিজ্ঞাপন

সেখানে বড় আড়তের আশপাশে যেসব সবজি পরে থাকতো সেগুলো কুড়িয়ে আনতো রাকীব আর বাজারের ধারে বসে তা বিক্রি করতো দাদি। এতেই খাবার জুটতো তাদের। ঘর ভাড়া এক হাজার টাকাসহ অন্যান্য সব খরচ মিটিয়ে কোনোরকমে চলে যেত ১২ বছরের কিশোর রাকীব আর ৫০ বছরের হালিমা খাতুনের সাদামাটা দিনগুলো। কিন্তু এতেও বাধ সাধে নিয়তি।

দুই হাতে বিশাল ব্যান্ডেজ নিয়ে রাকীব এখন পঙ্গু হাসপাতালের বিছানায়। আর বৃদ্ধ দাদি তার বেডের পাশে মেঝেতে বসে দিনরাত কেঁদে যাচ্ছেন। চিকিৎসক আর আশপাশের রোগীর স্বজনদের সহায়তায় হাসপাতালেই কেটেছে এই দাদি-নাতির ঈদ। ‘কিন্তু হাসপাতাল থেকে ছাইড়া দিলে আমি ওরে নিয়া কই যামু, কী খামু, ওষুধ খাওয়ামু ক্যামনে, ট্যাকা পামু কই?’—বৃদ্ধ হালিমা বিলাপ করেন। আশপাশ থেকে রোগীর স্বজনরা জড়ো হয় রাকীবের বিছানার পাশে, তারাও চোখ মোছে আর রাকীব কেবল তাকিয়ে থাকে।

বিজ্ঞাপন

চিকিৎসকরা জানান, গত ২২ মে পুলিশ এসে গুরুতর আহত কিশোর রাকীবকে পঙ্গু হাসপাতালে রেখে যায়। তারপর যা যা করার দরকার সব করেছেন তারা। রাকীবের বাম হাতের সবগুলো আঙ্গুল ট্রেনের নিচে কাটা পরে, ডান হাতের আঙ্গুলও নেই কয়েকটা। হাতের অবস্থাও ভালো ছিল না, হিপ ডিজলোকেটেড হয়ে গিয়েছিল বলে জানান তারা।

দাদি হালিমা খাতুন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার অসুখ হইলে আমরা কিশোরগঞ্জ যাইগা। ওই আমারে কইলো, বুবু, আমি ওই জায়গাতে (গাজীপুর) যাইগা। আমি কইলাম, একলা একলা যাইস না। কইলো, এলা কেডা খাওয়াইবো, ওইহানে গেলে আমি একটু কাজ করতে পারতাম। আইছে তো আইছে, ১০ থেকে ১৫ দিন হয়ে যায়, দেহি ছ্যাড়া আর আহে না।’

এরপর এক আত্মীয়’র মাধ্যমে রাকীবের দুর্ঘটনার খবর পেয়ে অসুস্থ শরীর নিয়েই ঢাকায় ছুটে আসেন হালিমা। ‘জিগাইতে জিগাইতে এই জায়গায় আসছি’, বলে চোখে আঁচল দিয়ে কান্না চাপেন তিনি। দুর্ঘটনার চারদিন পর তিনি এখানে পৌঁছান। হালিমা খাতুন বলেন, ‘ডাক্তররা সাহায্য করছে, না করলে এই চিকিৎসা হইতো না। হেরপর ঈদের লেইগা টাকাও দিছে, সেই টাকা দিয়ে গায়ের গেঞ্জি আর পিরান (লুঙ্গি) কিনছে।’

বিজ্ঞাপন

দুর্ঘটনার বিষয়ে রাকীব বলে, ‘সেইদিন ভোরবেলায় বাইপাস সবজির আড়ৎ থেকে রওনা দিছি কিশোরগঞ্জ। কমলাপুর গিয়ে ট্রেনে উঠলাম। বিমানবন্দর স্টেশনে আসার পর ট্রেনটা স্লো করতাছে, দুইজন যাত্রী উঠলো, একজন যাত্রী নামতে গিয়া আমারে ধাক্কা মারলো। একহাতে ব্যাগ ধরে রাখছি আরেক হাতে দরজা। পইরা গেলাম, হাত গেছে গা রেলের ওপর। উঠতে চাইলাম, ডান হাতটা কাইটা গেল, চালু কইরা উঠতে চাইলাম, বাম হাতটাও কাইটা গেল, ট্রেন গেছে গা ততক্ষণে। পরে দুইজনে দেখে আমি পইড়া রইছি। তারপরে এইখানে নিয়া আসে।’

‘ডাক্তাররা রক্ত দিছে, ওষুধ দিছে, আদর করছে’, বলতে বলতে হাতের দিয়ে তাকিয়ে চোখ বেয়ে পানি জমে রাকীবের। জানালো, কিশোরগঞ্জে দাদিকে রেখে এসে গাজীপুর চৌরাস্তায় আসা তরকারির ট্রাকে কাজ করতো সে। বলে, ‘ওই কয়দিনে আমার তিন হাজার টাকা হইছিল। আবার অনেক কিছু কিনছিলাম দাদির জন্য, সব কিছু ছিল ব্যাগের মধ্যে। কিন্তু ব্যাগটা আর পাই নাই।’

রাকীবের চিকিৎসার শুরু থেকে প্রতিটি কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন পঙ্গু হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. শুভ প্রসাদ দাস। ডা. শুভ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সেদিন রাকীবকে হাসপাতালের সামনে পুলিশ রেখে যায়। তারপর ওকে অজ্ঞাত হিসেবে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। এত ছোট ছেলেটার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। দুই হাতের আঙ্গুল, হিপ ডিজলোকেটেড। সব কিছু মিলিয়ে অবস্থা খুবই জটিল ছিল, তার ওপর সঙ্গে কেউ ছিল না।

বিজ্ঞাপন

‘কিন্তু চিকিৎসকরা কোনো কিছুর জন্য থেমে থাকেননি। তারাই অতি দ্রুত রক্ত যোগাড় করেন, হিপ ডিজলোকেশন ঠিক করতে রিস্ক নিয়ে এনেস্থেশিয়া দেওয়া হলো ওকে বাঁচাতে। হাতের ক্ষত ডিব্রাইড করে একটু সেটেল করতে করতে রাত দশটা। নার্স, ওয়ার্ড বয়, ওটি বয় সবাই আমাদের সঙ্গে চেষ্টা করল ছেলেটাকে বাঁচিয়ে রাখার’, বলেন ডা. শুভ।

ডা. শুভ আরও বলেন, ‘সেদিন থেকে ছেলেটা আমাদের কাছে আছে। পরে যদিও তার দাদি এসে উপস্থিত হয়েছে। হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিলেও রাকীবকে বাড়িতে বিশ্রামে থাকতে হবে। আর পুরোপুরি ‍সুস্থ হতে দেড় থেকে দুই মাস লাগবে।’

হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. শাখাওয়াত হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে ছেলেটা ট্রেনে কাটা পড়ে। অজ্ঞাত হিসেবে ভর্তি হলেও তার চিকিৎসায় চিকিৎসকরা সাধ্যের চেয়েও বেশি করেছেন। দুই হাতের কয়েকটি আঙ্গুল কাটা পড়েছে, সেগুলো ফেলে দেওয়া হয়েছে। বাকি হাতে চামড়া লাগানো হয়েছে, আগামীকাল হয়তো ব্যান্ডেজ খোলা হবে।’

বাবা-মা ছাড়া এই ছেলেটার মায়াতে হাসপাতালের সবাই জড়িয়ে গেছে বলেও জানান তিনি।

সারাবাংলা/জেএ/এমও

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন