বিজ্ঞাপন

‘রেকলেস ড্রাইভিং’য়ে ফাঁকা সড়কেও দুর্ঘটনার মিছিল

June 8, 2019 | 10:30 pm

জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ঈদের ছুটির তিন দিনে (ঈদের আগের দিন, ঈদের দিন ও ঈদের পরদিন) ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপতালে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে আসা রোগীর সংখ্যা ছিল ১২২ জন। এর মধ্যে মাথায় আঘাত পেয়ে আসা গুরুতর রোগী ২৮ জন। ঠিক একই সময়ে পঙ্গু হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (নিটোর) সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে আসা রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৭৫ জন। এর মধ্যে ১৪০ জনকে ভর্তি হতে হয়েছে। আর ঈদের দিন থেকে আজ শনিবার (৮ জুন) পর্যন্ত এই হাসপাতালে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে আসা রোগী চারশ ছাড়িয়েছে।

বিজ্ঞাপন

প্রতিবছর ঈদের ছুটির এই সময়টিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। ফাঁকা সড়কেও কেন এত দুর্ঘটনা ঘটে— এমন প্রশ্নের জবাবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাস্তা ফাঁকা থাকলেও বিরামহীন গাড়ি চালানো, চালকদের মাদক সেবন, গতি প্রতিযোগিতা, ছোট গাড়িতে ওভারটেক করার প্রবণতা এবং সর্বোপরি চালকদের ‘রেকলেস ড্রাইভিং’ দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। আবার এই সময়টিকে চালক ছুটিতে থাকায় মালিক বা তার সন্তান গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। আবার মোটরসাইকেল চালকরা এই সময় এসে হেলমেট না পরায় দুর্ঘটনায় পড়লে ভুগতে হচ্ছে বেশি।

ঈদের ছুটিতে সারাদেশে দুর্ঘটনার মিছিল

শুক্রবার (৭ জুন) দুপুর ১২টার দিকে কক্সবাজার জেলার চকরিয়ার ইউনিক পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় প্রাণ হারান মাইক্রোবাসের দুই যাত্রী, আহত হন আরও পাঁচ জন। একই দিনে, দুপুর পৌনে ১টার দিকে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভের নোয়াখালীপাড়া এলাকায় পিকআপ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পরলে তিন জন মারা যান, আহত হন আরও ১০ জন।

বিজ্ঞাপন

দুর্ঘটনা

ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান চার জন

এর আগে, ঈদের দিন (৫ জুন) রাতে ঢাকার ধামরাইয়ে বাসের ধাক্কায় এক প্রাইভেট কার চালক মারা যান। এদিন দুপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় নরসিংদীতে তিন জন ও সকালে আরও এক দুর্ঘটনায় ফরিদপুরে সড়কে প্রাণ হারান চার জন।

বিজ্ঞাপন

ঈদের আগের দিনও (৪ জুন) বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটে সারাদেশে। এর মধ্যে ঘরমুখী মানুষদের গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া একটি সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়লে চার জনের মৃত্যু হয়। এদিন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশে আলাদা সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় দু’জনের। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার উপজেলার তারাবো পৌরসভার কর্নগোপ এলাকায় বাসের ধাক্কায় হিউম্যান হলারের (লেগুনা) চার যাত্রীর মৃত্যু হয়।

এর বাইরেও বেশকিছু সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন আরও অনেকে, আহত হয়েছেন শতাধিক।

ফাঁকা রাজধানীতেও দুর্ঘটনা কম নয়

ট্রাফিক পুলিশ বলছে, ঈদের তিন দিনের ছুটিতে রাজধানী ঢাকার সড়কেও ঘটেছে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা। রাজধানীর বিজয় সরণি, মহাখালী, উত্তরা, কল্যাণপুর, মিরপুর ও শাহবাগ এলাকায় বেশ কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে বিজয় সরণি ও উত্তরায় দুই প্রাইভেট কারের মধ্যে সংঘর্ষ, মিরপুর-১১-তে সিএনজিকে বাসের ধাক্কা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বাকি দুর্ঘটনাগুলো মোটরসাইকেলের।

বিজ্ঞাপন

মিরপুরের পল্লবীতে বাসের আঘাতে দুমড়ে-মুচড়ে যায় সিএনজি

উত্তরা ট্রাফিক পুলিশের সহকারী কমিশনার জুলফিকার জুয়েল সারাবাংলাকে বলেন, সড়ক ফাঁকা আর চালক ছুটিতে থাকায় মালিক নিজেই দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে গেলে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটছে। আবার মোটরসাইকেল চালকরাও সড়ক ফাঁকা পেয়ে বেপরোয়া গতিতে ছুটছেন। ঈদের আগেও যারা নিয়মিত হেলমেট পরতেন, এখন তারা হেলমেট ছাড়াই মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন। বেপরোয়া গতিতে যারা গাড়ি চালাচ্ছেন, তাদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। গত কয়েকদিনে কেবল উত্তরা জোনেই বেপরোয়া গাড়িচালনার কারণে দুই শতাধিক মামলা ও জরিমানা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

ফাঁকা সড়কে কেন এত দুর্ঘটনা?

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্য অনুযায়ী, শতকরা ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী নিয়ন্ত্রণহীন গতি দায়ী, ৩৭ শতাংশের জন্য দায়ী চালকের বেপরোয়া মনোভাব। এআরআই আরও জানায়, দেশে মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪৩ শতাংশই ঘটে মহাসড়কে। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন বলছে, ফাঁকা রাস্তায় অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালান চালকরা, বাংলাদেশের মহাসড়কে যে গতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৭০ মাইল (১১২ কিলোমিটার) পর্যন্ত উঠে থাকে। এমন লাগামহীন গতি আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবই কাল হয়ে দাঁড়ায় বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, “দুর্ঘটনার মূল কারণ ‘রেকলেস ড্রাইভিং’। চালকদের মধ্যে বেপরোয়া মনোভাব থাকে, তাতে গতি নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এই ‘রেকলেস ড্রাইভিং’ কমনো গেলে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেক কমে যেত।”

ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনার প্রসঙ্গে ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, ঈদের সময় এই বেপরোয়া মনোভাব আরও বেড়ে যায়। অনেক চালক তো মাদকাসক্ত, এই সময়ে মাদক সেবনের মাত্রাটাও বেড়ে যায়। আবার ঈদের সময় বিভিন্ন কারণে ট্রাফিক সিস্টেমটাও কিছুটা শিথিল থাকে বলে মনে হয় আমার। ফলে চালকরা একটা মুক্ত রাজ্য পেয়ে যায়।

অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম মনে করেন, নিজের প্রাণসহ কত মানুষের প্রাণ নিয়ে একজন চালককে গাড়ি চালাতে হয়— এই বিষয়টি তাদের বোঝাতে হবে। তাদের মধ্যে দায়িত্বজ্ঞান তৈরি করতে হবে।

এআরআই পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, মূলত ক্ষতিপূরণ দেওয়া বা পাওয়ার সুযোগ নেই বলে চালকরা দায়িত্বশীল হন না। তাদের প্রশিক্ষণেরও তেমন ব্যবস্থা নেই। আবার আইনের প্রয়োগ নেই বলে তাদের মধ্যে বেপরোয়া মনোবৃত্তি বেশি দেখা যায়। তাতে করে দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ে।

জানতে চাইলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, পুলিশ মহাসড়কে গাড়ি থামায় কেবল মাদক রয়েছে কি না— তা তল্লাশি করতে। এর বাইরে তারা আর তেমন কিছু করে না। হাইওয়ে পুলিশ যদি লাগামহীন গতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করত, তাহলে দুর্ঘটনা কিছুটা হলেও কমে আসত।

সারাবাংলা/জেএ/ইউজে/টিআর

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন