বিজ্ঞাপন

বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ বিএমএ, চিকিৎসকদের ক্ষোভ

June 22, 2019 | 5:38 pm

জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: প্রায়ই দেশের বিভিন্নস্থানে চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার অভিযোগে রোগীর স্বজনরা চড়াও হন চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। কিছুদিন পরপরই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটে চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা।

বিজ্ঞাপন

এসব ঘটনায় সবচেয়ে শক্ত অবস্থান নেওয়ার কথা চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ)। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসক নিগৃহীত হওয়ার ঘটনায় সংগঠনটিকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

এসব বিষয় নিয়ে সারাবাংলার  এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে। তারা বলেন, সম্প্রতি ভারতে একজন চিকিৎসককে নিগৃহীত করার ঘটনায় পুরো দেশের চিকিৎসকরা প্রতিবাদ করেছেন, তার পাশে থেকেছেন। অথচ বাংলাদেশে নিগৃহীত চিকিৎসকদের পাশে না থাকেন চিকিৎসক নেতারা, না থাকে সংগঠন।

সবশেষ গত বুধবার (১৯ জুন) রাতে বরগুনা সদর হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের হামলার শিকার হন মেডিকেল অফিসার ডা. মশিউর রহমান। তিনি সারাবাংলাকে জানান, প্রায় এক মাস আগে এই হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করেন তিনি। গত বুধবার রাত পৌনে ১২টার দিকে  একজন মৃত রোগীর স্বজনরা চড়াও হন তার ওপর।

বিজ্ঞাপন

ডা. মশিউর রহমান জানান, প্রথমে তার কক্ষেই শার্টের কলার টেনে ধরা হয়। তারপর তাকে রুম থেকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মারধোর করা হয়। এ ঘটনায় শুক্রবার (২১ জুন) বরগুনা সদর হাসপাতালে তিনি মামলা করেছেন। মামলায় মৃত রোগীর ভাই সবুজের নাম উল্লেখ করে আরও অজ্ঞাত পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়রি করেছে।

হাসপাতালটির একটি সূত্র জানিয়েছে, ঘটনার দিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে বমি ও খিঁচুনি নিয়ে সেখানে চিকিৎসার জন্য যায় ১৫ বছরের কিশোর আব্দুল্লাহ। এসময় ভর্তির পরপরই তার চিকিৎসা শুরু করা হয়। স্বজনরা জানান, হাসপাতালে নেওয়ার পথেও সে বমি করেছে। চিকিৎসার অংশ হিসেবে তার স্যালাইন চলছিল। এ পর্যায়ে অবস্থা খারাপ হওয়ায় চিকিৎসককে ডেকে নিয়ে যায় স্বজনরা। কিশোরটির খিঁচুনি হচ্ছিল, স্যালাইন চললে কিছুক্ষণপর খিঁচুনি কমে যাবে স্বজনদের জানান ডা. মশিউর।

কিছুক্ষণ পর রোগী আব্দুল্লাহকে দেখতে যান ওই চিকিৎসক। সেসময় গিয়ে তিনি দেখতে পান, কিশোরটি এরইমধ্যে মারা গেছে। তখন তিনি তাকে মৃত ঘোষণা করে চলে যান।

বিজ্ঞাপন

এরপরই রোগীর স্বজনরা ডা. মশিউরের কক্ষে গিয়ে প্রথমে মারমুখী ভঙ্গিতে কথা বলতে থাকেন। পরে একজন তার শার্টের কলার ধরে মারতে উদ্যত হন, পাশে থাকা টুল উঁচিয়ে তাকে মারার চেষ্টা করেন। পরে সবাই মিলে তাকে মারতে মারতে ওই কিশোর যে ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছিল সেখানে নিয়ে যান এবং সবাই মিলে মারধোর করেন।

এক পর্যায়ে অন্য রোগীদের স্বজনরা ওই চিকিৎসককে উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত বিএমএ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে জানান ডা. মশিউর।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের একাধিক অধ্যাপক পদমর্যাদার চিকিৎসক সারাবাংলাকে বলেন, বরগুনা ইস্যুতে চিকিৎসক নিজে বাদী হয়ে মামলা করেছেন। কিন্তু এ ঘটনায় চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ সংগঠন বিএমএ এখন পর্যন্ত কিছু করেনি। একেরপর এক চিকিৎসক নিগৃহের ঘটনায় তারা কেবল বিবৃতি ইস্যু দিয়েই খালাস।

চিকিৎসকদের অধিকার বিষয়ে সবসময় সোচ্চার থাকেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নোমান খালেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন পরপরই চিকিৎসকরা রোগীর স্বজনদের কাছে মার খাচ্ছে। কতিপয় রাজনৈতিক নেতাদের কাছে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। সরকার দুর্গম ও গ্রামীণ এলাকায় মানুষের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকদের পাঠাচ্ছে, এটি শুভ উদ্যোগ। কিন্তু সেখানে চিকিৎসকরা প্রতিনিয়ত নিগৃহীত হচ্ছেন, নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তাদের কর্মস্থলের পরিবেশের কোনো নিরাপত্তা নেই। চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন হিসেবে বিএমএ কর্মপরিবেশ সৃষ্টির প্রচেষ্টা নিতে আমাদের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়ত্ব পালনে নির্লিপ্ত, ক্ষেত্র বিশেষে ব্যর্থ। এর আগেও যেসব ঘটনা ঘটেছে তাতে আমরা দেখেছি যে বিএমএ কেবল একটি বিবৃতি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে, যেটা কোনোভাবেই উচিত না।’

বিজ্ঞাপন

কয়েকজন তরুণ চিকিৎসক বলেন, মাশরাফি ও আড়ং ইস্যুতে চিকিৎসকরা ফেসবুকে যত কথা বলেছেন, তার দশভাগের একভাগও বরগুনার এই চিকিৎসক নির্যাতনের বিষয়ে বলেননি। চিকিৎসকরা নিজেরাই অধিকার নিয়ে সচেতন নন বলে মনে করেন তরুণ এই চিকিৎসকরা। তারা বলেন, সব মিলিয়ে বিএমএ, স্বাচিপ (স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ), হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন-সব কিছুর ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। এরা যদি চিকিৎসক সুরক্ষা আইন এর জন্য মাঠে না নামে তাহলে তাদের বয়কটও করবেন তারা।

এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএমএ-র মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, বিষয়গুলো নিয়ে শনিবারই (২২ জুন) রাতে তাদের বৈঠক করার কথা রয়েছে।

বিভিন্ন ঘটনার পর বিএমএ’র প্রতি চিকিৎসকদের ক্ষোভ তৈরি হয়েছে জানালে ডা. এহতেশামুল বলেন, ‘আমরা জানি, তারা প্রচণ্ড সংক্ষুদ্ধ। কিন্তু আমরা কী করবো? যেসব জায়গায় এ ধরণের ঘটনা ঘটেছে তারা সেসব জায়গায় মামলা করেছে, কোথাও কোথাও আসামি আটক হয়েছে। প্রশাসন তো বলবে যে, তারা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছে, এখন আইন তার নিজের পথে চলবে। সেখানে আমাদের কী করার আছে?’

সারাবাংলা/জেএ/এসএমএন/জেডএফ 

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন