বিজ্ঞাপন

মেয়ে, তোমার বুদ্ধি কম!

June 26, 2019 | 12:33 pm

তিথি চক্রবর্তী

লাকি আক্তার (৪২) গৃহিণী। স্বামী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে কাজ করেন। এক বিকেলে তাদের বাসায় জমেছিল পারিবারিক আড্ডা। একপর্যায়ে আড্ডার বিষয় হয়ে উঠল রাজনীতি। লাকি আক্তারকে অনেকক্ষণ চুপ থাকতে দেখে জানতে চাইলাম, ‘আপা, চুপ করে আছেন যে?’ তার স্বামী সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলেন, ‘আরে এইসবের কিছু বোঝে নাকি ও?’ উত্তরে বললাম, ‘বুঝবে না কেন?’ তিনি বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বললেন, ‘কী যে বলেন! বরং ওকে জিজ্ঞেস করেন, চাল সেদ্ধ হতে কতক্ষণ লাগে, মাংসে কী কী মশলা দিতে হয়? হা হা হা।’

বিজ্ঞাপন

লাকি আক্তারের মতো এমন অনেকেই আছেন, যাদের চলতে-ফিরতে প্রায়ই শুনতে হয়, ‘মেয়েদের বুদ্ধি কম’, ‘মাইয়া মানুষের আবার বুদ্ধি!’ অনেকেরই বদ্ধমূল ধারণা— রাজনীতি, অর্থনীতি, গণিত, বিজ্ঞানের মতো জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখাগুলো নারীর জন্য নয়। কলা, মানবিক আর গার্হস্থ্য জ্ঞান থাকাটাই নারীর জন্য যথেষ্ট। সন্তান উৎপাদন আর ঘর সামলানোর ‘মূল কাজ’টুকু নারী পারলেই হয়। বিপরীতে পুরুষকে হতে হবে প্রখর যুক্তিবাদী ও সূক্ষ্মচিন্তার অধিকারী। সৃজনশীল সব কাজে থাকবে পুরুষেরই অংশগ্রহণ।

নারী-পুরুষের বুদ্ধিমত্তা ও যোগ্যতা নিয়ে এমন বিপরীতমুখী ধারণার পেছনে কী আছে? এর পেছনে দায় কি সমাজের? নাকি বৈজ্ঞানিক চিন্তাপদ্ধতির?

জ্ঞান-বিজ্ঞানে নারীরা কি পিছিয়ে?

বিজ্ঞাপন

ইরানে নারী স্বাধীনতা সে অর্থে নেই। সেখানে নারীর যোগ্যতাকে নানাভাবে দমন করা হয়। সেই দেশেরই নারী গণিতবিদ মরিয়ম মির্জাখানি গণিতের নোবেল হিসেবে খ্যাত সর্বোচ্চ সম্মানজনক পুরষ্কার ‘ফিল্ডস পদক’ পেয়েছেন ২০১৪ সালে। এ ঘটনা শুধু ইরান না, সারাবিশ্বের মানুষের সামনে একটি বার্তা রেখে গেছে— নারীর মেধাকে খাটো করে দেখা অন্যায়।

একশ বছর আগে ফিরে যাই। পোলিশ বিজ্ঞানী মেরি কুরি (মাদাম কুরি নামে পরিচিত) ১৯০৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে পেলেন নোবেল পুরস্কার। আট বছর পর ১৯১১ সালে তিনিই আবার নোবেল পেলেন রসায়নে। এরপর এখন পর্যন্ত আর কোনো বিজ্ঞানীই বিজ্ঞানের দুই শাখায় নোবেল পাননি, যা একশ বছর আগে অর্জন করে গেছেন মেরি কুরি। পরে ১৯৩৫ সালে তার মেয়ে ইরিন জোলিয়েট কুরিও আর্টিফিসিয়াল রেডিও এক্টিভিটি আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরষ্কার পান।

বিজ্ঞাপন

আরও দেড় হাজার বছর পেছনে চতুর্থ শতাব্দীতে ফিরে যাই। সে সময় নারী শিক্ষার কথা কল্পনাও করা যেত না। ওই সময় মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক ও গণিতজ্ঞ হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন একজন নারী— হাইপেশিয়া। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, তিনি শুধু ওই সময়ের সেরা গণিতজ্ঞ নন, ছিলেন একজন ‘মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী’।

কালে কালে দেশে দেশে হাইপেশিয়া, মাদাম কুরি বা মরিয়ম মির্জাখানির মতো নারীদের উপস্থিতি দুর্লভ নয়। নিজ নিজ যুগে সব ধরনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করেই তারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন ইতিহাসের পাতায়। এমন নারীর সংখ্যা আমাদের দেশেও কম নয়। তা সত্ত্বেও মেয়েদের জ্ঞান ও যুক্তি-বুদ্ধির ক্ষমতা সীমিত বলেই প্রচার করে থাকেন একদল মানুষ।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেয়েরা অঙ্ক-বিজ্ঞান, দর্শন-রাজনীতি-অর্থনীতি বোঝে না বলে অনেকেই মন্তব্য করেন। অথচ ঠিক এখনো যদি দেখা যায়, অনেক মেয়েই গণিত অলিম্পিয়াডে চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে। পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে দেখা যাচ্ছে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে ভালো ফল করছে। অনেক নারী বিজ্ঞানী আমরা পাচ্ছি। সব ধরনের সৃজনশীল কাজেও এখন নারীদের সমান অংশগ্রহণ দেখা যায়। তবে সমাজ পুরুষতান্ত্রিক বলেই নারীদের অবমাননা করা হয়, অনেক কাজেরই স্বীকৃতি দিতে চায় না।’

বিজ্ঞান কী বলে?

বিজ্ঞাপন

পরিবার ও সমাজ তো বটেই, শিক্ষাব্যবস্থাও অনেক শিশুকে নানা ধরনের পশ্চাৎপদ চিন্তার আদলে গড়ে তোলে। ফলে নারীকে যোগ্য ভাবার মানসিকতা ছোটবেলা থেকেই গড়ে ওঠে না। এটা তো হরহামেশাই বলা হয়, ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মস্তিষ্ক ছোট। তাই তারা যুক্তি-বুদ্ধিতে পিছিয়ে। অথচ গবেষণা কিন্তু বলছে ভিন্ন কথা।

ইউনির্ভাসিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার একদল গবেষক Neurosexism বা মস্তিষ্কের লৈঙ্গিক পার্থক্য নিয়ে একটি গবেষণা করেন। গবেষণায় ২১ জন পুরুষ ও ২৭ জন নারীর মস্তিষ্কে ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং বা এমআরআই পরীক্ষা চালানো হয়। এতে দেখা যায়, নারী-পুরুষের মস্তিষ্কের গঠনে উপাদানগত কোনো পার্থক্য নেই। তবে অধিকাংশ নারী যেহেতু আকারে পুরুষের তুলনায় ছোট, ফলে তাদের মস্তিষ্কের আয়তনও ছোট। গবেষণায় আরও উঠে আসে, মানব শিশু যখন ছোট থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়, তখন সামাজিকীকরণের মাধ্যমে নারী-পুরুষ সম্পর্কিত ইতিবাচক বা নেতিবাচক ধারণাগুলো গড়ে ওঠে।

বিজ্ঞান বলছে, নারী-পুরুষের মস্তিষ্কে গঠনগত উপাদানে পার্থক্য নেই

জার্মানির ইয়ুলিশ শহরে একদল বিজ্ঞানী মানুষের মস্তিষ্কের কাঠামো নিয়ে গবেষণা করেন। এই গবেষণায় দেখা গেছে, দুই লিঙ্গের মস্তিষ্কে কার্যত কোনো পার্থক্য নেই। নারীর চেয়ে পুরুষের মস্তিষ্ক উন্নত, এমন কোনো প্রমাণ পাননি এই গবেষকরা।

তবে যুক্তরাজ্যের সাম্প্রতিক একটি গবেষণা খুবই আকর্ষণীয়। সেখানে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল মনোবিদের যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, নারীর বুদ্ধিমত্তাকে পছন্দ করেন সব পুরুষই। তবে অধিকাংশ পুরুষ চান না তাদের স্ত্রী বুদ্ধিমতী হোক। এজন্য বুদ্ধিমতী নারীকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে আগ্রহী নন পুরুষেরা। এমনকি বুদ্ধিমান নারীকে পুরুষরা ‘নারী’ হিসেবেও মানতে নারাজ বলে উঠে এসেছে এই গবেষণায়।

মস্তিষ্কের লৈঙ্গিক পার্থক্যের ধারণা কি তবে সামাজিক?

বৈজ্ঞানিক গবেষণা দেখাচ্ছে, নারী-পুরুষের মস্তিষ্কের গঠনগত উপাদানে কোনো পার্থক্য নেই। তাহলে নারীর মেধাকে কেন খাটো করে দেখা হয়?

জানতে চাইলে শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, ‘শুরুতে নারীই ছিল পরিবারের প্রধান। একসময় নারীকে পরিবারের মধ্যে আবদ্ধ করার চেষ্টা শুরু হলো। একে কে বলা যায়, Gender division of labour। নারী গৃহবন্দি হলো। ঘরের কাজ হলো নারীর। বাইরের জগতের সঙ্গে যেহেতু নারীর চলাফেরা ও যোগাযোগ কমে গেল, ফলে নারীর জানা-বোঝার পরিধিও সীমাবদ্ধ হয়ে গেল। সেই সুযোগটা নিল পুরুষ। জ্ঞানার্জনের সুযোগ নিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে থাকল। আর মেয়েরা গৃহস্থালীর কাজেই নিজেকে জড়িয়ে ফেলল। এভাবে পুরুষ এগিয়ে গেল। আর নারীদের সম্পর্কে ক্রমেই ধারণা তৈরি হলো— তাদের বুদ্ধি কম। প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধিতে নারীরা পিছিয়ে নেই, নারীর এমন আখ্যা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নির্মাণ।’

নারী-পুরুষ কত দূরে যেতে পারে, তার একটি সীমারেখা তৈরি করে দেয় সমাজ। এজন্য একই পরিবারে মেয়েকে পড়ানো হয় মানবিক বিভাগে, আর ছেলেকে বিজ্ঞান বিভাগে। ছেলের জন্য নামকরা গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা থাকে, সংসারে টানাপোড়েন থাকলেও ছেলের পড়ালেখায় কম খরচের বিষয়টি ভাবতেও পারেন না মা-বাবা। অথচ মেয়েদের পড়ালেখায় উৎসাহটুকুও থাকে না। পড়ালেখা করিয়ে লাভ কী, বিয়ে হলে তো পরের ঘরেই যাবে— এই ধারণাটি এতই ব্যাপকভাবে বিস্তৃত যে অনেক মেয়েকে পড়ালেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় কেবল এই যুক্তিতেই। ফলে এমন মেয়েদের নিজেদের মেধা বিকাশের কোনো উপায়ই থাকে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আফসানা ইসলাম বলেন, ‘নারীকে খাটো করে দেখার প্রবণতা সংস্কৃতিগতভাবেই নির্মিত। পুরুষের মতো সুযোগ পেলে অনেক নারী নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগাতে পারতেন। কারণ মস্তিষ্কের সক্ষমতায় নারী-পুরুষ সমান। কিন্তু নারীকে এই ক্ষমতা কাজে লাগাতে দেওয়া হয় না।’

ঢাবি’র এই অধ্যাপক আরও বলেন, অনেক নারী বুয়েটে বা অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদায়লয়ে পড়ালেখা করে প্রকৌশলী হচ্ছেন। এই সুযোগ অনেকে পেলেও অধিকাংশ মেয়েই পান না।

আবার, সমাজ নারীকে এমন পেশায় যেতে বাধ্য করে, যে পেশায় তথাকথিত ‘নিরাপত্তা’ থাকে। এতে করে অধিকাংশ নারী বাধ্য হন শিক্ষকতা কিংবা নার্সিংকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে। সুতরাং লৈঙ্গিক পার্থক্যের যে ধারণা, সেটা সামাজিকভাবে নির্মিত বলে মনে করেন আফসানা ইসলাম।

সক্ষমতায় নারীই এগিয়ে

মস্তিষ্কের গঠন নিয়ে সামাজিক ধারণার কথা তো আগেই বলা হয়েছে। এর বাইরেও অনেকেই আছেন, যারা শারীরিকভাবেও নারীকে পুরুষের তুলনায় দুর্বল ভাবেন। অথচ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নারীদের টিকে থাকার সক্ষমতা কখনো কখনো যে পুরুষের চেয়েও বেশি— সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে এমন তথ্য।

গবেষণায় দেখা গেছে, শারীরবৃত্তীয় কারণে নারী-পুরুষের ক্ষমতার পার্থক্য হয়ে থাকে। পিরিয়ড ও সন্তান ধারণের ক্ষমতা কেবল নারীরই আছে। এই দু’টি সময়ে নারী শরীরকে চরম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হলেও প্রকৃতিগতভাবেই সেটা সহ্য করার সক্ষমতা নারীর রয়েছে। এজন্য যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে পুরুষের চেয়ে নারীর টিকে থাকার ক্ষমতা বেশি বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা।

পার্থক্য নারী-পুরুষে নয়, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে

ব্যক্তিভেদে মেধার পার্থক্য হয়, তা নারী-পুরুষে, নারীতে-নারীতে কিংবা পুরুষে-পুরুষেও হতে পারে। একেকজন ব্যক্তি একেক ক্ষেত্রে যোগ্য ও দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন। যেমন— কেউ হয়তো পড়ালেখায় ভালো না, কিন্তু খুব ভালো ছবি আঁকেন। কেউ হয়তো আবার সাহিত্যে স্বচ্ছন্দ নন, কিন্তু গণিতে পারদর্শী। কেউ কেউ আবার একাধিক বিষয়ে সমানভাবে দক্ষ।

এ প্রসঙ্গে আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী হাওয়ার্ড গার্ডনারের তত্ত্ব উল্লেখ করা যেতে পারে। The theory of multiple intelligence তত্ত্বে তিনি দেখিয়েছেন, মানুষের বুদ্ধিমত্তা বা জ্ঞান ৯টি ক্ষেত্রে থাকতে পারে— সংগীত, প্রকৃতি, অস্তিত্ববাদ, গণিত, অন্তঃব্যক্তিক, আন্তঃব্যক্তিক, শারীরবৃত্তীয় উপলব্ধি, ভাষাগত ও স্থানগত। হাওয়ার্ড গার্ডনার দেখান, ব্যক্তিভেদে বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি আগ্রহও ভিন্নরকম হয়। যারা আগ্রহ যে বিষয়ে, নিজের জীবনে তিনি সেটিই গুরুত্ব দিয়ে দেখেন। হাওয়ার্ডের গবেষণাতেও স্পষ্ট, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় দক্ষতা ও যোগ্যতার পার্থক্য হয় ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে, এর সঙ্গে নারী-পুরুষের কোনো সম্পর্ক নেই। আর তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন খাতেই নারীদের দাপুটে বিচরণেও।

শাসনকাজে নারী

লেখার শুরুতেই যে উদাহরণটি টানা হয়েছে, সেটি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিরল নয়। লাকি আক্তারের স্বামীর মতো অনেকের দেখাই মিলবে যারা মনে করেন, রাজনীতি-অর্থনীতির মতো বিষয় মেয়েদের জন্যই নয়। প্রশাসনিক বা শাসন কাজে নারীদের দেখতে তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত নন। অথচ সেই প্রাচীনকালেও যেমন নারীরা দেশ পরিচালনা করেছেন, করছেন এখনো।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, রাজিয়া সুলতানা ভারতবর্ষের প্রথম নারী সেনাপতি। প্রচণ্ড মেধাবী, পরিশ্রমী আর বুদ্ধিমতি রাজিয়ার ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির প্রতি আগ্রহ ছিল প্রবল। বাবা ইলতুৎমিশ তাই মৃত্যুর আগে তার কোনো ছেলে নয়, মেয়ে রাজিয়ার ওপরই দিয়ে যান দিল্লির মসনদের ভার।

বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে দেখতে পাই, ২১ জন নারী দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন নিজ নিজ দেশকে। সম্প্রতি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে টেরিজা মে সরে না দাঁড়ালে সেই সংখ্যাটি হতো ২২। বলা হচ্ছে, সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশে রেকর্ডসংখ্যক নারীরা নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন, যা বৈশ্বিক রাজনীতির চেহারা পাল্টে দিচ্ছে।

সম্প্রতি মেক্সিকোর নির্বাচনে দেশটির পার্লামেন্টে দু’টি কক্ষেই সংসদ সদস্য হিসেবে নারী-পুরুষ সংখ্যায় প্রায় সমান। স্পেনের মন্ত্রিসভায় তো পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যাই বেশি।

এদিকে, সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় মা হয়েছেন, কিন্তু দায়িত্ব পালনে কোনোভাবেই পিছিয়ে যাননি— এমন উদাহরণও আছে। পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো ও নিউজিল্যান্ডের জেসিন্ডা আরডার্ন প্রধানমন্ত্রীর মতো পদে থেকেও মা হয়েছেন। শারীরিক, মানসিক— কোনো বাঁধাই তাদের পথ রুদ্ধ করতে পারেনি। তবু নারী মানেই কারও কারও কাছে সক্ষমতার প্রশ্ন।

কেন তবে পিছিয়ে নারী?

মানবসভ্যতার শুরুতে সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। সেই সমাজ ভেঙে গেছে অনেক আগেই, নারী হয়েছে গৃহবন্দি। কৃষি, শিল্প পেরিয়ে আমরা এখন পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক সমাজের অংশ, যেখানে সবকিছুর পেছনেই রয়েছে ব্যক্তিমালিকানা। তবে এই পুঁজিবাদী সমাজের পত্তনের সময় উচ্চারিত হয়েছিল সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার স্লোগান। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে নারীরা ঘর থেকে বের হয়েছিলেন, ধর্মের বিধিনিষেধও অনেকটা আলগা হয়েছিল। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নারী স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারেনি। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার চর্চা সমাজে এমনভাবে জেঁকে বসল যে নারীকে গণ্য করা হলো ভোগের বস্তু ও সন্তানধারণের যন্ত্র হিসেবে।

এখন অনেক নারীকেই জীবিকার প্রয়োজনে বের হতে হচ্ছে ঘর থেকে। অনেক ক্ষেত্রে পুরুষই হয়তো নিজের দায়িত্বটুকু এড়াতে তাকে ঠেলে দিচ্ছেন সেই কাজে। এরপর নারী যখন উপার্জন করে পরিবারের আর্থিক সংস্থান নিশ্চিত করছে, তখন কি স্বীকৃতিটুকু মিলছে? ঘরে-বাইরে কিন্তু নারী নির্যাতন ও অবমাননার ঘটনা ঘটেই চলেছে। যে পুরুষ নারীকে ঠেলে দিচ্ছে উপার্জনে, সেই পুরুষই কিন্তু আবার ঘরের বাইরে অনিরাপদ হয়ে উঠছে নারীর জন্য। ফলে নারী যখন বুদ্ধি আর দক্ষতা দিয়ে নিজেকে নিরবে প্রমাণ করে যাচ্ছে, পুরুষই কিন্তু তার হিংস্রতা দিয়ে ফের ভীতি ছড়াচ্ছে; যেন বলছে, নারী তুমি বাইরে এসো না।

এদিকে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেই আবার নারী-পুরুষ সাম্যের কথা উচ্চারিত হয় স্লোগানে স্লোগানে। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গিতে সাম্য এসেছে কি? নারীর মেধার চেয়ে দেহের সৌন্দর্যকে বড় করে দেখার প্রবণতা সময়ের সঙ্গে বরং বেড়েছে। সিনেমা, নাটক ও বিজ্ঞাপনে মডেল হিসেবে যে নারীর কদর, তা যেন ‘শোপিস’ হিসেবেই। যদিও নারীর কাজ করার সুযোগটুকু দিয়ে পুরুষতান্ত্রিকতা ভাবতে শেখায়, নারী তুমি স্বাধীন। যেন শারীরিক সৌন্দর্য উপস্থাপনই ব্যক্তিস্বাধীনতা অর্জনের উপায়।

কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের একটি উক্তি এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, ‘মেয়েদের মুক্তি, মেয়েদের স্বাধীনতা তো আজকাল নর-নারীর মুখে মুখে। কিন্তু ওই মুখের বেশি আর এক-পা এগোয় না।… স্বাধীনতা তত্ত্ব বিচারে মেলে না,… এ কেউ কাউকে দিতে পারে না, দেনা-পাওনার বস্তুই এ নয়… এ নিজের পূর্ণতায়, আত্মার আপন বিস্তারে আপনি আসে। বাইরে থেকে ডিমের খোলা ঠুকরে ভেতরের জীবকে মুক্তি দিলে সে মুক্তি পায় না— মরে।’

 

সারাবাংলা/টিসি/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন